হুমায়ুন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার বই নিয়ে কিছু কথা

in hive-120823 •  last month  (edited)

Green and White Nature Thank You Facebook cover (1).jpg

Image edited in canva

হুমায়ুন আহমেদের লেখা শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন এবং তাদের মধ্যে থাকা সম্পর্কগুলোর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটির প্রধান গল্পকথক খোকা। এই উপন্যাসটির মাধ্যমে তার ছয় ভাই বোনের সাথে তার জীবনের ছোটখাটো সুখ দুঃখ এবং ভাঙ্গা গড়ার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। গল্পের প্রতিটি চরিত্র ধীরে ধীরে একে অপরের থেকে দূরে চলে যেতে থাকে যার মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্গতা ফুটে উঠেছে। এই উপন্যাসটি শুধুমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্গতার কথাই বলে না বরং এটি আমাদের সামাজিক অবস্থার একটি বাস্তব প্রতিফলন।

গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হলো খোকার পরিবার এবং তার বড় বোন রাবেয়া। রাবেয়া চরিত্রের মাধ্যমে আমাদের সমাজের মেয়েদের করুন একটি দিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উঠে এসেছে। রাবেয়ার মায়ের দুইবার বিয়ে হয় এবং তার গায়ের রং ছিল কিছুটা কালো। উপন্যাসের মতো বাস্তব জীবনেও রাবেয়ার মত মেয়েরা সমাজের চাপে অবহেলিত হয় এবং একসময় তাদের জীবন নিঃসঙ্গতার মাঝে ডুবে যায়। উপন্যাসে রাবেয়ার গান গাওয়ার প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তার সামাজিক অবস্থানের কারণে কখনোই তার নিজস্ব সত্তা প্রকাশ করতে পারেনি। আমাদের সমাজে রাবেয়ার মত অনেক মেয়ে সামাজিকতার ভয়ে তাদের প্রতিভা প্রকাশ করতে পারে না।

pexels-rdne-9241457.jpg

Source

উপন্যাসটির আরেকটি চরিত্র হলো খোকার আরেক বোন রুনু। রুনুর বিয়ে না হওয়া এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মারা যাওয়ার কাহিনীটি আমার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। বর্তমানে এ ধরনের পরিস্থিতি খুব বেশি লক্ষণীয় না হলেও উপন্যাসটি যে সময় লেখা হয়েছে তৎকালীন সময়ে আমাদের চারপাশের প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা দেখতে পাওয়া যেত। মানসিক অসুস্থতা এবং সম্পর্কের ভাঙ্গন একটি মানুষের জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা এই চরিত্রের মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

খোকার ছোট ভাই মন্টু লেখাপড়ায় অমনোযোগী হলেও তার ভেতর লুকিয়ে ছিল কবিসত্তা। তার কিছু কিছু কবিতা পত্রিকাতেও ছাপা হত। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে এবং পরিবারের চাপে তার এই কবি সত্তা খুব বেশি দূর বিকশিত হতে পারে নি। এই চরিত্রটি আমাদের সমাজের সেই অংশকে ইঙ্গিত করে, যেখানে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থানের কারণে মানুষ তাদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করতে পারেনা।

pexels-photo-1485114.jpeg

Source

উপন্যাসটির একপর্যায়ে গিয়ে গল্পকথক খোকার এবং তার ছোট খালার মেয়ে কিটকির মাঝে প্রেম দেখতে পাই কিন্তু কিটকির পরিবার মেনিলায় চলে যাওয়ায় তাদের প্রেম কখনো বাস্তব রূপ নেয় না। আসলে ভালোবাসা সব সময় আমাদের ইচ্ছেমতো হয় না, মাঝে মাঝে তা বাস্তবতার সাথে মিলে যায় না। খোকা এবং কিটকির এই ব্যাপারটি আমাকে বারবার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের মত যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের তাদের জন্য এ ধরনের ঘটনা যেন জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।

উপন্যাসটি শেষের দিকে রাবেয়া শহরের একটি মহিলা হোস্টেলে সুপারিনটেনডেন্ট হয়ে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং মন্টু তার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে গল্পকথক খোকা ধীরে ধীরে তার পুরোনো জীবনের স্মৃতি গুলোর মাঝে ডুবে যায় এবং তার আশেপাশের মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তার এই চরিত্রের মাধ্যমে আমরা লক্ষ্য করতে পারি কে ধীরে ধীরে সম্পর্কের জটিলতা এবং পারিবারিক বন্ধন ক্ষীণ হয়ে যায়।

উপন্যাসটি পড়ার সময় পুরো গল্প জুড়ে এক ধরনের চাপা দুঃখ অনুভব করা যায়। উপন্যাসটির প্রত্যেকটি চরিত্র যেন সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থা এবং পারিবারিক দায়িত্বের ভারে এক ধরনের অসহায় ও তার মধ্যে আটকে রয়েছে। এক কথায় এই উপন্যাসটি মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা এবং বাঙালি পরিবারের গভীর আবেগ অনুভূতির একটি চমৎকার প্রতিফলন।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...