লাইফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে- HSC আর ভর্তি পরীক্ষার মাঝের চার-পাঁচ মাস। এই কয়েকটা দিন টার্গেট ঠিক রেখে অমানবিক পরিশ্রম করে কেউ কেউ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ হালকা ঢিলামি বা ভুল পথে গিয়ে স্বপ্ন চুরমার করে খালি হাতে বাড়ি ফিরে। তবে আর্টস কমার্সের তুলনায় সায়েন্সের স্টুডেন্টদের অপশন বেশি থাকায়, তাদের দোটানায় পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
প্রশ্ন-১: আমি সায়েন্সের আমার কি ইঞ্জিনিয়ার, মেডিকেল না ক-ইউনিটের কোচিং করা উচিত?
উত্তর: HSC এর পরে সায়েন্সের স্টুডেন্টদের জন্য ছয়টা রাস্তা খোলা আছে।
রাস্তা-১: ইঞ্জিনিয়ারিং
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলে তোমাকে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এবং ম্যাথে ভালো হতে হবে। এই সাবজেক্টগুলার পুরা বই না হলেও বইয়ের বেশিরভাগ অধ্যায় সম্পর্কে ভালো আইডিয়া থাকতে হবে। আবার ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথের এর মধ্যে যেকোন দুইটা সাবজেক্টে ভালো আর একটাতে মোটামুটি হলেও চলবে। বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং বা আর্কিটেকচার পড়তে চাইলে তোমার ফার্স্ট টার্গেট হবে বুয়েট। তাই তোমার একমাত্র টার্গেট হবে বুয়েট। সেটা না হলে কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, শাহজালাল কিংবা টেক্সটাইলের কথা পরে চিন্তা করা যাবে। আর বাপ-মায়ের কাড়ি কাড়ি টাকা না থাকলে, শুরুতেই প্রাইভেট ভার্সিটির কথা মাথায় আনার দরকার নাই।
রাস্তা-২: মেডিকেল
মেডিকেল বা ডাক্তারি পড়তে গেলে তোমাকে বায়োলজিতে অনেক ভালো হতে হবে এবং ভালো লাগতে হবে। সরকারী মেডিকেলে সীট লিমিটেড হওয়ায় কম্পিটিশন অনেক বেশি। সেই কম্পিটিশনে টিকে থাকলে হলে, পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আর বাপের জমি, মায়ের গহনা বিক্রি করে প্রাইভেট মেডিকেলের কথা চিন্তা করার আগে সুযোগ থাকতে চেষ্টা করে দেখো।
রাস্তা-৩: সায়েন্সের সাবজেক্টে অনার্স-মাস্টার্স
অনেকের স্পেশাল টার্গেট থাকে- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি। সেক্ষেত্রে তাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর ক-ইউনিট এর জন্য প্রিপারেশন নিতে হবে। তবে এসব ছাড়াও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সায়েন্সের আরো অনেক সাবজেক্ট আছে সেগুলারও ভালো ডিমান্ড আছে। তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর ক-ইউনিট এর জন্য প্রিপারেশন নিলে সেই একই প্রিপারেশন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, খুলনা, চিটাগাং ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দিতে পারবা। তবে টার্গেট করতে হবে- যে করেই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবোই পাবো।
রাস্তা-৪: আর্টস-কমার্সে ট্রান্সফার হয়ে তাদের ভাত মারা
ঘ-ইউনিট বলে একটা জিনিস আছে। তবে আর্টস বা কমার্সের কোন সাবজেক্টের প্রতি স্পেশাল টার্গেট না থাকলে শুরুতে ক-ইউনিট এর জন্য চেষ্টা করো।
রাস্তা- ৫: ফেল করে আবার HSC পরীক্ষা: এদের জন্য এক মিনিট নীরবতা।
রাস্তা-৬: BMA লং কোর্স বা ISSB দিয়ে সেনাবাহিনী: ফিজিক্যাল ফিটনেস আর টার্গেট থাকলে চান্স নিয়ে দেখো।
তবে কোন রাস্তায় গেলে ভালো হবে সেটা জিজ্ঞেস করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করো- “কোন লাইনে যাওয়ার চেষ্টা করার ইচ্ছা এবং চান্স পাওয়ার যোগ্যতা তৈরি করার ক্ষমতা আমার আছে?”। যোগ্যতা নিয়ে চেষ্টা না করলে কিন্তু তোমার যোগ্যতার চার আনা পয়সা দাম থাকবে না। এমন অনেক ট্যালেন্টেড পোলাপান দেখছি- একটুর জন্য অনেক পিছনে চলে গেছে। আর HSC পরীক্ষার পরেই বেশিরভাগ পোলাপান ফ্যামিলি থেকে ফ্রিডম পায়। অনেকেই ঢাকায় প্রথম আসে। এই সময়গুলাতে নিজেকে কন্ট্রোল করা খুবই টাফ। তাছাড়া দুইটা ঈদ, রেজাল্টের বন্ধে টেরও পাবা না কেমনে টাইম শেষ হয়ে ভর্তি পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিছে।
প্রশ্ন-২: প্রতিদিন কয় ঘন্টা করে পড়া উচিত?
