শুরু করা যাক সেতুর পেছনের গল্প থেকে। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন অনেকদিন থেকে দেখে আসলেও কাজ শুরু হয় প্রজেক্টের Prefeasibility Study নামে একটা রিপোর্টের মাধ্যমে, ২০০০ সালে। পুরো প্রজেক্টটার Initial Feasibility Study রিপোর্ট দেয়া হয় ২০০৫ সালে। Feasibility Study কে খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, যত টাকা এর পিছনে ঢালা হবে, সেটা কতটা লাভজনক, বা আদৌ লাভজনক কি না, সেই হিসাব করা। বা কোথায় কোন জায়গায় কিভাবে করলে সবচেয়ে কম টাকায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে।
source
Prefeasibility Study এর উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থানটি খুঁজে বের করা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছিল, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো নদীটা ক্রস করা। যাতে যানবাহন নদীর ওপর অথবা নিচ দিয়ে যেতে পারে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে স্টাডি করল সেতু ও টানেল নিয়ে। দেখা গেল যে বিনিয়োগের দিক থেকে টানেলে অনেক বেশি খরচ। তখন টানেল বাদ গেল, নদী পার হওয়ার জন্য থাকলো সেতু।
২০০১ সাল থেকে শুরু হলো জাইকার অর্থায়নে ফিজিবিলিটিজ স্টাডি। আবার শুরু হল নতুন করে সাইট সিলেকশন। গোয়ালন্দ থেকে শুরু করে চাঁদপুর পর্যন্ত স্টাডি করে দেখা গেল মাওয়া-জাজিরা সাইটই সবচেয়ে ভালো।
ফিজিবিলিটি স্টাডিতে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়, একটা হলো—কোন দিক দিয়ে গেলে বেশি যানবাহন আকৃষ্ট হবে, মানে ঠিক কোন জায়গায় রাস্তাটা মানুষের সবচেয়ে বেশি দরকার, বা বেশি সংখ্যক মানুষের দরকার। দ্বিতীয়টা হলো, নদীর গতিপথ কোথায় তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তনশীল। পদ্মা কোনো কোনো বছর দু-এক কিলোমিটার সরে যেতে পারে। এ জন্য সাইট নির্বাচন করতে হলে দেখতে হয়েছে কোনটা বহুদিন ধরে স্ট্যাবল রয়েছে, মানে নদীটা বহুদিন ধরে একই জায়গায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও দেখা গেল মাওয়া-জাজিরাই উপযুক্ত স্থান।
source
যাইহোক, পুরো প্রজেক্টটা দুই ভাগে বিভক্ত।
ফেজ ১: প্রজেক্ট ডিজাইন থেকে টেন্ডার দেয়া পর্যন্ত
ফেজ ২: কনস্ট্রাকশন
ফেজ ১, মানে এই পদ্মা ব্রিজ ডিজাইনিং এর কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। পদ্মা ব্রিজের ডিটেইলড ডিজাইন করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে টিম গঠন করা হয় যার প্রধান ছিল AECOM নামের প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্রিজ অথোরিটি একটা প্যানেল গঠন করে, ৫ জন জাতীয় ও ৫ জন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। এই প্যানেলের কাজ ছিল একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পদ্মা ব্রিজের ডিজাইন রিভিউ করা।
BS 5400 (British Bridge Design Code) কোড উইজ করা হয়েছে ডিজাইন করার জন্য। কারণ এটার লোড এবং অন্যান্য জিনিস বাংলাদেশের ট্রাফিক কন্ডিশনের সাথে মিলে।
ব্রিজ ডিজাইন করার সময় একটা Shipping Study করা হয়। স্টাডিটা এমন যে ব্রিজের নিচে কতটুকু জায়গা থাকলে, বাংলাদেশে চলাচল করে, এমন সব জাহাজ ব্রিজের নিচে দিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে। Bangladesh Inland Waterway Transport Authority (BIWTA) যে রিপোর্ট দেয়, তাতে বলা হয়, বন্যার সময় যে হাইয়েস্ট রেকর্ড উচ্চতা পর্যন্ত পানি উঠেছিল, সেখান থেকে ১৮.৩ মিটার (60 feet) উঁচু হতে হবে অন্তত ৩টা স্প্যানকে। কিন্তু এখানেও ঝামেলা ছিল।
