সহযাত্রী

in bangla •  7 years ago 

30441546_1665383470218897_6693989229858390016_n.jpgসময় কাটছে না অনেক্ষন রেল স্টেশনের একটা বেঞ্চে বসে আছি। ট্রেন প্রায় তিন ঘন্টা লেট, মাঝে মধ্যে একটু পায়চারি,সঙ্গে ছোট একটা ব্যাগ,বিশেষ কিছুই নেই তাই নির্ঝঞ্ঝাট।ছোট পাহাড়ি স্টেশন লোকজন খুব কম চারিদিকে অপুর্ব দৃশ্য,সবুজের সাম্রাজ্য। অদুরে দেখা যায় পাহাড়ের কোলে পাহাড়ি গ্রাম,পাহাড়ি রাস্তায় নাম না জানা পাহাড়ি গাছে বাহারি ফুল, নুড়ি পাথরের মধ্যে দিয়ে খরস্রোতা নদী,মাঝে মধ্যে সুপারি গাছের ফাঁকে ধান ক্ষেত, আম জাম নারকেল গাছে ঢাকা টিনের ঘর,পাখির কলরব, পথের ধারে ছোট ছোট দোকান, মিষ্টি রোদে ফাল্গুনের বাতাসে মনটা কেমন যেন উড়ন্ত মেঘের মাঝে নীল আকাশে ভাসমান।আমি ২৭ বছরেরে অনভিজ্ঞ কৌতুহলি সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনে এক ভ্রমণ বিলাসী যাত্রী। লেখা পড়ায় মধ্যম বেড়াতে উত্তম প্রেম ভালবাসায় নির্বোধ অধম। মা,বাবা আর আমি ছোট পরিবার। অফিসে কাজে এখানে আসা। এখানকার মনোরম পরিবেশে রোমান্টিক আবহাওয়া দারুন লাগছিল আরও দুই একদিন থাকলে ভালই হত কিন্তু উপায় নাই অফিসের কাজ ফিরতে হবেই ।
পায়চারি করতে করতে আনমনা মনে সামনে তাকাতে হঠাৎ বুকটা ধরাস করে উঠলো, না কোন হৃদয়ের ব্যামো নয় ব্লাড প্রেসারও নয় আমার বসার বেঞ্চে দুই জন অপরিচিতা সুন্দরী যুবতী কখন এসে বসেছে লক্ষ্যই করিনি। একটা মিষ্ট গন্ধ ভেসে আসছে।দেখতে অসাধারণ সুন্দরী, অপরূপা লাবণ্যময়ী ভঙ্গিমা, চমৎকার চেহারা গঠন। এমন বিরল স্থানে,এমন সৌন্দর্য, এমন অবসরে এমন রোমাঞ্চকর অনুভূতির এমন ফাঁকা পরিবেশে এমন সঙ্গীর দেখা মিলবে- ভাবতেই পারি নি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল।কিন্তু আমি তো পায়চারি করছিলাম। বেঞ্চে যে আমি বসে ছিলাম তার প্রমাণ নাই। এখন যদি আমি আমার স্থানে গিয়ে বসি, ওরা কি ভাববে? নিশ্চিই ভাববে হেংলা ছেলে তাই দাঁড়িয়ে রইলাম আর মাঝে মাঝে সে দিকে তাকাচ্ছিলাম। কেন জানি না সোজাসুজি তাকাতে লজ্জা লাগছিল তবুও না তাকিয়ে পারা যায় না। সুন্দর সময় কাটানোর দারুন অমূল্য সজীব উপকরণ । মাঝে মধ্যে চোখে চোখ পরে যায়, কি যে করি? দুই জনের মধ্যে চোখে চোখ পড়া মেয়েটিকে মনে মনে পছন্দ করে ফেললাম দারুন দেখতে লাগছে তাঁকে, পাতলা মাঝারি গড়ন,পরনে হাল্কা নীল সাদা রঙ্গের সালোয়ার কামিজ সহ গলাপী ওড়না, সঙ্গে সামান্য ভারি একটা ব্যাগ মনে হয় দুই বোন। কোথায় যাবে কে জানে, তবে জানার খুব ইচ্ছে করছিল।