উত্তর: আমি বলি ১৮-২০ ঘন্টা। তারমানে যতক্ষণ ঘুমাবা না ততক্ষণ পড়বা। তবে কোন ভাবেই ১২-১৪ ঘন্টার কম পড়লে হবে না। খাওয়া, চুল কাটা, বাজার, বাসে করে কোচিং যাওয়ার সময় হাতে নোটখাতা খুলে রাখবা। গোসল বাথরুম করার সময় মাথায় চিন্তা করে করে পড়া রিভাইজ দিবা। ল্যাপটপ, ফেইসবুক, ফ্রেন্ডশিপ, বার্থডে, মোবাইল ফোনের কল রিসিভ- সব বন্ধ। মেধার ঘাটতি পরিশ্রম দিয়ে পুষিয়ে দেয়া যায়। আজকের একটু আরাম বাকি জীবনের জন্য ব্যারাম হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন-৩: কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলে ভালো হবে?
উত্তর: শুনো, ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে পারলেই যে তুমি চান্স পেয়ে যাবা তা কিন্তু না। কোচিং সেন্টার তোমারে ভার্সিটিতে ঢুকায় দিবে না, তোমার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দিবে না। তোমার পরীক্ষা তোমাকেই দিতে হবে। কোচিং সেন্টারের কাজ হচ্ছে তোমাকে রুটিনের মধ্যে রাখা, চ্যাপ্টার বাই চ্যাপ্টার পরীক্ষা নিয়ে তোমাকে পড়ার জন্য তাগাদা দেয়া। আরো কিছু ভালো স্টুডেন্ট একসাথে করে তোমার ভিতরে কম্পিটিটিভনেস তৈরি করতে সাহায্য করা, কিছু টিপস দেয়া। তাই অন্য ভালো স্টুডেন্টরা যেখানে ভর্তি হয় তুমিও সেখানে ভর্তি হও। সেখানে ভালো করার চেষ্টা করো। তাতে কনফিডেন্স বাড়বে। তবে কোচিং সেন্টারে খারাপ করলেও প্রিপারেশন চালিয়ে যেতে হবে। কারণ ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার সময়, ভার্সিটির লোকজন কোচিং সেন্টারে এসে খোজ নিবে না, কোচিং এ কে ভালো কে খারাপ ছিলো।
প্রশ্ন-৪: মোট কয়টা বই থেকে পড়া উচিত?
উত্তর: একটা বই খুব ভালো করে পড়তে হবে। যেটা তোমার কলেজের পাঠ্য বই ছিলো। এর পাশাপাশি, আরেকটা বইয়ের উদাহরণ সমস্যাগুলা দেখতে পারো।
প্রশ্ন-৫: কোচিং এর সেরা টিচাররা আবার ব্যাচেও পড়ায়। আমার কি সব সাবজেক্টে ব্যাচে পড়া উচিত?
উত্তর: আমার মতে ব্যাচে পড়ে তেমন লাভ হয় না। বরং ব্যাচে যাওয়া আসা করার জন্য সময় নষ্ট না করে। নিজে নিজে বাসায় পড়ো। সেটা কাজে লাগবে। কিছু বুঝতে না পারলে কোচিং এর ভাইয়াদের প্রশ্ন করো।
প্রশ্ন-৬: কোচিং এর লেকচার শিট অনেক কঠিন। এগুলা আবার অনেকসময় ভর্তি পরীক্ষাতেও আসছে। আমি এগুলার কিচ্ছু বুঝি না। আমার কি হবে ভাইয়া?
উত্তর: শুনো, যে ফার্স্ট হয় সেও ১০০ তে ১০০ পায় না। তুমিও পাবা না। আর ভালো সাবজেক্টে চান্স পাওয়ার জন্য তোমার সব পারা লাগবে না। সো, কোচিং এর লেকচার শিটের ৭০-৮০% বুঝলেই হবে। ওদের গাইড বই দেখেও বিভ্রান্ত হয়ো না। বরং বইয়ের উপর জোর দাও। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন বই থেকে আসবে, কোচিং এর লেকচার শিট বা গাইড থেকে আসবে না।
প্রশ্ন-৭: কোচিং এর টেস্টে নম্বর তেমন পাই না। মেরিট লিষ্টে আমার নাম উঠে না। আমার কি ছেড়ে দেয়া উচিত?
