মহামারীতে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রয়াস চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সাল শেষে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে করোনার অভিঘাত নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
কভিডের মধ্যেও রেমিট্যান্সে ভর করে রিজার্ভের আকার দাঁড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন (সাড়ে ৪ হাজার কোটি) ডলারের কাছাকাছি। এতে ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয়ের বড় উল্লম্ফন। দেশের রিজার্ভ তহবিলের এ ঊর্ধ্বমুখী গতি বজায় থাকবে সামনের দিনগুলোয়ও। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্ষেপণ বলছে, আগামী দুই বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের মধ্যে রিজার্ভের আকার বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৭০ বিলিয়ন (৭ হাজার কোটি) ডলারের কাছাকাছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশের বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের সক্ষমতা বিচারের অন্যতম নির্দেশক হলো তার রিজার্ভ তহবিলের আকার। বাংলাদেশে বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডার বা রিজার্ভের প্রধান উৎস দুটি—রফতানি ও প্রবাসী আয়। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ, ঋণ ও দান-অনুদানও রিজার্ভের আকার নিরূপণে ভূমিকা রাখছে। রিজার্ভ তহবিলের অর্থকে মনে করা হয় যেকোনো দেশের নিরাপত্তাবলয়। যে দেশের মুদ্রা ও রিজার্ভ যত শক্তিশালী, ওই দেশের প্রতি বিদেশী বিনিয়োগকারী ও দাতা সংস্থাগুলোর আস্থাও তত বেশি। বর্তমান কভিড প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অনেক দেশের রিজার্ভ বেশ নাজুক পরিস্থিতিতে নেমে এসেছে। বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে বাংলাদেশের রিজার্ভ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গত বছর কভিডের মধ্যেও রিজার্ভের আকার ব্যাপক হারে বেড়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয় ও বিদেশী ঋণের উচ্চপ্রবাহ। আবার আমদানিতে অর্থ পরিশোধ হ্রাস ও ধীরগতির বিপরীতে রফতানি পুনরুদ্ধারের কারণেও রিজার্ভের আকার বেড়েছে।
ঐতিহাসিক প্রবণতা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রিজার্ভ নিয়ে চলতি ও আগামী দুই বছরের পূর্বাভাস তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে দীর্ঘদিন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ঘুরপাক খেয়েছে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ। ২০১৯ সাল শেষে দেশে রিজার্ভের আকার ছিল ৩ হাজার ২৬৯ কোটি (৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন) ডলার। এরপর গত বছরের এপ্রিলে তা গতি পেতে শুরু করে। ডিসেম্বরের মধ্যেই তা ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৯৭ কোটি ডলারে। চলতিটিসহ আগামী দুই বছরেও রিজার্ভের এ ঊর্ধ্বমুখিতা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এবার রিজার্ভের আকার দাঁড়াতে পারে ৪ হাজার ৯৫৯ কোটি ডলারে। আগামী বছর এ তহবিলে যুক্ত হবে আরো প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। সে অনুযায়ী ২০২২ সাল শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়াতে পারে ৫ হাজার ৯৪২ কোটি ডলারে। এ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলে ২০২৩ সাল শেষে রিজার্ভের সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯১৫ কোটি বা প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণেই কভিডকালেও রিজার্ভের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ে প্রবাসীরা দেশে বিপুল পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এ রেমিট্যান্সের প্রভাবেই আগামী দিনগুলোতেও ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থাকবে। তবে আগামীতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। আবার রফতানি পুনরুদ্ধারেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত না হয়ে ঘাটতির দিকেও যেতে পারে। এজন্য রিজার্ভ বৃদ্ধি নিয়ে প্রত্যাশার পাশাপাশি শঙ্কাও রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্র, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) বেশির ভাগেরই আমদানি এখন নেতিবাচক ধারায় আছে। অন্যদিকে তেমন গতিশীল নয় রফতানি প্রবৃদ্ধিও। এ ধরনের পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করছেন রিজার্ভ বেড়ে যাওয়া মানেই যে সুখবর, বিষয়টি তা নয়। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমার হাতে টাকা আছে, আমি বালিশের নিচে রেখে শুয়ে থাকলাম। শুনতে ভালো হতে পারে, কিন্তু টাকা যদি ভোগে বা বিনিয়োগে কাজে না আসে তাহলে সে টাকার উপকারিতা থাকে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী রিজার্ভ বাড়তে পারে, কিন্তু সেটা অর্থনীতির উন্নতির ক্ষেত্রে খুব সুখদায়ক না। কারণ রিজার্ভের উৎসগুলোতে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক, রেমিট্যান্স এলেও তার ব্যবহার হচ্ছে না। আবার বিদেশী অনুদানের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। এগুলো অর্থনীতির জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৮ ডলার দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের যাত্রা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের শক্তিশালী ১১টি মুদ্রায় রিজার্ভের অর্থ সংরক্ষণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ৮০ শতাংশেরও বেশি আছে ইউএস ডলারে। প্রয়োজন অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার এ ভাণ্ডার থেকে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রিজার্ভ। আর পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নেপালের রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল ১১ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে চীনের। দেশটির রিজার্ভের আকার ৩ হাজার ১৯৮ বিলিয়ন ডলার।
মহামারীর কারণে বাংলাদেশীদের বিদেশযাত্রা ছিল প্রায় বন্ধ। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমেছে ব্যাপক হারে। এ অবস্থায় রেমিট্যান্সে বড় উল্লম্ফন ও রফতানি আয়ের ইতিবাচক ধারা বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়িয়েছে। এজন্য বাজার থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি না হলে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা কম। দেশের রফতানি খাতে বৈচিত্র্য আসছে না। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের কারো কারো আশঙ্কা, রিজার্ভ-সংক্রান্ত পূর্বাভাস বাস্তবে ধরা না-ও দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বিভিন্ন কারণে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। তবে বিদেশে নতুন কর্মী না গেলে এ প্রবৃদ্ধি টিকবে না। করোনা শুরুর পর বিদেশ থেকে শুধু কর্মী ফেরত আসার গল্পই শুনছি। এভাবে ফিরতে থাকলে রেমিট্যান্স না বেড়ে উল্টো কমে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি না হলে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা কম। দেশের রফতানি খাতে বৈচিত্র্য আসছে না। তবে ভারত ও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এক্ষেত্রেও আমাদের ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। সব মিলিয়ে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও চ্যালেঞ্জ কম নয়। এ অবস্থায় দুই বছর পর দেশের রিজার্ভ ৭০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে, এমন সম্ভাবনা আপাতত দেখছি না।
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order: Trending
Loading...