হঠাৎ ঐ মেয়েটি আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রশ্ন করল দাদা ট্রেনের কেমন দেরি আছে? আমি অপ্রস্তুত হয়ে,নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে প্রথমে বললাম তিন ঘন্টা পরে টাইম দেখে বললাম না না দুই ঘন্টা, বোকার মতো ভুলেই গেলাম জিজ্ঞাসা করতে যে কোন ট্রেন।পরে জিজ্ঞাসা করলাম।মেয়েটি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল লামডিং যাবার ট্রেন।আমি খুশি হয়ে বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ট্রেন তিন ঘন্টা লেট ছিল আমিও ঐ ট্রেন ধরব।অন্য মেয়েটি এতক্ষণ চুপ ছিল এখন সে জিজ্ঞাসা করল আমি কোথায় যাব? হেসে উত্তর দিলাম লামডিং। ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম হাসছেন কেন? আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে উল্টে জিজ্ঞেস করল লামডিং এ কি আমার বাড়ি? আমি উত্তর না দিয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করলাম আপনাদের বাড়ি কোথায়? ওরা একটু গম্ভীর হয়ে আস্তে করে বলল এই তো কাছেই ।আমি সাহস করে আস্তে আস্তে বেঞ্চের কিনারায় গিয়ে বসাতে ওরা ওদের ব্যাগটা নামিয়ে রাখল।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ওরা পরস্পর গল্প করছিল।সুখের সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়, আমি ভাবতে লাগলাম দুইটি উপযুক্ত সুন্দরী মেয়ে এখান থেকে চার-পাঁচ ঘন্টার রাস্থা সঙ্গে কোন গার্জেন নেই অথচ কেমন যেন এরা স্বভাবিক নির্ভয়ে যাত্রা করছে ।মনে হয় ওরা প্রায় এই ভাবে যাওয়া আসা করে।জিজ্ঞাসা করলাম লামডিংএ কথায় যাবেন? আমার পছন্দের জন আমার দিকে উল্টে প্রশ্ন করল আমি কোথায় থাকি?আমি বলালাম লামডিং। তখন সে জানাল ওদের বাড়ি এখানে,লামডিং এ কলেজে পড়ে সেখানে যাচ্ছে।কি নিয়ে পড় প্রশ্ন করাতে জালাল ইংরাজীতে অনার্স আর তাঁর বান্ধবী ইতিহাসের ছাত্রী। তখন আমি আমার পরিচয় দিয়ে ওদের নাম জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু ততোক্ষণে ট্রেন চলে আসে, আমরা ব্যস্ত হয়ে ট্রেনে চড়লাম, স্বাভাবিক ভাবেই একই কামড়ায়। বসার সিট কোনমতেই জোগাড় করা গেল না তাই সামনের স্টেশনের যাত্রী দেখে সেখানে দাঁড়ালাম।
আমার চোখের সামনে আমার পছন্দের নারী, সিটের কিনারা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের দোলনিতে সামান্য স্পর্শ,হালকা ছোঁয়ায় অসামান্য চাহনি,বাতাসে অবাধ্য চুল, সরে যাওয়া উড়ন্ত ওড়নার প্রান্ত দেশ, ভিড়ের মধ্যে সাবধানী স্পর্শকাতরতা। এর আগে এমন ভাল লাগার অনুভুতি কোনদিন পাই নি। খুব ইচ্ছে কর ছিল মনের সব কথাগুলো ঝরনার জলের মত ঝড় ঝড় করে বলে দিই।ছোট একটা চাকরি করি বাড়িতে সবাই মেয়ে দেখছে।কবে যে বিয়ে লেগে যায় কে জানে। মা অনেকবার প্রশ্ন করেছেন মনের মত কেউ আছে কি না।