উত্তর: কোচিং এর মেরিট লিষ্টের অনেক পোলাপান আছে যারা শেষ পর্যন্ত চান্সই পাবে না। সো, সেখানে নম্বর না পাইলেও, চেষ্টা চালাতে থাকবা। পরীক্ষা দিতে থাকবা। আসল প্রিপারেশন হচ্ছে তোমার বাসায়।
প্রশ্ন-৮: কোচিং এর ভালো ভালো টিচারগুলো সব ঢাকায়। আমার কি যে করেই হোক ঢাকায় কোচিং করতে চলে যাওয়া উচিত?
উত্তর: ঢাকায় যেতে পারলে ভালো। তবে ঢাকায় গিয়ে অনেকেই ছাড়া পেয়ে পড়ালেখা কমিয়ে দেয়। প্রতিবছর শত শত পোলাপান ঢাকার বাইরে কোচিং করে চান্স পায়। আসল কাজ হচ্ছে পড়ালেখা করা। আগের বছরগুলার প্রশ্ন সলভ করা। সেটা চালিয়ে যাও।
প্রশ্ন-৯: আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ার সখ। আব্বু জোর করে মেডিকেলের কোচিং এ ভর্তি করায় দিছে। এখন আমি ঠিকমতো পড়ায় মন দিতে পারতেছি না। কি করবো?
উত্তর: শুনো, লাইফটা তোমার। মাঝখানে ঝুলে থাকলে তোমারই ক্ষতি। তাই আব্বুর সাথে ডাইরেক্ট কথা বলতে না পারলে মেডিকেলের ভর্তি কোচিং সিরিয়াসভাবে করো। আর না হলে, তোমার আম্মু বা কাউকে দিয়ে তোমার আব্বুকে বুঝিয়ে বলো।
প্রশ্ন-১০: আমাদের কলেজে সেকেন্ড পার্টের অনেক চ্যাপ্টার বাদ দিয়ে গেছে। সেগুলা একদমই ধরা হয়নি। ওইসব চ্যাপ্টার কি নতুন করে সব পড়তে হবে?
উত্তর: সব পড়তে পারলে ভালো। কোচিং এ সেই সব লেকচারের সময় মনোযোগ দিয়ে পড়বা। দরকার হলে একই লেকচার দুই ব্যাচের সাথে ক্লাস করবা। তাইলে অনেকটা কভার হয়ে যাবে। আর যেগুলা বাদ দিছিলো সেখান থেকে অর্ধেকের বেশি নিজে নিজে পড়ে ঠিক করে ফেলবা। আর দুই-একটা চ্যাপ্টার বাকি থাকলে বিশেষ সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন-১১: বুয়েট + বায়োলজি, ক + ঘ একসাথে দুইটার প্রিপারেশন হয়ে যাবে। আপনি কি বলেন?
উত্তর: যদিও একটা মাত্র এক্সট্রা সাবজেক্ট, তারপরেও সেটার ক্লাস বা পরীক্ষা দিতে গেলে তোমার চিন্তা ভাবনায় একটু আধটু চেইঞ্জ আসবে। যেটা বেশিরভাগ পোলাপান সঠিকভাবে হ্যান্ডেল না করে, কনফিউজড হয়ে যায়। আবার কোনটাতে প্রায়োরিটি দিবে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে সময় নষ্ট করে। তাই আমার পরামর্শ হচ্ছে -দুই নৌকায় পা দেওয়ার দরকার নাই। একটা টার্গেট সেট করো। সেটার জন্য সর্বস্ব নিয়ে জাপিয়ে পড়ো।
প্রশ্ন-১২: কোন লাইনে গেলে চাকরি/বিজনেস করার সুবিধা পাওয়া যাবে?
উত্তর: সব লাইনেই চাকরি/বিজনেস/টাকা আছে। আবার সব লাইনেই কেউ না কেউ চাকরি পেতে খবর হয় যায়। আসলে ভালো চাকরি বা বিজনেস অন্য অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এবং সেটা অনেক অনেক পরের বিষয়। তাই আপাতত তোমার সামনে আছে ভর্তি পরীক্ষা। সেটার কথা চিন্তা করে এগুতে থাকো। বাকি সব আপাতত চুলো