রাজপ্রাসাদের বিশালত্ব না দেখে কেউ সম্রাটের গৌরব অনুভব করতে পারে না।
-টাং রাজবংশের একটি কবিতাংশ
নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে পশ্চিমারা মনে করে যে, ক্ষমতা মূলত বহির্মূখী। অভিযান ও দখলদারিত্বের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে ক্ষমতার ভিত এবং তার উপরই টিকে থাকে। এই কারণে প্রাচীন চীনের সাম্রাজ্যিক ক্ষমতার নিদর্শন দেখে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে। কেননা, চীনা সভ্যতায় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের ভিন্ন, বলা যায় পশ্চিমা সভ্যতার বিপরীত এক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
এই অন্তর্মুখী চীনা ঐতিহ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে চীনের মহাপ্রাচীরের কথা বলা যায়। কয়েক শতাব্দী ধরে নির্মাণ করা হয়েছিল এই দেয়াল। যাতে স্তেপের হিংস্র যাযাবরদের আক্রমণের হাত থেকে চীনকে রক্ষা করা করা যায়। চীনকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করাই শুধু মহাপ্রাচীর নির্মাণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। এই প্রাচীর চীনাদের দুনিয়া হতে আলাদাও করেছিল। এই দেয়াল ছিল চীনের বিশাল কেন্দ্রীয় ক্ষমতার একেবারে বাহিরে পরত, যা মধ্য সাম্রাজ্যের সময়কালে চীনকে দৃঢ়তার সাথে ধরে রেখছিল।
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে সাম্রাজ্যের শেষপ্রান্ত এমনকী তার বাইরেও একজন চীনা সম্রাট যে পরিমাণ ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করতেন, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ইউরোপে আর এমনটি দেখা যায় নি। তারপরও চীনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মূলত দূর্ভেদ্যতা, অপসরণ, এমনকী অন্তর্ধান দ্বারা ঘিরে ছিল। স্বেচ্ছায় একঘরে হয়ে থাকার পরও কীভাবে চীন তার বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করত তা যেকোন বিদেশী পর্যটকের কাছে এটা ছিল এক রহস্য।
এই ধাধার এক উজ্জল ও আশ্চর্য উদাহরণ হচ্ছে বেইজিং প্রাসাদ জাদুঘর, পুরনো "নিষিদ্ধ শহর"। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এই শহর বাইরের জগত থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ও বন্ধ। ফলে নিষিদ্ধ শহর হিসেবে এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তরে নিয়মিত মঙ্গল আক্রমণে অতীষ্ট হয়ে তৃতীয় মিং সম্রাট ইয়োংলে(ঝুদি) তার রাজকীয় রাজধানী নানজিং থেকে বেইজিংয়ে সরিয়ে নিয়ে আসেন। নতুন রাজধানীতে আসবার সাথে সাথেই তিনি নিষিদ্ধ শহরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৪০৭-১৪২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্য এই শহর নির্মিত হয়। বলা হয়ে থাকে প্রায় দশ লক্ষাধিক শ্রমিক, এক লক্ষেরও অধিক দক্ষ কারিগর এই শহর বিনির্মাণে যুক্ত ছিলেন। এই শহরের স্থাপত্য নকশায় নিরাপত্তাহীনতার আশংকা চোখে পড়ে, কেননা স্তরের পর স্তর নিরাপত্তা বলয় ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রাজপ্রাসাদকে।
এই বিস্ময়কর নিদর্শনকে উপভোগ করতে, যেকোন পর্যটকের উচিত দক্ষিণ দিকের তিয়ানয়ানমেন(স্বর্গীয় শান্তির প্রবেশপথ) দিয়ে যাত্রা শুরু করা। সেখান হতে উত্তর দিকে উমেন(সর্বোচ্চ প্রবেশপথ, যেখানে প্রাসাদ জাদুঘরের টিকেট অফিস অবস্থিত) এর ভেতর দিয়ে নিষিদ্ধ শহরে প্রবেশ করা উচিত। এই পথ ধরেই প্রাচীকালে দর্শনার্থীরা এই শহরে প্রবেশ করত।
