ভারতবর্ষে মুঘল রাজবংশের সূচনা

in hive-107931 •  3 years ago 

মুঘল রাজবংশের সূচনা (১৫২৬–১৭০৭)

ভারতবর্ষে মুঘল রাজবংশের সূচনা ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৫২৬ খ্রি. জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বংশ কয়েক শতাব্দী ধরে শাসন পরিচালনা করে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ছিলেন পিতার দিক থেকে চেঙ্গিস খান এবং মাতার দিক হতে তৈমুর লঙ এর বংশধর। মুঘল বংশ প্রাথমিকভাবে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও শক্তি নিয়ে ১৫২৬–১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে শাসন পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংলার স্বাধীনতা হারালে পরবর্তী ১০০ বছর ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুঘল শাসকগণ নামমাত্র শাসক হিসেবে পরিণত হয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অবসানের আগ পর্যন্ত মুঘল বংশই ছিল ভারতে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং শক্তি ও সংহতির উৎস। এই বংশের অবসানের সাথে সাথে তা বিলীন হয়ে যায়।


image.png

জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর (১৫২৬–১৫৩০ খ্রি.)

জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবর ফার্সি শব্দ, এর অর্থ বাঘ। তার জন্ম বর্তমান রুশ-তুর্কিস্থানের অন্তর্গত ফারগানায়। তিনি পিতার দিক থেকে তৈমুর লং এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর। সাহসিকতা ও নির্ভীকতার জন্য তিনি ইতিহাসে বাবর নামে পরিচিতি লাভ করেন। বাবরের আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘তুযুক–ই–বাবর (বাবরনামা)’। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাবরই আত্মজীবনী রচনা করেন। তিনি ২৬ ডিসেম্বর, ১৫৩০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে আফগানিস্তানের কাবুলে সমাহিত করা হয়। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর। এটি ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত। বাবরি মসজিদের নির্মাণকাল ১৫২৮-১৫২৯ খ্রি.১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্রবাদী হিন্দুগোষ্ঠী কর্তৃক মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে দেশজুড়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় এবং অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত রায়ে ২.৭৭ একর বা ১.১২ হেক্টর ভূমি সমানভাবে ভাগ করে দিলে হিন্দু সম্প্রদায় পায় তিন ভাগের দুই ভাগ এবং মুসলমান সম্প্রদায় পায় তিন ভাগের এক ভাগ। এর বিরুদ্ধে উভয় পক্ষই উচ্চ আদালতে আপিল করে। ৯ নভেম্বর, ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায়কে রদ করে ঘোষণা দেয় ২.৭৭ একরের পুরো জমিই হিন্দু মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত হবে। একই সাথে আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় যে, বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে মসজিদ নির্মাণের জন্য এবং সে জমি অযোধ্যায়ই হতে হবে।

নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন (১৫৩০–১৫৫৬)

নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন ছিলেন বাবর এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট। তিনি বাংলার নাম রাখেন জান্নাতাবাদ। সম্রাট হুমায়ুনের শাসনামলে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে শের খানের ক্রমাগত ক্ষমতা বৃদ্ধিতে দিল্লি মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অত্যধিক শংকিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি গুজরাটে বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান। প্রত্যাহার করেন এবং শের খানকে দমন করার উদ্দেশ্যে বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন। তবে তিনি বাংলার পরিবর্তে চুনার দুর্গ আক্রমণ করে দখল করে নেন। অতঃপর ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড়ও দখল করেন। শের খান ছিলেন সামরিক প্রতিভা সম্পন্ন একজন দূরদর্শী যোদ্ধা। তাই তিনি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোনো সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হননি। বরং হুমায়ুন যখন গৌড় দখল করে সেখানে অবস্থান করছিলেন তখন শের খান পশ্চাদপসরণ করে বিহার ও জৌনপুরের মুঘল অধিকৃত অঞ্চল দখল করে কনৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। তিনি দিল্লির সাথে বাংলার যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এতে হুমায়ুন আতংকিত হয়ে পড়েন এবং আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। সমর কুশলী শের খান বক্সারের নিকট চৌসা নামক স্থানে মুঘল বাদশাহ হুমায়ুনের গতিরোধ করেন। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত হন এবং তিনি অতি কষ্টে আগ্রা ফিরে আসেন। শের খান বাংলা, বিহার, জৌনপুরের একচ্ছত্র অধিপতি হন এবং ‘শেরশাহ’ উপাধি ধারণ করেন। হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধের গ্লানি ও ব্যর্থতা সহ্য করতে না পেরে পুনরায় কনৌজের পথে অগ্রসর হন। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে কনৌজের অদূরে বিলগ্রামে উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে হুমায়ুন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। শেরশাহ কনৌজ, দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন। এভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে দিল্লি সিংহাসনে শেরশাহের অভ্যুত্থান ঘটে। হুমায়ুন পুনরায় দিল্লি দখল করেন ১৫৫৫ সালে। এ সময় দিল্লি দখলে হুমায়ুনকে সাহায্য করেন পারস্য সম্রাট১৫৫৬ সালে দিল্লীর অদূরে নির্মিত দীন পানাহ দুর্গের পাঠাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়ে পরে মৃত্যুবরণ করেন।

