লেনদেনের কারেন্সি হিসেবে ডলার, নাকি অন্য কোন বিকল্প?

in dollr •  2 years ago 

লেনদেনের কারেন্সি হিসেবে ডলার, নাকি অন্য কোন বিকল্প?

FB_IMG_1663869387808.jpg

আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের মূল্যস্ফীতিকে কমানোর জন্য তিনবার সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, ফলে অন্যান্য দেশের মুদ্রার বদলে ডলার এত বেশি শক্তিশালী হয় যে গত ২০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বারের মত ১ ডলার ১ ইউরো হয়, যাকে ডলার প্যারিটি বলা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে যেসব দেশ ডলারের সাথে সম্পর্কিত, এবং যাদের নিজেদের দেশের সুদের হার কম তাদের মুদ্রার মান অনেক নিচে নেমে যেতে থাকে, যেমন বাংলাদেশ। ফলে সেই সব দেশে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এভাবে নিজেদের দেশের ভালর জন্য ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে অন্যান্য দেশ ভুক্তভোগী হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, ডলার দিয়ে টাকাকে না জুড়ে আমরা রাশিয়ার রুবল বা চীনের ইয়েনের সাথে টাকাকে কেন সম্পর্কিত করছি না। এরপর বাংলাদেশ ডলারের সাথে ভিন্ন কারেন্সি ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত নেয়। এই যেমন রিসেন্ট একটা নিউজ চোখে এলো। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর অথরাইজড ডিলার শাখা চীনের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। তো দেখা যাক ডলারের সুবিধা-অসুবিধা কি, আর ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য কারেন্সিগুলোও কেনা হলে সুবিধা-অসুবিধা কী…

এখানে একটা কথা উল্লেখ করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলার কর্তৃত্ব চালাতে পারে কারণ - (১) এটি আন্তর্জাতিক রিজার্ভের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সব দেশের ফরেইন রিজার্ভ ডলারে থাকে, এটি দিয়ে বাইরের দেশের সাথে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা হয়। (২) দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে ডলারে ঋণ নেয়া হয়। (৩) বিশ্বের বড় বড় অনেক দেশ নিজেদেরকে ডলারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ডলারের সাথে সম্পর্কিত করেছে।

যাই হোক, ডলারের সমস্যাগুলো হলো -

(১) ডলারে একটা সিস্টেমেটিক রিস্ক আছে, যেমন ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার মত পরিস্থিতিতে ডলারের অবস্থা বাজে হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে যারা ইতিমধ্যে ইউএস এর থেকে লোন নিয়েছে তাদেরকে সেটা শোধ করার জন্য প্রাইস ইনস্ট্যাবিলিটির দিক থেকে তাকে পরিবর্তিত করতে হয়, যা অনেক সময় অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে ইউএস এর অর্থনীতি পড়ে গেলে তার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য দেশের অর্থনীতিও পড়ে যেতে পারে।

(২) রেইট হাইট ম্যানেজমেন্টের সমস্যা, ইউএস ডলারের রেইট হঠাৎ অনেক উপরে উঠিয়ে দিলে বাইরের দেশের সমস্যা হয়, আমদানি বা রপ্তানিনির্ভরদেশগুলো সে অনুযায়ী দেশগুলো নিজেদের সুবিধা-অসুবিধা অনুযায়ী নিজেদের দেশের মুদ্রার মূল্য ওঠানামা করায়, কিন্তু কিন্তু ইউএস এর সরকার নিজেদের ডলারের মূল্য ওঠানামা করালে তখন অন্য দেশ কিছু না করলেও তাদের দেশের মুদ্রার মূল্য ওঠানামা করবে, হঠাৎ করে টাকার মান কমে যায়। এসব ক্ষেত্রে ভাল পলিসি ও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের সমস্যা না হলেও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, স্বার্থপর বা জনতাকে গ্রাহ্য না করা সরকারের দেশগুলোর সমস্যা হয়। ইউএস-এ ডলারের রেইট বৃদ্ধির ফলে নিজেদের ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত যেসব দেশে সুদের হার কম সেসব দেশ সমস্যায় পড়ে। মানুষ কম সুদের হারের দেশ থেকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদের হারের দেশে বিনিয়োগ করে আর সেখানকার লাভ দিয়ে কম সুদের হারের দেশ থেকে নেয়া ঋণ পরিষোধ করে বেশি লাভবান হয়, কিন্তু এর ফলে অর্থ কম সুদের হারের দেশ থেকে বেশি সুদের হারের দেশে চলে যায়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মত দেশগুলো থেকে ডলার যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে, সেই সাথে সেই দেশগুলোর ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর অনেক চাপ পড়ে, এর ফলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা যেমন আইএমএফ, ওয়ার্ল্ডব্যাংক এর কাছে ঋণও নিতে হতে পারে। এসব কারণে ডলার খারাপ। এর বিকল্প হলো বাস্কেট অফ কারেন্সি বা কারেন্সি ককটেইল, যেখানে অর্থনৈতিক বিভিন্ন স্থিতিশীল রাষ্ট্রের মুদ্রা যেমন রুবল, ইয়েন ইত্যাদি থাকবে ও এদের একটি সমন্বয় থাকবে।

