চেম্বার কথন: এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশানের রিয়াকশানে (Anaphylaxis) প্রায় হারাতে বসা এক রুগীর গল্প!

in hive-129948 •  3 months ago 
হ্যালো! কেমন আছেন সবাই। আশা করি সবাই ভাল আছেন। "চেম্বার কথন" সিরিজের পরবর্তী ৫ম পোস্ট নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হলাম। এখানে আমি আমার চেম্বারে পরামর্শ দেয়া কোন একটা রুগীর রোগ সম্পর্কিত একটা ছোট গল্প বলি। গল্পের শেষে এর আলোকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্ল্যেখ করি। চলুন শুরু করা যাক।

steem (1).jpg


এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশানের রিয়াকশানে (Anaphylaxis) প্রায় হারাতে বসা এক রুগীর গল্প!

৩০ বছর বয়স্ক পাকিস্থানী বংশোদভুত একজন রুগী। ছোটবেলা থেকেই ওমানে বেড়ে উঠেছেন। বেশভুষা, কথাবার্তায় পুরোদস্তুর ওমানী। আমাদের ক্লিনিকে এসেছেন বহুবার। আমিও তার চিকিৎসা করেছি বেশ অনেক বার। ইঞ্জেকশান দেয়া হয়েছে বিভিন্ন রকমের। কিন্তু এদিনটি ছিল ভিন্ন একটা দিন। ভয়াবহ এক দিন! রুগীর জন্যে! আমার জন্যে!

যেদিনের গল্প বলছি, তার আগের এক ভিজিটে রুগীকে যে ইঞ্জেকশান এবং মুখে খাওয়ার ওষুধ আমি দিয়েছিলাম গলার সমস্যার জন্যে, সেটাতে উনি সুস্থ্য হয়েছিলেন। তাইতো একই রকম গলার সমস্যার জন্যে আবারও আমার কাছেই আসেন উনি। এবং একই ইঞ্জেকশান ও মুখে খাওয়ার ওষুধ দিতে বলেন।

আমি কম্পিউটারে আগের রেকোর্ড চেক করলাম। লিখে দিলাম একই ইনজেকশান। কিন্তু নার্স জানালো যে আগের বার দেয়া এন্টিবায়োটিক টা আপাতত স্টোকে নাই। তাই একই পাওয়ারের অন্য আরেকটা এন্টিবায়োটিক দেয়ার সিদ্বান্ত হয়। রুগীকেও জানানো হয় এবং উনি রাজি হন।

প্রটোকল ফলো করে এন্টিবায়োটিক পুরোটা পুশ করার আগে চামড়ায় টেস্ট ডোজ (test dose under the skin) দেয়া হয়। ১২-১৫ মিনিট পর চেক করা হয় যে কোন এলার্জিক রিয়াকশান হয়েছে কিনা চামড়ায়। কোন লোকাল রিয়াকশান না হওয়ার নার্স পুরো ইনজেকশান শিরাতে পুশ করে দেয়।

পুশ করার ১-২ মিনিটের মধ্যেই উনি সমস্যা অনুভব করেন। নার্স আমাকে জানায়। আমি দৌঁড়ে যায়।

রুগী সমানে গামছে! শ্বাসকষ্ট হচ্ছে! মাথা ঘুরছে! বসছে আবার পড়ে যাচ্ছে! ঘড়ঘড় করে আওয়াজ আসছে বুক থেকে!

চিৎকার করে ডাকলাম অন্য নার্সদেরকে। নার্সরা আসার আগেই দুইবার কলাপ্স করল আমার হাতে। একবার হুশ ফেরে আবার নাই হয়ে যায়! বলে রাখা ভাল, আমাদের ক্লিনিকটা কোন হাসপাতাল না এবং কোন ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টও নাই এখানে। তাই এধরনের ইমার্জেন্সি অবস্থা ম্যানেজ করা খুবই কঠিন এখানে।

সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করা প্রাথমিক ডায়াগনোসিস হলো একিউট এনাফাইলেকটিক রিয়াকশান (acute anaphylactic shock), এন্টিবায়োটিক এর জন্যে। প্রেশার এত ড্রপ করেছে যে তা পরিমাপই করা যাচ্ছিল না। পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। তারাতারি দুইটা ইনজেকশান দেয়া হলো। শিরাপথে স্যালাইন দেয়া হলো দ্রুতগতিতে। অক্সিজেন দেয়া হলো মাস্কের মাধ্যমে। উনার হুশ ছিল তখন। প্রায় ১০-১৫ মিনিট পর পালস পাওয়া গেল। আরো প্রায় ১০ মিনিট পর প্রেশার পাওয়া গেল, খুবই কম!! দুইটা স্যালাইনের শরীরে যাওয়ার পর উনার প্রেশার ৯০/৬০ উঠল। আলহামদুলিল্লাহ!