শূর শাসন (১৫৪০-১৫৫৫)

শূর শাসনের সূত্রপাত করেন আফগান শাসক শেরশাহ। শেরশাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ। তার উপাধি হচ্ছে ইসলাম শাহজালাল খাঁ ৯ বছর রাজত্ব করেছিলেন। শূর শাসনের শ্রেষ্ঠ শাসক শেরশাহ রাজত্ব করেন (১৫৪০-১৫৪৫) । ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন সিকন্দর শাহকে পরাজিত করলে শূর শাসনের অবসান ঘটে।

শেরশাহ (১৫৪০-১৫৪৫)

শেরশাহ এর প্রকৃত নাম ফরিদ খান। তবে ইতিহাসে তিনি শের খান নামে পরিচিত। শেরশাহ চাকরি করতেন বাবরের অধীনে। শেরশাহের কীর্তি ঘোড়ার ডাকের প্রচলন (ডাক ব্যবস্থা বা সংবাদ বাহন), মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার, 'দাম' নামক রুপার মুদ্রার প্রচলন, সোনারগাঁও হতে লাহোর পর্যন্ত (৪৮৩০ কি. মি) ‘সড়ক–ই–আজম’/গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের' নির্মাতা, কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রথার প্রবর্তক।

জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)

জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাজপুত কন্যা যোধাবাঈকে বিবাহ করেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করে। সম্রাট আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৬ সালে। সম্রাট আকবরের সময়ে সমগ্র বঙ্গ দেশ ‘সুবহ-ই-বাঙ্গালাহ' নামে পরিচিত ছিল। তিনি ‘মনসবদারি প্রথার প্রচলন করেন। তার সময়ে আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি **বুলন্দ দরওয়াজ ও স্বর্ণমন্দির **এর নির্মাতা ছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলায় বার ভূঁইয়াদের উত্থান ঘটে। সম্রাট আকবর রাজপুত ও হিন্দুদের বন্ধুত্ব অর্জন করার জন্য ‘তীর্থকর’ ও ‘জিজিয়া কর’ রহিত করেন। অমুসলমানদের উপর ধার্য সামরিক করকে ‘জিজিয়া কর’ বলে১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে সকল ধর্মের সার সম্বলিত ‘দীন-ই-ইলাহী' নামক নতুন একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রবর্তন করেন। কিন্তু ধর্মমতটি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। মাত্র ১৮ জন লোক এই ধর্মমত গ্রহণ করেছিল। ১৬শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৫৫৬ সাল) মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে এবং বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি হয় এবং বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ চালু করার নীতি প্রচলন হয়। সম্রাটের রাজসভার সদস্যদের মধ্যে আবুল ফজল, ফৈজী, টোডরমল, বীরবল, মানসিংহ প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজস্ব মন্ত্রী টোডরমল রাজস্ব ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। টোডরমল এদেশের সরকারি কলেজে ফারসি ভাষাচালু করেন। ফারসির অনুকরণে দেশের গজল ও সুফী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। আকবরের রাজসভার গায়ক ছিলেন তানসেন (প্রকৃত নাম রামতনু পাণ্ডে) তিনি সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন বলে তাকে বুলবুল-ই-হিন্দ উপাধি দেওয়া হয়। স্থাপত্য শিল্পেও সম্রাট আকবরের অবদান অনস্বীকার্য। ফতেহপুর সিক্রি নগরীর পত্তন এবং আগ্রার দুর্গ আকবরের অমর কীর্তি১৬০৫ সালে সম্রাট আকবর মৃত্যুবরণ করেন। আগ্রার সেকেন্দ্রায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!