এখন যেহেতু একজনকে ভাল লাগলো তা হলে চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?ওর এই ভাবে দাঁড়িয়ে থকাটা আমার ভাল লাগছিল না তাই এদিক অদিক চেষ্টা করে একটা সিট পাওয়া গেল। আমি তাঁকে বসতে বললাম।কিন্তু সে নিজে না বসে ওর বান্ধবীকে বসতে বলল।আমি ক্রমশ ওর পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। সম্ববত মেয়েটি ইচ্ছে করেই আমার পাশে এসে দাড়ালো।আমিও আমার কলেজ জীবনের গল্প করছিলাম।সে মাঝে মধ্যে ওর নিজের কথাও বলছিল। ওরা এক ভাই দুই বোন, বড় বনের বিয়ে হয়ে গেছে ছোট ভাই স্কুলে পড়ে বাবা ব্যাবসা করেন কিছু জমি যায়গাও আছে ইত্যাদি ইত্ত্যাদি।মেয়েটির সুন্দর ব্যবহার মিষ্টি হাসি সাবলীল কথা বার্তা আমাকে আরও বেশি আকর্ষিত ও মুগ্ধ করছিল।কিছুক্ষন পরে সামনের স্টেশনের অনেকেই নেমে যাওয়াতে আমাদের দুজনের দুইটি সিট পাওয়া গেল। আমি ওদের দুজনকে সেখানে বসিয়ে অন্য দিকের সামান্য দূরের ফাঁকা সিটে একা বসলাম যেখানে বান্ধবী প্রথমে বসেছিল।এখন আমাদের মাঝে দুরত্ত অনেক বেড়ে গেছে। ভাবলাম সিট না পেলেই ভাল হত,দুজনে বেশ গল্প করছিলাম সেই ভাগ্যটা চলে গেল। কিন্তু কিছু পরেই সেই পছন্দের মেয়েটি আমাকে ডেকে ওদের ঠিক সামনের আসনে বসতে বলল আর আমার আসনে অপর আরেক জন লোককে বসতে অনুরোধ করল।সেই অপরিচিত ব্যাক্তি একটু হেসে বললেন যান বসেন এক সংগে গল্প করেন আমি একলা মানুষ ঐ খানেই জানালার পাশে বসি বেশ গরম লাগছে।আমি অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভাবতে লাগলাম এগুলো আমার সাথে আজকে কি হচ্ছে।

ট্রেন তার গতিবেগে চলতে লাগল আমি আমার জীবনের গতিবেগ বাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলাম।খুব ভাল করে তাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল সাহস পাচ্ছিলাম না ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করার।ফোনের কথা মাথায় আসতেই আমার দামী মোবাইলটা বেড় করলাম হয়ত বা দেখানোর উদ্দেশে।ধীরে ধীরে বিকাল হয়ে আসছে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি আমাদের গন্তব্যের কিন্তু আমার চলা যে মাত্র শুরু হল।কি ভাবে তাঁকে বলব? কিভাবে মনের কথা জানাব? তাঁর আর কোন বয় ফ্রেন্ড আছে কি না কে জানে? থাকাটা তো স্বাভাবিক।আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি, মাঝে মধ্যে আমাদের চোখে চোখ দৃষ্টি, লজ্জায় অবনত হাসি বিচিত্র অনুভুতি, ভাষাহীন অপ্রকাশিত অভিব্যক্তিতে সময়ের দ্রুততম গতিবেগে অতিক্রান্ত ঘড়ির কাটা । কিছু সাধারন কথা বার্তা হচ্ছিল বটে কিন্তু মনের ভিতরের ঝড় তাতে প্রকাশ পাচ্ছিল না। ট্রেন থেকে নামার আধা ঘন্টা আগে অনেক সাহস করে বলেই ফেললাম “লামডিং এ আমাদের বাড়িতে সময় পেলে আসবেন,খুব খুশি হব”।