তারপর যাওয়া উচিত ইনার গোল্ডেন ওয়াটার ব্রীজ থেকে তাইহেমেন(সর্বোচ্চ প্রশান্তির প্রবেশপথ), যেটা তাইহেদিয়ানের(সর্বোচ্চ প্রশান্তির কক্ষ) দিকে যায়। তাইহেদিয়ান, যার অন্য পরিচয় জিয়ানলুয়ানদিয়ান(রাজকীয় সিংহাসন কক্ষ), হচ্ছে নিষিদ্ধ শহরের সবচেয়ে উচু এবং চীনের সবচেয়ে বড় কাঠের তৈরী হল। বাহিরের দিকের প্রাসাদের প্রধান তিনটি ভবনের মধ্যে প্রথম। একজন দূত নিষিদ্ধ শহরের ভেতরে এই পর্যন্তই আসতে পারতেন, আর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি বাহিরের আর কারো ছিল না।
বাইরের রাজপ্রাসাদের উত্তরে গেলে দেখা পাওয়া যাবে ঝংয়েদিয়ান(কেন্দ্রীয় প্রশান্তির কক্ষ), তারপর বাওহেদিয়ান। বাওহেদিয়ান(প্রশান্তি সংরক্ষণ কক্ষ) হচ্ছে সবচেয়ে উত্তরের প্রাসাদ। যেকোন বহিরাগত সম্রাট নিষিদ্ধ শহরের ভেতরে এতটুকুই প্রবেশ করতে পারতেন।
কিয়াংকিংমেন(স্বর্গীয় পবিত্রতার প্রবেশপথ) হচ্ছে অভ্যন্তরীন প্রাসাদের শুরু। তখনকার সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শনার্থীও এখানে প্রবেশ করতে পারত না। আজ একমাত্র মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে স্টারবাকসের নিষিদ্ধ শহরের এই পর্যন্ত ব্যবসা করবার অনুমতি দেওয়া আছে।
আরো উত্তর দিকে আগাতে থাকলে, অভ্যন্তরীন প্রাসাদের প্রধান তিনটী হল; কিয়াংকিংগং(স্বর্গীয় পবিত্রতার কক্ষ), জিয়াওতাইদিয়ান(সমৃদ্ধির কক্ষ), কুনিংগং(জাগতিক শান্তির কক্ষ) এর দেখা মিলবে। তারপর কুনিংমেনের(জাগতিক শান্তির প্রবেশপথ) ভেতর দিয়ে গেলে যেকোন ক্লান্ত পর্যটক প্রবেশ করবে রাজকীয় বাগানে। আর কিনানদিয়ান(রাজকীয় শান্তির কক্ষ) তার একটু সামনেই।
রাজকীয় বাগানের উত্তরে হচ্ছে শেনউমেন(উত্তরের প্রবেশপথ), যা দিয়ে বর্তমানে বাগানে প্রবেশ করা যায়, আবার বাহির হওয়া যায়। এই দিক দিয়ে প্রবেশ করলে পুরো শহরের সবচেয়ে জাদুকরী বিশেষত্বটাই মিস হয়ে যাবে।
যদিও এই রাজকীয় শহর সম্রাটের বাসস্থান হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু এই শহরের নকশার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রজাদের কিংবা বিদেশীদের মুগ্ধ করা, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে তাদের বিহবল করে দেওয়া। এই শহরে প্রতিটি দেয়াল যেন এক একটি শিল্পের প্রদর্শনী। এবং এই চিরস্তায়ী প্রদর্শনীর একমাত্র বিষয় ছিল দূরবর্তী সম্রাটের জাঁকজমক, আড়ম্বরতা।
নিষিদ্ধ শহরের নিরবিচ্ছিন্ন বহির্মুখী স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে অপসরণের চতুর নিদর্শন। আসলে কী লুকানো আছে তার মধ্যে কোন রহস্য নেই, রহস্য আছে লুকিয়ে রাখবার নাটকীয়তায়। তারপর যখন কেউ শেষমেশ অভ্যন্তরীন প্রাসাদে প্রবেশ করে, যেখানে থাকতেন সম্রাট, তার স্ত্রী-সন্তানেরা এবং উপপত্নীরা, সে আশ্চর্য হবে এই প্রাসাদের অনাড়ম্বতা দেখে। মনে হবে যেন কোন নাটকের ব্যাকস্টেজ, যেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিশ্রাম নেয় অভিনয়ের ফাকে এবং নিষিদ্ধ শহরের বিভ্রম যেন কেটে যাবে কিছু সময়ের জন্য।
ফলে পশ্চিমা পর্যটকরা একে তুলনা করতে পারে উইজার্ড অভ অজের সেই আদেশ : "পর্দার পেছনে দেখ না।" এর সাথে। এমন তুলনা আরো মজবুত হয় যখন তারা জানতে পারে যে, কিং রাজবংশের শাসনামলের শেষসময়ে পর্দার পেছন হতে শাসন করতেন রানী দোওয়াগার সিশি(১৮৩৫ - ১৯০৮)।
এতসব বিভ্রমপূর্ণ প্রাসাদ দেখে মনে নতুন প্রশ্ন জাগতে পারে যে, রাজকীয় চীন কী আসলে এক বিশাল জাদুর খেলা ছিল?
