অনিলবাবুর ছোট্ট মেয়ে পায়েল .
তার জন্মদিন আজ .
সকাল থেকেই ব্যস্ত সস্ত্রীক অনিলবাবু .
ক্যাটারার্স, ডেকোরেটার্স,নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়নসূচক প্রস্তুতি'পর্ব ; সবকিছু নিয়ে মেতে রয়েছে ছোট্ট মিষ্টি পরিবার'টি .
দুপুর গড়িয়েছে,এই কিছুক্ষন আগে....
আস্তে আস্তে ভিড় জমতে শুরু করেছে আমন্ত্রিত'দের.
পায়েল'সোনা কে একদম পরীর মতো দেখাচ্ছে ..
ছোট নিষ্পাপ কাজলমাখা চোখ,ঠোঁটে মিষ্টি হাসি,পিঙ্ক লং ফ্রকের সাথে শোভা পাচ্ছিলো মাথার ছোট মুকুট'খানি.
কচি পায়ে নুপুর পড়ে, দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছিল সে সারা বাড়ি ..
কেক কাটার পর্ব শুরু হওয়ার আগে অনিল'বাবু আর তার স্ত্রী,পায়েল'কে আদর করে তার গলায় একটি সোনার নেকলেস পড়িয়ে দিলেন .
.. অনেক দিনের পরিকল্পনা ও প্ল্যান মাফিক একটু একটু করে অর্থ সঞ্চয় করে আজকের দিনটা উপভোগ করছেন অনিলবাবু.
কেক কাটার পর্ব মিটলো ...
খাওয়া'দাওয়ার পরবর্তী অধ্যায়'ও শুরু হলো...
অতিথিবৃন্দ মেতে ছিলেন পেটপুজোতে.
দম্পতি সবার কাছে গিয়ে ভাব বিনিময় করছিলেন.
পাড়া প্রতিবেশী,বন্ধু ,ও আত্মীয় স্বজনের হৈ'হুল্লোড়ে যেন গমগম করছিলো গোটা বাড়ি.
এমন সময় ঘটলো এক,অপ্রত্যাশিত মন ভারাক্রান্ত করা ঘটনা.
ব্যাপারটা প্রথম আবিষ্কার করলেন অনিলবাবুর স্ত্রী.
বলা নেই, কওয়া নেই ...পায়েলের গলার হার'খানি কিনা উধাও !!
--"সেকি ! নিশ্চয় কোথাও পড়ে গিয়েছে "
ভাবনা'চিন্তা করে এদিক'সেদিক খুঁজতে লাগলেন অনিলবাবু . কিন্তু মেয়ের মা,অন্য কিছু ভেবে নিয়ে অনিল'বাবু কে বোঝানোর চেষ্টা করলেন..
স্ত্রীর কথার খেই ধরে নিয়ে, ভ্রু কুঁচকিয়ে ভাবলেন অনিলবাবু ..
--" চুরি ?" "কে চুরি করবে এভাবে একপাল লোকের মধ্যে?কার'ই বা সাহস হবে? "
" নানা ! হতে পারেনা !...."
পরক্ষনেই ভাবলেন -' " অসম্ভবের'ই বা কি ? দিনকাল ভালো নয়, লোভে মত্য হয়ে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে ..তাই বলে এভাবে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে হার চুরি করবে? "
কিছুতেই তার বিশ্বাস হচ্ছিলোনা ব্যাপার'টি ...অনিল বাবু আর তার স্ত্রী অনেক তত্ত্বতালাশ করেও কোনো কিনারা করতে পারলেন না.
এমন সময় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে থেকে এক'মহাশয় যুক্তি দিলেন অনিলবাবু'কে :
--"অনিলদা ! আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ এই কুকর্ম'টি করেছে..প্রত্যেকের তল্লাশি নেওয়া হোক.
অনিলবাবু কিছুতেই মাননীয় অতিথিদের এইরূপ হেনস্থার পক্ষ নিলেন'না, কিন্তু শেষমেশ গুরুভাগ অতিথিবৃন্দের সমর্থনে বাধ্য হলেন.