এগুলোর বিরুদ্ধে ডলারের পক্ষেও যুক্তি আছে -

(১) বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণ কেবল ইউএস এর ডলারের রেইট বৃদ্ধির কারণে নয়, এর সাথে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর আছে - (ক) কোভিড ১৯, (খ) রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ; তাই ঢালাওভাবে ডলারকে দোষ দেয়া যাবে না।

(২) পৃথিবীর সকল মুদ্রার মধ্যে ডলারের সাথে টাকাকে সম্পর্কিত করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ -

(ক) ইউএস এর অর্থনীতি অনেক বড়, এদের প্রাইমারি সেক্টরে তেল, সেকেন্ডারি সেক্টরে মেশিনারি, আর টারশিয়ারি সেক্টরে নানান রকমের সার্ভিস আছে, ফলে এদের অর্থনীতি অনেক বেশি ডাইভার্সিফাইড বা বৈচিত্র্যময়, ফলে এদের অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল।

(খ) দেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি অনেক ভাল, বড় দুই দলই জনগণের কাছে ভাল জবাবদিহি করে, এদের ব্যবস্থা অনেকটা স্বাধীন, এদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৮ সালের মন্দাও ভাল করে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল।

(গ) ইউএস ডলারের দাম সম্পর্কে খুব ভাল পূর্বাভাস দেয়া যায়, কারণ দেশটি তাদের সব অর্থনৈতিক কার্যকলাপই প্রকাশ করে দেয়, অন্যদিকে চীন বা রাশিয়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রধানরা কোন সময় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে বা তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কেমন হচ্ছে তা জানা যায়না, ফলে এদের মুদ্রার গতিবিধিকেও পূর্বাভাস দেয়া যায়না, সেই সাথে তারা গণতান্ত্রিক না হওয়ায় (রাশিয়ার ক্ষেত্রেও) বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার দুর্বল ও আত্মকেন্দ্রিক হয় ও সবার আগে নিজেদের লাভকে আগে দেখে, এসবের ফলে এইসব দেশের মুদ্রাকে ভরসা করা যায়না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক হলেও তাদের সীমাবদ্ধতা আছে, এরা গ্রীস ও ইতালীর অর্থনীতি সামলাতে পারেনি, ব্রেক্সিটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য বের হয়ে যায়, তাই এদের মুদ্রাকেও ভরসা করা যায়না।

(৩) ডলারকে রেগুলেট বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২০০৮ সালের পর ডলারকে খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়েছে, উদাহরণ হিসেবে ডড-ফ্র্যাংক অ্যাক্ট বা বড় করে Dodd–Frank Wall Street Reform and Consumer Protection Act এর কথা বলা যায়। এটা ওয়াল স্ট্রিটের একটি রিফর্ম ও কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট। এই আইনের মাধ্যমে দেশটিতে বিভিন্ন রেগুলেটরি এজেন্সিকে শক্তিশালী করা, সিস্টেমিক রিস্ক নজরদারির জন্য সংস্থা তৈরি, ফাইনানশিয়াল মার্কেটে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, ডেরিভেটিভগুলোতে স্বচ্ছতা বাড়ানো, নতুন কনজিউমার প্রোটেকশন এজেন্সি তৈরির মত বিভিন্নভাবে ডলারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, যাতে ২০০৮ সালের মত মন্দার ঘটনাকে এড়ানো যায়।

(৪) এদিকে ডলারের বিকল্প হিসেবে বাস্কেট অফ কারেন্সিকে গ্রহণ করলেও সমস্যা আছে, এর ফলে একেক দেশ একেক রকম কারেন্সিতে লেনদেন করতে চাইবে, সেক্ষেত্রে লেনদেনের সময় অতিরিক্ত স্তর অতিক্রম করতে হবে, ধরুন টাকাকে রুবল, পরে রুবলকে ইয়েন, এরপর ইয়েনকে অন্য কোন মুদ্রায় নিতে হবে, আর এভাবে অতিরিক্ত স্তরগুলো বাণিজ্যে চাপ ফেলবে।

কিন্তু ডলার বেশি নিরাপদ ও স্থিতিশীল বলেই এর থেকে আসা ঝুঁকিগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যায়না। অন্যান্য কিছু যুক্তিও আছে, যেমন -