পদ্মা unpredictable নদী। পদ্মা কখনো স্রোতের সাথে তলদেশ থেকে বিশাল পরিমাণ মাটি নিয়ে চলে যায়। আবার কখনো স্রোতের সাথে এসে অনেক পলি জমা হয়। কখনো পাড় ভেঙে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে। দেখা গেল ব্রিজ এক জায়গায় থেকে গেল, নদী ভেঙে পথ পালটে অন্যদিকে চলে গেল। ফলাফল হিসেবে ব্রিজ বানানোটা প্রায় বৃথা গেল। আবার নদীর মাঝে মাঝে হঠাৎ চর জেগে ওঠে। দেখা গেল, জাহাজ যাওয়ার জন্য যে তিনটা স্প্যান ৬০ ফিট উঁচু করে বানানো হল, সেখানে চর জেগে উঠলো, জাহাজ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ অন্য সব স্প্যান এত উঁচু না। তাদের নিচ দিয়ে জাহাজ যাওয়া সম্ভব না।
এজন্য ঠিক কোন জায়গায় আগামী ১০০ বছর (পদ্মা ব্রিজের ডিজাইন লাইফ) পর্যন্ত জাহাজ যাওয়ার মত উঁচুতে স্প্যান দিলে, সেটা টিকে থাকবে, তার নিচে চর জেগে উঠবে না, জাহাজ যেতে পারবে, ব্যাপারটা আন্দাজ করা প্রায় অসম্ভব।
এজন্য পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জাহাজ যাওয়ার মত উঁচু স্প্যান এর সংখ্যা বাড়ানো হবে। নদীর মাঝের মোটামুটি ৪.৮ কিমি জুড়ে সব স্প্যানই যথেষ্ট উঁচু বানানো হবে যাতে এদের যে কোনটার নিচ দিয়েই জাহাজ যেতে পারে।
আবার, পদ্মা নদী একটা ভীষণ খরস্রোতা নদী। তার সাথে নদীর তলদেশে scour(তলদেশের মাটি ধুয়ে যাওয়া) হওয়ার প্রবণতা এবং একইসাথে একটা ভূমিকম্প হওয়ার মত জায়গায় এর অবস্থান হওয়ায়, ব্রিজটার ডিজাইন করার সময় এবং তৈরির সময়ও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন হতে হয়েছে, বা হচ্ছে।
পদ্মা ব্রিজ ডিজাইনের সময় ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এই কাজটা করেছিল বুয়েট। দুই লেভেল এর ভূমিকম্প নিয়ে স্টাডি করা হয়।
১. Operating Level Earthquake : এটা ১০০ বছরে ১ বার হওয়ার সম্ভবনা ৬৫%। এটা ঢাকায় বা দেশে যে টুকটাক ভূমিকম্প হয়, তার চেয়ে ভয়ানক তবে পরের লেভেল এর চেয়ে কম ক্ষতিকর।
২. Contingency Level Earthquake : এই ভূমিকম্প খুবই সিভিয়ার লেভেল এর। এটা ৪৭৫ বছরে একবার আসে। ব্রিজের ১০০ বছর ডিজাইন লাইফে এটা হওয়ার সম্ভবনা ২০%।
এই স্ট্যাডি থেকে suitable /efficient seismic parameters বাছাই করে, সেগুলো দিয়েই ব্রিজ ডিজাইন করা হয়েছে।
এই হল পদ্মা ব্রিজ। পদ্মা বহুমুখী সেতু। এই সেতুর মেইন চ্যালেঞ্জ গুলো হলো:
– নদীশাসনের কাজ
– প্রতি বছর হওয়া বন্যা
– ভূমিকম্পপ্রবণ জায়গায় এর অবস্থান।
– ডিপ পাইল ফাউন্ডেশন।
– নদীর নিচের নরম কাদামাটি।
– extreme scour depth
– যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের পুনর্বাসন।
– প্রোজেক্টের জন্য যেন প্রকৃতির ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।
– জমি অধিগ্রহণ।
– এতগুলো কোম্পানিকে কন্ট্রাক্ট দেয়ার পর, তাদের মাঝে সমন্বয় করা।
– নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা ব্রিজ তৈরি করা।
চ্যালেঞ্জ গুলো দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ উঠেপড়ে লেগে গেছে শুধু একটা ব্রিজ বানাবে বলে! প্রকৃতির সাথে কী নিরন্তর এক যুদ্ধ শুরু করেছে, শুধু একটা ব্রিজের জন্য। এই ব্রিজ আসলে অনেক ত্যাগের, অনেক ভালবাসার। The Bridge of Pride, Padma Multipurpose Bridge!
চলবে…