...ডাকা হলো উপস্থিত লোকজনদের.
শুরু হলো সার্চ প্যারেড.
রীতিমতো লাইনে দাড়'করিয়ে প্রত্যেকের তল্লাশি পর্ব চলছিল
.***************************************************
না ! পাওয়া গেলোনা হার.
একদম লাইনের শেষের দিকে ছিলেন এক বয়স্ক প্রতিবেশী ' দিনু কাকা' .. নাম 'দীনবন্ধু সরকার'. সবাই ওনাকে দীনুকাকা বলেই ডাকে..বয়স সত্তর পেরিয়েছে . .
দিনুকাকা'কেও সার্চ করতে অনিলবাবুর এক আত্মীয় এগিয়ে এলেন.
কিন্তু সব্বাইকে অবাক করে উনি এই তল্লাশির বিরোধিতা করলেন .
একপ্রকার চিৎকার করেই বললেন' :.
--" না না ! আমি আমার তল্লাশি নিতে দেবোনা, কারণ আমি চুরি করিনি "
পাশ থেকে অন্যএক ব্যক্তি,বয়ষ্ক মানুষটির উদ্দ্যেশ্যে সবিনয় বললেন :
--" চুরি যখন করেননি তাহলে আপনার ভয় পাওয়ার,বা রাগ করার কারণ তো নেই, দয়া করে সহযোগিতা করুন "
এই কথা শুনে দিনু'কাকা যেন আরও চোটে গেলেন..রাগে ফুসতে ফুঁসতে কাঁপা গলায় বললেন :
--" অনিল আমার ছেলের মতো,ও আমাকে অনেক শ্রদ্ধ্যা করে, ও নিশ্চয় আমার কথাই শুনবে. ..অনিল ! তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো বাবা ? "
অনিল'বাবু তৎক্ষণাৎ সার্চ করানো বন্ধ করে দিলেন..
অনিলবাবুর স্ত্রী তো রেগে টং!
উনি আলাদা করে ডেকে অনিলবাবু কে বললেন
--" ওনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, নেকলেস'টা উনি'ই নিয়েছেন; তাছাড়া আমি খেয়াল করেছি, ওনার ঢোলা ফতুয়ার পকেটে হাত ঢুকিয়ে বার'বার কিছু একটা স্পর্শ করার চেষ্টা করছেন ..
নির্ঘাত উনি'ই নিয়েছেন,এভাবে এতো বড়ো অন্যায় কে প্রশ্রয় দিওনা..এযে !পুরো চোখের সামনে ডাকাতি !"
অনিলবাবু তার স্ত্রী'কে বুঝিয়ে বললেন :
"এই আনন্দের দিনে উনি চান না কোনো ধিক্কারজনক ঘটনা সব কিছু মাটি করে দিক, তাছাড়া নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে এভাবে কাউকে অপমানিত করাটাও সভ্য দেখায়না..তবে তিনি অন্যভাবে তার কিনারা করবেন.."
অস্বাভাবিক পরিবেশটি লক্ষ করে ছোট্ট পায়েল ভয়ে চুপটি করে এক কোনে বসে ছিল..
ব্যাপারটা বুঝে সাথে'সাথেই অনিলবাবু সবাইকে করজোরে অনুরোধ করে শান্ত করলেন আর বলে দিলেন বিষয়টি নিয়ে না ভাবতে ..
অনুষ্ঠান'পর্ব মিটলো....
বিদায় নিলেন লোকজন.
অনিলবাবু গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন ...
--" লোভ ও দরিদ্রতা মানুষকে কোথায় নামাতে পারে! ..এক প্রবীণ মানুষ,যাকে তিনি এতো শ্রদ্ধা করতেন, শেষমেশ ওনার মনে এই ছিল ? " তাহলে,ওনার প্রতি দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের'কি কোনো মূলই ছিলোনা? "
হতাশ হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার অভিপ্রায়ে বেডরুমে এলেন জামা পাল্টাতে;
--একি ! ওয়ার্ডড্রোবের নিচে,ছোট চেয়ারের পায়ার কোনে কি যেন একটা চকচক করছে !
কাছে এসে, ঝুকে দেখলেন অনিল'বাবু :
"আরে ! এই তো নেকলেস'টা ! এখানে এলো কি ভাবে? নিশ্চয় পায়েল খেলতে খেলতে কোনো ভাবে এখানে এসে হারিয়ে ফেলেছে ..."
-হারটি তুলে ভালো করে দেখলেন, হুকের দিকটা কাটা ..তাড়াহুড়োতে সেদিন ভালো করে না দেখেই স্থানীয় সেঁকড়ার কাছ থেকে কিনেছিলেন এটি..হয়তো প্রথম থেকেই হুক'টি আধকাটা অবস্থায় ছিল..খেয়াল করা হয়নি.
যাই হোক ...যেন, প্রাণ ফিরে পেলেন অনিলবাবু .
দেরি না করেই, স্ত্রী'কে ডাকলেন ..
হারটি দেখেই আল্লাদে আটখানা হয়ে গেলেন অনিলবাবুর স্ত্রী.. তার সাথে নিজের উপর লজ্জাবোধ হলো তার .. বললেন:
--" শোনো ! সব্বাইকে কিন্তু জানিয়ে দিও যে ,হারটি পাওয়া গেছে.. তানাহলে প্রত্যেকেই ওই বুড়ো মানুষটিকে অযথা ভুল বুঝবে ..,
জানো ! ..উনি কি সুন্দর একটা পুতুল উপহার দিয়েছেন আমাদের মেয়ে'কে ! "
কথাটা শোনা মাত্রই অনিলবাবুর মনটা আরও চঞ্চল হয়ে উঠলো ..
তার মস্তিষ্কে নুতন করে অন্য চিন্তা ভিড় করে এলো...
" যদি তাই হবে,তাহলে দিনু'কাকা কেনোই বা ওভাবে তখন তল্লাশি নিতে বাধা দিলেন ? " সব যেন নুতন করে তালগোল পাকিয়ে গেলো ..
জামা পাল্টিয়ে বেরিয়ে পড়লেন...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তার উল্টো দিকে, একটি পান'দোকানের গুমটি, ওটাকে বাম'দিকে রেখে কাঁচাপাকা রাস্তার দ্বিতীয় বাড়িটাই দীনুকাকার ...
দীর্ঘ্যদিনের ঋদ্ধতা তাদের সাথে.
অনিলবাবুর স্বর্গীয় পিতার এক সময়ের বন্ধু ছিলেন এই দিনুকাকা.. এক'ই পাড়ায় থাকতেন..
ওনার বাড়িতে থাকেন ওনার স্ত্রী মানে কাকিমা , আর পায়েলের সমবয়সী বাপ'মা হারা এক নাতনি - 'তিন্নি'..
আজ ওনাকে কেমন যেন বিষণ্য দেখাচ্ছিল ,
ওনার স্ত্রী,অথবা তিন্নি,কাউকেই আজ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি ..
নেকলেসের ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই উনি বিচলিত ছিলেন যে,তাদের খোঁজখবর'ও নেওয়া হয়নি.
ঠক ঠক ঠক !! কড়া নাড়লেন অনিলবাবু..
কিছুক্ষন পরে দরজা খুললো ..
দীনুকাকাই দরজা খুললেন ..
অপ্রত্যাশিত ভাবে অনিলবাবু'কে দেখে যেন চমকে উঠলেন দিনুকাকা ..
বললেন..
--"কোনো সমস্যা হয়েছে বাবা? "
অনিলবাবু একগাল হেসে বললেন :
--" সমস্যা ছাড়া কি আপনার বাড়িতে আস্তে বাধা?" "
দীনুকাকা আনন্দ সহকারে ভেতরে ডাকলেন ..