সার্বক্ষনিক উনার পাশে দাড়িয়ে ছিলাম পুরা সময়টা। ৪-৫ মিনিট পর পর চেক করি অবস্থার উন্নতি বা অবনতি বোঝার জন্যে। উনি একা একা এসেছিলেন আমাদের ক্লিনিকে। যখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলো এবং উনি কথা-বার্তা বলার উপযুক্ত হলেন তখন উনার মাধ্যমেই উনার উয়াইফ কে কল করা হল।

পরবর্তীতে উনি যখন মোটামুটি ভাল অনুভব করলেন, রক্তচাপ পাওয়া গেল ১১০/৭০ এর মত, বুকে শ্বাসকষ্টের কোন লক্ষণ আর পাওয়া গেল না, তখন আমরা তাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলাম।

উনি হেটে এসেছিলেন আমার চেম্বারে। আবার উয়াইফের সাথে হেটে হেটেই চলে গেলেন। কিন্তু মাঝখানের ১ ঘন্টা হয়ে রইল একটা স্ট্রেসফুল ইতিহাস। আমার জন্যে! উনার জন্যেও!



এই গল্পের আলোচ্য রোগ এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশানের রিয়াকশান (Anaphylaxis) সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্যঃ

  • এনাফাইলেক্সিস বা এনাফাইলেকটিক রিয়াকশান অনেক সময় জীবনঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। দ্রুত রোগ বুঝতে পারা, রিয়াকশানের কারণ ধরতে পারা এবং সাথে সাথে ট্রিটমেন্ট শুরু করাই হচ্ছে রুগীকে বাঁচানোর উপায়।
  • কোন খাদ্যদ্রব্য, শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করা কোন কেমিক্যাল, ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করা কোন ওষুধ, পোকা-মাকড়- মৌমাছির কামড় ইত্যাদির জন্যে এরকম জীবনসংহারী রিয়াকশান হতে পারে।
  • হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যাওয়া, হাত-পা কিংবা শরীরের সারফেসের দিকে রক্ত-সঞ্চালন ব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়া, প্রচন্ড ঘাম আরম্ভ হওয়া, শ্বাস-কষ্ট শুরু হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রাধান্য পায় এধরনের ক্ষেত্রে।
  • শিরাতে দেয়া কোন ইনজেকশানের রিয়াকশান হলে সাধারণ ইনজেকশান পুশ করার সাথে সাথেই বা এক-দুই মিনিটের মধ্যে রিয়াকশান শুরু হয়। যেটা আমার রুগীর ক্ষেত্রে হয়েছিল।

Anaphylactic shock in 60 seconds এই ভিডিওটা দেখতে পারে


ওকে। আজকে এ পর্যন্তই। আশা করি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন আমার পোস্ট থেকে। কোন পরামর্শ বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন। ভাল থাকুন।

আল্লাহ হাফেজ

ডা. হাফিজ
ওমান



চেম্বার কথন সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টঃ

বুকে বাতাস জমা (Pneumothorax) এক রুগীর গল্প!

একজন হাউজমেইডের (Housemaid) গল্প যিনি তার চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে

ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত এক রুগীর গল্প

পেশাব এবং তলপেটের ব্যথা নিয়ে আসা এক রুগীর গল্প



আমি ডা. হাফিজ। ঢাকার একটা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের বাইরে আছি। শুরুতে ২ দুই বছর ছিলাম মালদ্বীপে। তারপর থেকে ওমানে আছি গত ৭ বছর ধরে। এখানে একটা পলিক্লিনিক এ জি.পি. ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছি বর্তমানে।
My Discord ID: hafiz34#3722

Posted using SteemPro

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

অনেক সুন্দর একটি পোস্ট আপনি আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন। আপনার এই পোস্টের লেখাগুলো পড়ে আমি অনেকগুলো সচেতন হওয়ার বিষয় জানতে পেরেছি। অনেক সুন্দর একটি জনসচেতনামূলক পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আপনার কমেন্ট পড়ে খুবই ভাল লাগলো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও।