নাটাই ঘুড়ি

in banglagolpostory •  3 years ago 

FB_IMG_1646744945546.jpg
প্রকৃতি মাঝে মাঝে এরকম কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর দৃশ্য তৈরি করে, যেন মানুষ সুতো কেটে উড়ে যাওয়ার কথা কখনো না ভাবে।
যত দূরেই যাক না কেন, দিন শেষে যেন ফিরে আসে ভালোবাসার মায়াবী সুতোয় জড়িয়ে রাখা সংসারের নাটাইয়ে।"

সংসার নামক নাটাইয়ে ভালোবাসার টানে জড়িয়ে থাকি আমরা সবাই। সেই ভালোবাসা কারো জীবনে ধরা দেয় খাঁটি হয়ে, আবার কারো জীবনে আসে মরীচিকা। সংসার নামক নাটাইয়ে জড়িত তেমনই কিছু মানুষের গল্প 'নাটাই ঘুড়ি'।

★ কাহিনী সংক্ষেপ :

'আমেনা মঞ্জিল' নামক এক পুরনো দোতলা বিল্ডিংয়ে বসবাস এক যৌথ পরিবারের। সেই পরিবারের ছোট মেয়ে দুষ্টু মীরাকে কেন্দ্র করেই ঘটে উপন্যাসের কাহিনীর সূত্রপাত। তার দুষ্টুমির ফলশ্রুতিতে উন্মোচিত হয় পরিবারের সাথে সম্পর্কিত অজানা অনেক রহস্যের। কী ছিল সেই রহস্যেরা?

শিহাব ছোটবেলা থেকেই মীরার চাচাতো বোন নীরার জন্য মনের গহীনে লুকিয়ে রেখেছে ভালোবাসা নামক অনুভূতিকে। কী হবে তার এই একপাক্ষিক ভালোবাসার পরিণতি?

নীরার ভাই মুশফিক লেখাপড়ার সূত্র ধরে 'আমেনা মঞ্জিল' ছেড়ে গমন করে শহরে। সেখানে তার জীবনে আগমন ঘটে রিম্মির। কিন্তু কে এই রিম্মি?

মীরার ছোট চাচা ইমরুলের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িত তিথি। কিন্তু ইমরুল নিজ অবস্থানের জন্য তিথির হাত ধরে বাকী জীবন কাটানোর সাহস করে উঠতে পারে না। অন্যদিকে ইমরুলের সাথে হঠাৎ করে পরিচয় ঘটে রূম্পার। কে এই রূম্পা? কী হবে ইমরুল, তিথি ও রূম্পার পারস্পরিক সম্পর্কের পরিণতি?

আবার মীরার ফুপু নাইমা বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রহী নয়। কিন্তু কেন? কখনো কি তার মতের পরিবর্তন ঘটবে?

সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে পড়তে হবে 'নাটাই ঘুড়ি' নামক সামাজিক উপন্যাসটি।

★ চরিত্র কথন :

একান্নবর্তী পরিবারের কথা ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনেক সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিবারের চিত্র। আর এমনই এক পরিবার নিয়ে রচিত গল্পে চরিত্রের সংখ্যা বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপন্যাসে মীরা, নীরা, নাইমা, তিথি, রূম্পা, রিম্মিসহ যেমন একাধিক উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র রয়েছে, তেমনি রয়েছে শিহাব, মুশফিক, ইমরুলসহ একাধিক পুরুষ চরিত্র। সবগুলো চরিত্রই নিজ নিজ অবস্থানে যথার্থ। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র 'আহনাফ'। 'দিকভ্রান্ত পথিক' চরিত্রটিও অনেক প্রিয়।

★ পাঠপ্রতিক্রিয়া :

কালের পরিক্রমায় পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, প্রয়োজনের তাগিদে সবাই এখন 'একক পরিবার' গঠনে সচেষ্ট। যৌথ পরিবারের গল্পগুলো আশ্রয় নিচ্ছে বইয়ের পাতায়। তেমনই এক একান্নবর্তী পরিবারের গল্প চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। তুলে ধরা হয়েছে সেই পরিবারের সদস্যদের ও তাদের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও ভালোবাসার গল্প।

উপন্যাসের শুরু থেকে মীরার দুষ্টুমিগুলো যেমন মুখে হাসি ফুটিয়েছে, তেমনিভাবে অন্যান্য চরিত্রের জীবন সংগ্রামের গল্পগুলো হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। আবার শিহাবের ভালোবাসা যেমন ভালোবাসার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করিয়েছে, তেমনভাবে রিম্মির সামাজিক কর্মকাণ্ড মানবতার শিক্ষা দিয়েছে। সবমিলিয়ে সুখপাঠ্য একটি উপন্যাস।

লেখকের লেখনী চমৎকার। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল সহজ ও সাবলীল বর্ণনা। যেকোনো পাঠক গল্পটি পড়া শুরু করলে খুব সহজেই গল্পের কাহিনীর সাথে একাত্ম হতে পারবে। অতিরঞ্জিত কোনো বিষয় ছিল না। অল্প কয়েকটি শব্দের টাইপিং মিস্টেক বাদে সমালোচনা করার মতো তেমন কিছু পরিলক্ষিত হয়নি। উপন্যাসটির পরিসমাপ্তি মনে একই সাথে সুখের ও দুঃখের অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। শেষ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল আরও যদি থাকতো!

যারা অনলাইনে রুচিসম্মত গল্প পড়তে আগ্রহী তারা নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন 'নাটাই ঘুড়ি'।

★ প্রিয় কিছু উক্তি :

~ নিজের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার অর্থহীন চেষ্টা নিরন্তর করে যায় মানুষ। যদিও দিন শেষে আবার নিজের বৃত্তেই ঘুরপাক খায়, তাতেই স্বস্তি বোধ করে। পুরনো সবকিছুর মায়ার টানে আটকে যায়। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা পুরনো ক্যালেণ্ডারটাও ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না।

~ সঠিক সময়ে যে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারে না, তাদের নাম পৃথিবীর সফল মানুষদের তালিকায় কখনো থাকে না। কোনো হিসেবেই তারা জেতে না। হেরে যাওয়া মানুষদের জন্য ইতিহাস কোনো জায়গা রাখে না।

~ বাধা পাওয়ার পরও যে পথ চলা থামিয়ে দেয় না, প্রকৃতি চলার পথে তাদের জন্য চমক সাজিয়ে রাখে। অন্য কোনো না কোনো দিক দিয়ে ভরিয়ে দেয় তাদের অপূর্ণতা। বাধা পাওয়ার পরেও থেমে না গিয়ে চলার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা, থেমে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া।

~ মানুষের মন বড় রহস্যময়, ভুলে যাওয়া ভালোবাসাকেও সে খুব যত্ন করে ঠাই দিয়ে রাখে মনের কোনো অচিন কুঠুরিতে।

★ নিজস্ব কিছু অনুভূতি :

ছোট থেকেই একক পরিবারের সদস্য হওয়ায় 'যৌথ পরিবার' আমার কাছ এক স্বপ্নের নাম। মাঝে মাঝেই কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়ে ভাবতে বসতাম, যদি আমি কোনো একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য হতাম তাহলে আমার জীবন কেমন হতো! অনেক ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সংস্পর্শে বড়ো হওয়ার মজাটাই বা কেমন হতো! এসব ভাবনাগুলো শুধু কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। বাস্তবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ কখনো হয়ে ওঠেনি। সেকারণেই হয়তো একান্নবর্তী পরিবারের গল্পগুলো সবসময়ই আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আর তেমনই একটি গল্প 'নাটাই ঘুড়ি'।

রিভিউটি শেষ করছি উপন্যাসের চরিত্র 'দিকভ্রান্ত পথিক' এর লেখা কিছু লাইনের মধ্যে দিয়ে -

“আমি ভীষণ ছন্নছাড়া মানুষ
ছাড়া পেলেই আকাশ জুড়ে উড়ি,
দিনের শেষে আবার ফিরে আসি
নাটাই যেমন আটকে রাখে ঘুড়ি।“

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!