যদিও যাদুর দুনিয়াকে আমরা লুকানো জিনিস, গুপ্তসংঘের সাথে সম্পর্কযুক্ত ভাবি, যাদুকরতো কোন কিছু লুকায়, আগে কিছু দেখানোর মাধ্যমেই।
যদিও নিষিদ্ধ শহর নির্মাণ করা হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রকে আড়াল করার জন্য, কিন্তু এই শহর তার জাদুকরী প্রয়াস আড়াল করবার চেষ্টা করেনা। এই শহর নির্মিত হয়েছিল ফেং শুইয়ের(চীনা ভূমি যাদুকৌশল) নিয়মকানুন মাথায় রেখে। এর সমস্ত প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে। এবং এই শহরের জ্যামিতিক নকশা আজও বেইজিংয়ে প্রভাশালী। প্রতিটি হল, প্রাসাদকে সাজানো হয়েছে রহস্যময়, জাদুকরী প্রাণি, রাজকীয় ফিনিক্স, সিংহ আর কচ্ছপের নকশা দিয়ে, যেগুলো প্রাচীন জাদুকরী জ্ঞানের প্রতীক। সারস হচ্ছে দীর্ঘায়ুর প্রতীক আর অগণিত ড্রাগন আর ফিনিক্সের জোড়া গুলো রক্ষা করে চলেছে প্রাসাদের দরজা। এই সব প্রাণি হছে প্রাসাদের রক্ষক আর গুপ্তরাজ্যের পথপ্রদর্শক।
আজও শুশুর(প্রাচীন চীনা সংখ্যাতত্ত্ব) মাধ্যমে যেন নিষিদ্ধ শহরের যাদুকরী ভিত্তি সবচেয়ে স্পষ্ট চোখে পড়ে।
রাজকীয় ক্ষমতার জাদুকরী সংখ্যা ছিল নয়, সর্বোচ্চ দশমিক সংখ্যা, যার সংখ্যাতাত্ত্বিক আর গাণিতিক বৈশিষ্ট্য ইয়োংলে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়েছিলেন। পুরো নিষিদ্ধ শহরে ঘর আছে মোট ৯৯৯৯টি, এর দেয়ালে গেইটের সংখ্যা নয়ের গুণিতক, এর টাওয়ারগুলোর রয়েছে ৯টি করে বিম আর ১৮টি করে কলাম। এমনকী ইয়োংলে রাজকীয় বাগানে দিউশিউশান(সম্মিলিত পরিমার্জনার পাহাড়) নাম কৃত্রিম পাহাড় নির্মাণ করেছিলেন, যার উপর রয়েছে ইউজিংটীং(রাজকীয় পরিদর্শন স্থান)। চোঙ্গিয়াং উৎসব, যা নবম চান্দ্রমাসের নবম দিনে অনুষ্ঠিত হয়, উপলক্ষে এই পাহাড় নির্মাণ করেছিলেন। নয় নিয়ে ইয়োংলের উন্মাদনার চূড়ান্ত উদাহরণ দেখা যায় তিয়ান তান(স্বর্গীয় মন্দির) মন্দিরে, যা নয়টি প্রস্তর ধাপে নির্মিত আর প্রতিটি ধাপে পাথর সংখ্যা হচ্ছে নয়ের গুণিতক।
মিং সম্রাট কিয়ানলং তার পূর্বশুরীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে নির্মাণ করেন বিশাল নয়-ড্রাগন দেয়াল, যা হুয়াংজিমেনের(সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠত্বের প্রবেশপথ) সামনে অবস্থিত।
আধুনিক পর্যটকদের নিকট নিষিদ্ধ শহরে এইসব জাদুকরী বৈশিষ্ট্য পাগলামী মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যে শাসকশ্রেণি অবক্ষয়, তাদের বাস্তব সিদ্ধান্ত হতে দূরে রেখেছে। মোটের উপর রাজকীয় চীন বারুদকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যখন তারা এই জিনিস ব্যবহার করত প্রদর্শনীতে। অথচ এমন ভাবনার কারণে চীনের রাজকীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ভুলে যেতে পারি যে, যদিও যাদুর প্রদর্শন বিভ্রমের মাধ্যমেই হয়ে থাকে, কিন্তু এই বিভ্রম হতে পারে ক্ষমতার অন্যতম উপায়।
Power of Illusion! হইতে উক্ত লেখাটি অনুবাদ করা হইছে। সম্ভবত নিক ল্যান্ড এই লেখাটা লেখছেন।
"Neo China arrives from the future." -Nick Land