আমার আকস্মিক এই কথাতে সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল “গেলে চিনতে পারবেন?” আমি হেসে বললাম আপনাদের মনে থাকলে আমি চিনবো না কেন? মনে মনে ভাবলাম বাড়ি গিয়ে অবশ্যই মেয়েটির কথা জানাব।বিয়ের জন্য আলাপ পাঠাব বাবা অথবা মাকে দিয়ে?তাই জিজ্ঞাসা করলাম তাঁরা থাকে কোথায় ওরা ওদের বাসার ঠিকানা দিল। আমি আমার ফোন নম্বর দিয়ে বললাম কোন অসুবিধা হলে ফোন করবেন।
বড় আশা করেছিলাম ওরাও ওদের ফোন নম্বর দেবে কিন্তু সেটা তাঁরা দিল না। হয়ত ফোন করতে পারে।ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে আমরাও নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।নামার ঠিক আগে মনে পরে গেল আরে মেয়ে দুই টির নামই তো জানা হল না তাই জিজ্ঞাসা করলাম “সোরি, আপনাদের নামটা যেন কি বলে ছিলেন ?” পছন্দের মেয়েটি যেতে যেতে সুন্দর করে জানাল তাঁর নাম রাকিয়া আক্তার আর ওর বান্ধবীর নাম...... দরজার কাছে ভিড়ের ধাক্কায় আর শোনা হল না।হুড়মুড় করে পেসেঞ্জার ওঠা শুরু করেছে আসন দখল করার জন্য। কে যেন বলল “ ভাই উঠবেন না নামবেন” আমি বললাম নামব।

সত্যি আমি নামছি তবে শুধু ট্রেন থেকে নয় যে কাল্পনিক বা বাস্তব স্বর্গীয় প্রেমের সুখে ভাসছিলাম সেখান থেকে কারণ আমি হিন্দু ব্রাম্ভণ,মেয়েটি মুসলমান।ধর্মীয় ব্যবচ্ছেদে আমরা বিভক্ত,সাম্প্রদায়িক অনুশাসনে আমরা বিচ্ছিন্ন,ঈশ্বর আল্লাহ দন্দে আমরা শত্রু।স্টেশনে নেমে ভিড়ের মধ্যে তাদের পেলাম না,খোঁজার চেষ্টাও করলাম না চুপচাপ বাইরে এসে অটোতে ওঠে ভাবলাম নামটা আগে জানলে ভাল হত। মিথ্যা ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় আমরা কত নিরুপায় কত অসহায়।মনে হল পৃথিবীতে এই সব ধর্ম সম্প্রদায় জাতিপ্রথা না থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হত? অন্তত আমার ভালবাসা পূর্ণ এই দিনটা বৃথা যেত না।বড় ভাল লেগেছিল মেয়েটিকে। মেয়েটিও হয়ত পছন্দ করেছিল আমাকে কিন্তু এক অমানবিক নিষ্ঠুর নিয়মে এই বুক ভরা আশা নিরাশায় পরিণত হল।এসবের জন্য কে দায়ী, কেন দায়ী জানি না তবে বুকের মধ্যে একটা অজানা কষ্ট অনুভব করছি।আমরা আজও কোন না কোন ধর্মীয় অনুশাসনে বা সামাজিক মর্যাদায় জঘন্য ভাবে পরাধীন। জানি না কবে এগুলো দুর হবে। কবে মানুষ নিজেকে ধর্মীয় অনুসারি না ভেবে পৃথিবীর একজন মানব বা মানবী ভাববে। বুকের ভিতরে অস্পষ্ট কষ্ট তুষের আগুনের মত মচড় দিয়ে ধিক ধিক করে জ্জলছিল আর তীব্র চিৎকার করে কি যেন বলতে চাইছে যা আজও প্রকাশ করতে পারলাম না।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!