অগোছালো ঘরে কোথায় যে বসতে দেবেন অনিলবাবু কে, বৃদ্ধ'মানুষটি বুঝে উঠতে পারছিলেন না..
অবস্থা বুঝে অনিলবাবু নিজেই একটা চৌকি টেনে ঘরের এক কোনে বসে পড়লেন.
তারপর জামার পকেট থেকে সেই নেকলেস'টি বের করে,দিনুকাকার সামনে মেলে ধরে বললেন- ---"দেখুন ! হার'টি পাওয়া গেছে.. ঘরের মধ্যেই ছিল."
বুড়ো'মানুষটির মুখে এক অনাবিল আনন্দ ফুটে উঠলো.. প্রাণ ভরা হাসিতে যেন উপছে পড়ছিলো স্বস্তির আবেশ.
শুরু হলো এক অবাক করা কথোপকথন ..
অনিলবাবু শান্ত স্বরে বললেন :
-- "এবার বলুন ! তখন কেন অমন আচরণ করলেন শুধু শুধু? সবাই তো আপনাকেই সন্দেহ করলো অযথা..আমাকে নির্ভয়ে সব কিছু বলুন..কথা দিচ্ছি সমস্ত কথা আমাদের মধ্যেই থাকবে."
দীনুকাকার শুকনো চোখ'দুটি ছল'ছল করে উঠলো..
উনি বললেন:
-- " তোমার কাকিমার ভীষণ জ্বর , পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে..নাতনিটাও যেতে চাইলোনা ঠাকুমা'কে ছেড়ে ,এদিকে ঘরে কোনো দানাপানি নেই যে ,ওদেরকে খেতে দেবো..
তাই...একাই চলে গেলাম তোমার ওখানে, , তুমি বড় মুখ করে আমাদের ডেকেছো ! গরিব কাকা কে সম্মান দিয়েছো..কথা রাখা উচিত ..চলেও গেলাম.."
"কিন্তু খেতে বসে বার'বার বাড়িতে ওই দুজনার কথা মনে পড়ছিলো জানো !কি খাবে আমার বুড়ি আর পুচকেটা ? "
অনিলবাবু নিজের চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিলেন না.
নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালেন ...বললেন
--"তারপর? "
হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দিনুকাকা বললেন :
--" তারপর আর কি বাবা ? তোমরা বড়োলোক, কত লোকজন তোমাদের বাড়িতে ! বিবেক'বুদ্ধি হারিয়ে নাতনি'টার জন্য একটু খাবার চুরি করে এনেছিলাম গো বাবা !!!"
অনিলবাবু মাথা নিচু করে বসে রইলেন কিছুক্ষন ...
সীমাহীন কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছিলো. মনে মনে ধিক্কার জানাচ্ছিলেন নিজেদের যুক্তিতক্কের উপর.
"সত্যি তো ! তাদের মতো সমাজের তথাকথিত ভদ্র-সভ্য মানুষেরা আর কি'ই বা ভাবতে পারেন?.. কি করবে ? কি ভাবে মানুষটিকে সান্ত্বনা দেবে; বুঝতে পারছিলেন'না অনিল'বাবু . "
নিজেকে সামলিয়ে তিনি বললেন :
--" আমাকে বাবা বলে ডাকেন! সেই অধিকারে বলতে পারলেন না মনের কথা ? "
দীনুকাকা অনিলবাবুর হাত ধরে বললেন :
-- " বলবো ! এবার থেকে সব বলবো আমার বাবু কে , আমার ছেলেটাও একদম তোমার মতোই কথা বলতো,
....আমার'ই কপাল পোড়া ! সব হারালাম"..
বর্ষশেষের রাতে অনিলবাবুর আগ্রহে,সেদিন বাড়িতে নৈশভোজে বিশেষ অতিথি এলো..
দিনু'কাকা আর তার নাতনি-তিন্নি .
হলো অনেক মজা আর হৈ'হুল্লোড় !