আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বর্তমানে যে বিশ্বব্যবস্থা বিদ্যমান সেটি মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী আদিম সাম্যবাদী সমাজ হতে সৃষ্ট নগর রাষ্ট্র যা আজকের আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে। কখনও আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত ও যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছে; যেমন- ১ম বিশ্বযুদ্ধ, ২য় বিশ্বযুদ্ধ অবসম্ভাবী। তাই আমরা বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাচ্ছি, যেমন- মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীন-রাশিয়া-উ. কোরিয়ার এবং স্নায়ু যুদ্ধ। বিশ্ব ব্যবস্থা তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন ইমানুয়েল মরিস ওয়ালারস্টিন। তাঁর মতে, প্রতি ৫০ বছরে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন ছুঁড়ে দেওয়া নতুন চ্যালেঞ্জ।
মেরুকরণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্ব ব্যবস্থায় ৩ ধরনের মেরুকরণ লক্ষ করা যায়। যেমন:
১. বহুমেরু কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা: এ ব্যবস্থার বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের হাতে ভৌগোলিক অবস্থানগত, সামরিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। বিশ্বের বহুদেশ আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল বলে এ সময়কালকে বহুমেরুকেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা বলা হয়। সাধারণত ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বের সময়কে বহুমেরু বিশ্ব বলা হয়।
২. দ্বি-মেরু কেন্দ্রীক বিশ্ব ব্যবস্থা: ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর USA এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মধ্যে যে আদর্শের দ্বন্দ্ব শুরু হয় তা ১৯৯১ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এ সময়কালকে দ্বি-মেরু কেন্দ্রীক বিশ্ব বলে।
৩. এক মেরু বিশ্ব ব্যবস্থা: ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বে USA এর এসব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। এটি একমেরু বিশ্ব নামে পরিচিত।
উপনিবেশবাদ হলো অন্য দেশকে উপনিবেশ হিসেবে রাখার মতবাদ। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণকারীদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য উপনিবেশ স্থাপনকৃত দেশের ভূমি, শ্রম, কাঁচামাল ও বাজার দখল করার জন্য যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করে তাই উপনিবেশবাদ। উপনিবেশ সৃষ্টির চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদ তৈরি হয়। পশ্চিম ইউরোপীয় উপনিবেশিকতাবাদের প্রথম দিকের শিকার হয়েছিল অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ। যেমন – প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে আয়ারল্যান্ড যে দেশটির প্রথম উপনিবেশ হয়েছিল তা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হয়েছে। পরবর্তীতে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও জাপানের সাম্রাজ্যবাদী হাত প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর উপর। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে শুধু কাঁচামাল ও শ্রমের উৎস থাকেনি, একই সাথে পরিণত হয়েছে এদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় বিশ্বে পণ্যসামগ্রী ছাড়াও পুঁজি রপ্তানি ও বিনিয়োগের পরও এসব দরিদ্র রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন বন্ধ হয়নি বরং অবাধ লুণ্ঠন বৃদ্ধি পেয়েছে, এগুলো হচ্ছে উপনিবেশিকতাবাদের নতুন কৌশল। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে উপনিবেশ শাসনাক্রান্ত জাতিগুলো যখন একে একে উপনিবেশের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে শুরু করল, তা হলো কেবল ভৌগোলিকভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি। কিন্তু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুক্তি বা প্রকৃত মুক্তি আসেনি। IMF বা World Bank এর মতো অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে পরোক্ষভাবে ও উপনিবেশবাদকে বজায় রাখার জন্য। তাই প্রখ্যাত মার্কিন চিন্তাবিদ ও নীতি বিশ্লেষক মাইকেল প্যারেন্টি বলেন, “এখন উপনিবেশ স্থাপনকারী বা সাম্রাজ্যের নাম দেয়া হয় কমনওয়েলথ এবং উপনিবেশগুলোর নাম দাঁড়ায় ‘টেরিটোরি বা ডোমিনিয়ন’।”
বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ
উপনিবেশক দেশ
ব্রিটেন:আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ইরান, ইরাক, সৌদিআরব, জর্ডান, ইসরাইল, ওমান, কুয়েত কাতার, বাহরাইন, ইয়েমেন, সাইপ্রাস, মাল্টা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর, তিউনেশিয়া, ঘানা, নাইজেরিয়া, সিয়েরালিয়ন, তানজানিয়া, টোগো, কেনিয়া, মালাবি, গাম্বিয়া, লেসেথো, জিম্বাবুয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জ্যামাইকা, বাহামা।
ফ্রান্স:ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, লেবানন, সিরিয়া, মরক্কো, গ্যাবন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, আইভরিকোস্ট, উগান্ডা, শাদ, বারকিনা ফাসো, সেনেগাল, মালি, বেনিন প্রজাতন্ত্র, ক্যামেরুন, নাইজার, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জাম্বিয়া, আলজেরিয়া, জিবুতি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন:কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, পোল্যান্ড, লাটভিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান, মলদোভা, আর্মেনিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ
সুইডেন:নরওয়ে, ফিনল্যান্ড।
নব্য উপনিবেশবাদ প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ হতে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব বজায় রাখার প্রচেষ্টার নাম হলো নব্য উপনিবেশবাদ বা Neo-Colonialism. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এতে তাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। অতঃপর তারা নানা কলাকৌশল দ্বারা তাদের হারানো ঔপনিবেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রয়াস পায়। নবা ঔপনিবেশিকতার ফলে আফ্রিকার বহু দেশে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশসমূহের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণের স্থলে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাক দখল নব্য ঔপনিবেশিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নতুন বিশ্বব্যবস্থা। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর মার্কিন প্রশাসন বুঝতে পারে যে, সোভিয়েতের পতনের মাধ্যমে দ্বি-মেরু ব্যবস্থার বিলোপ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে নিরবিচ্ছিন্ন আধিপাত্য সহজ হবে না। সে কারণে বুশ প্রশাসন একটি নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে একমেরু কেন্দ্রীক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সূচনা করে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থার বিবর্তন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জাপান, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স প্রভৃতি বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতা বিলোপ হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রভিত্তিক দর্শনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক দ্বি-মেরু ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। এই ব্যবস্থায় এ দুটো পরাশক্তির মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে যাকে স্নায়ুযুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল পরস্পরবিরোধী দুটো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারকদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করা। ১৯৮৯ সালের দিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং দুই জার্মানির একীভূতকরণ সম্পূর্ণ হয়। পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আমূল সংস্কার ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে তার ক্ষমতা এমনভাবে হ্রাস পায় যে, সে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রভাবকে বাধা দান করতে অপারগ হয়। এভাবেই নয়া বিশ্বব্যবস্থার বিবর্তন ঘটে।