(১) ইউএস এর অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলেও তাদের স্বার্থ আর অন্যান্য দেশের স্বার্থ নাও মিলতে পারে। কোন দেশ মুদ্রার মান কমিয়ে দিলে রপ্তানীর ক্ষেত্রে সেই দেশ ডলার বেশি পায় ও লাভবান হয়। রপ্তানিনির্ভর দেশগুলো সীমিত পরিসরে এটাই করে। কিন্তু ইউএস নিজেরাও ডলারের দাম বাড়িয়ে দিলে ওই দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে তাদের নিজস্ব মুদ্রা অনেক বেড়ে যায়, ফলে সেই দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, তখন আর তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার থাকেনা।

(২) চীন ও রাশিয়া বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে অনেক উদারতা দেখিয়েছে, এমনকি রাশিয়া কয়েকদিন আগে গর্ব করে বলেছে তাদের ইকোনমি কয়েক হাজার নিষেধাজ্ঞাতেও টিকে থাকতে পারে। সেই সাথে ঋণ দেবার ক্ষেত্রেও আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চেয়ে তারা উদার ছিল, ফলে বাংলাদেশের মত দেশগুলো সহজেই চীন-রাশিয়ার ঋণ পায়, এমনকি পদ্মা সেতুর রেইল লিংক প্রোজেক্টের কাজে ৮০-৮৫% ঋণ চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে আসছে।

(৩) সবচেয়ে বড় পয়েন্ট যেটা - এখন ইউএস এর প্রতিযোগী হিসেবে কাউকে না কাউকে দাঁড় করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, কারণ ইউএস যদি একচেটিয়াভাবে তাদের ডলারকে রাজত্ব করতে দেখে তাহলে তারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তকে যেকোন দিন অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তাই ইউএস ও ডলারের বিরুদ্ধেও কাউকে দাঁড় করানো উচিৎ। বিষয়টা নিউক্লিয়ার উইপনের মত। সবার হাতে নিউক্লিয়ার উইপন দিয়ে দিলে গেইম থিওরি অনুসারে কেউ কাউকে আর আক্রমণ করার সুযোগ পাবে না, কারণ সে কাউকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে গেলে তাকেও অপরপক্ষ ধ্বংস করে দেবে। ব্রেটন উড সিস্টেমের ফলে ডলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়, আর তার ফলে দেখা যায় -

(ক) সব দেশই ইউএস এর সাথে বাণিজ্য করতে বা ইউএস ডলার ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করতে চায়, কারণ তাহলে তাদের রিজার্ভের অনেক উন্নতি হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশও সবচেয়ে বেশি ইউএস-এ (৬.১৯ বিলিয়ন ডলার), তারপর জার্মানি, তারপর যুক্তরাজ্য, তারপর ফ্রান্স ও তারপর স্পেইনে (২.২৯ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানী করেছিল। সবই ডলারে বাণিজ্য করা উন্নত দেশ, আর বৃহত্তম রপ্তানীর দেশটি ইউএস স্বয়ং।

(খ) অনেক উন্নয়নশীল দেশ নিজেদের মানব সম্পদকে ইউএস এর মত দেশে পাঠাতে চায় যাতে তারা অনেক বেশি ডলার তাদের দেশে পাঠায় ও রেমিটেন্স বাড়ে। ফলে দেশগুলর জনশক্তি ইউএস এর মত দেশগুলোতে চলে যায়, যারা সেই দেশগুলোর কাজে লাগত তারা সেই সব ডলার দিয়ে বাণিজ্য করা দেশগুলোতে চলে যায়, যাকে ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার বলা হয়। ফলে দেখা যায় দেশে ইন্ডাস্ট্রি চালাবার মত ইঞ্জিনিয়ার নেই, ওয়েল্ডিং এর কাজ জানা দক্ষ শ্রমিক নেই, ফলে এরা পরবর্তীতে অর্থনীতিতে তেমন উন্নতি করতে পারেনা।

আর এভাবেই ডলার ও ইউএস খুব সহজেই বিশ্বে নিজের কর্তৃত্ব তৈরি করে, আর নিজেদের সিদ্ধান্তকে ইচ্ছামত চাপিয়ে দেবার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব কারণে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ডলারের প্রতিপক্ষ হিসেবে এর প্রতিযোগী হিসেবে কোন মুদ্রাকে দাঁড় করানো উচিৎ বলে চিন্তা করা হয়।

আশা করি, লেখাটি ডলার আর অন্যান্য বিকল্প কারেন্সির মধ্যে কোনটা ভাল হবে, সেই বিষয়ে আপনার নির্দিষ্ট অবস্থান নেবার ক্ষেত্রে “সাহায্য” করবে…

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!