আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে কুপি বাতি ও হারিকেন

pixabay

হারিকেন হল জ্বালানী তেল ব্যবহার করে একটি বন্ধ কাচের পাত্রে আলোর ব্যবস্থা। এর বাইরের অংশে একটি অর্ধবৃত্তাকার কাচের প্যানেল রয়েছে, যাকে বাঙালিরা চিমনি বলে, যার ভিতরে তেল শোষণ করার জন্য এবং আগুনের সাথে সংযোগ করে আগুন জ্বালানোর জন্য একটি কাপড়ের গ্রিড রয়েছে। আর পুরো হারিকেন বহন করার জন্য বাইরের দিকে একটি লোহার হাতল থাকে, আলো কমাতে বা বাড়ানোর জন্য নিচের অংশে একটি ডিস্ক থাকে, যা আলো বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে এবং কমতে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এর ব্যবহার সর্বাধিক। এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল অনেক আগে, সম্ভবত মুঘল আমলের আগে বাংলায় হারিকেনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় রিকশার নিচে হারিকেন এখনও আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরিশোধিত খনিজ তেলের একটি সাধারণ প্রদীপের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় নবম শতাব্দীর পারস্য আলকেমিস্ট আল-রাজির বই 'আল-আসরার'-এ। তিনি এই প্রদীপের নাম 'নাফাতহ' উল্লেখ করেছেন।

pexels

এছাড়া বাঙালীর জীবনের রাতের অন্ধকার দূর করতে এক সময় হারিকেন ছিল গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা। হারিকেনে ব্যবহৃত জ্বালানীর মধ্যে কেরোসিন ছিল অন্যতম। সে সময় গ্রামাঞ্চলে রাতে বিয়ে, শোভাযাত্রা, মঞ্চ নাটক, ওয়াজ-মাহফিল বা দোয়া অনুষ্ঠান হতো। হারিকেন জ্বালিয়ে বাড়ির উঠোনে বা বারান্দায় ভাই-বোনেরা একসঙ্গে লেখাপড়া করত। হারিকেনের জ্বালানি ছিল কাঁচের বোতলে কেরোসিন দড়ি দিয়ে বেঁধে রান্নাঘরের কোথাও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সন্ধ্যার আগে হারিকেনের গ্লাসটা মুছে তেলে ভরে গেল। একসময় ডাকপিয়নরা পিঠে চিঠির বোঝা নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটতেন। সামাজিক পরিবর্তন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আধুনিকতার কারণে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির আশঙ্কায়। বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না। যাইহোক, এই হারিকেন এখনও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে রিকশার নিচে আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

pexels

কয়েক ধরনের কুপি বাতি ছিল। সেখানে মাটি, রূপা, টিন, লোহা, কাঁচের বোতল এবং পিতলের তৈরি পেয়ালা ছিল। কিন্তু সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মাটি, টিন ও রূপার প্রদীপের ব্যবহার ছিল।
একক-কলাম, ডাবল-কলাম, একক-শেল্ফ, দুই-শেল্ফ সহ বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। বাতির নলে আগুন জ্বালানোর জন্য পুরানো কাপড়ের টুকরো বা পাটের সুতলি ফিলামেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাতলা এবং 5-6 ইঞ্চি লম্বা তারটি ল্যাম্প টিউব দিয়ে ঢোকানো হয়েছিল। প্রতিদিনই এর কিছু অংশ পুড়ে যায়। পরের দিন একটু উঁচুতে তুলতে হলো। এক পর্যায়ে এটি পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং প্রতিস্থাপন করা হয়। ওই বাতির টিউবগুলো যে কোনো মুদি দোকানে 2-5 টাকায় কেনা যায়। যেহেতু কাপ নেই, তাই টিউবগুলির উত্পাদনশীলতাও খুব কম।

pexels

তাছাড়া ছাত্ররা তখন কুপি বাটি বা হারিকেন নিয়ে লেখাপড়া করত। সন্ধ্যায় শিশু-কিশোররা কুপি বাতি বা হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরে ঘরে যেত। এছাড়া সারা রাতের কাজ যেমন রান্না, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ধান মাড়াই, যাতায়াত এবং আলোর যাবতীয় কাজের চাহিদা এই কুপি বা হারিকেন দিয়ে মেটানো হতো।

pexels

আজকাল প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। সর্বজনীন বিদ্যুতায়ন গ্রামীণ বাসিন্দাদের কাছে কুপি বাতি এবং হারিকেনের মূল্য হ্রাস করেছে। কোনো কোনো গ্রামীণ বাড়িতে কুপি বাটি বা হারিকেন থাকলেও তা ঘরের কোণে অযত্ন ও অবহেলায়। তবে শহরের অনেক ফ্ল্যাট বাড়িতে হারিকেন দেখা যায়। বাড়ির গিন্নি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই হারিকেনকে শোপিস হিসেবে সাজিয়েছে ড্রয়িংরুমে। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রাচীন প্রয়োজনীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

🎀ধন্যবাদ সবাইকে🎀.