এক বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতার গল্প

in hive-129948 •  3 months ago 


আসসালামু আলাইকুম
আমার বাংলা ব্লগে সকলকে স্বাগতম


Picsart_24-10-28_19-07-55-539.jpg

Photography device: Huawei P30 Pro-40mp


গল্প


আমাদের গ্রামে একজন বাদাম বিক্রেতা আসতেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ লোক ছিলেন। তিনি বলতেন আমি ব্রিটিশ আমলের মানুষ। ৪৭ এর দেশ বিভাগ আমি দেখেছি। একাত্তরের যুদ্ধ আমি দেখেছি, একদম চোখের সামনে। তিনি বলতেন আমি যত কিছু জানি তোমরা তা জানো না। মানুষটা এতটাই বৃদ্ধ ছিলেন, বাদাম বিক্রয় করতে আসলে একটু মানুষজন জুটলে সেখানে বসে পড়তেন। বিভিন্ন রকমের গল্প শুনাতো। তবে বৃদ্ধ মানুষ হওয়ায় ছোটরা যেমন থাকতো, তেমন মেয়ে মানুষেরাও তার সাথে গল্পে লিপ্ত হতো।

বিভিন্ন ভাঙ্গাচুরা টিনের জিনিস দিয়ে অনেক বাদাম দিতেন। তখন বাদামের দাম মাত্র ৮০ টাকা কেজি ছিল। একদিকে বাদাম দাঁড়িতে মেপে দিচ্ছেন আর গল্প করতেন। কথায় কথায় তিনি তার জীবন কাহিনী বলা শুরু করলেন। তিনি বাল্যবিবাহ করেছিলেন। তার বয়স যখন ১৮ বা ২০ বছর নয় বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটা দেখতে খুব ফর্সা ছিল, কিন্তু তিনি দেখতে কালো। তাদের বাবা-মা ঠিক করে মেয়েটার সাথে বৃদ্ধের বিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ ওই বৃদ্ধের আম্মা খুব অসুস্থ ছিল, তাই আশা ছিল একমাত্র ছেলের বউকে দেখে মৃত্যুবরণ করা। তাই মায়ের কথা ফেলতে না পেরে সে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু দেখা যায় বিয়ের দুই থেকে তিন বছর পর সন্তান প্রসব করতে গিয়ে প্রথম স্ত্রী মারা যান। তার সেই ছেলে সন্তানটা বেঁচে ছিল। তখন বৃদ্ধের আম্মা তার ছেলের বাচ্চাটাকে বড় করতে থাকে। অনেক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে সংসার চলতো তাই দীর্ঘদিন বিয়ে করছিলেন না। সেই সময় দেশে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা লেগে থাকতো। মানুষের খাবারের পচুর অভাব ছিল। যখন বৃদ্ধের ছেলের বয়স দুই বছর খাবারের অভাবে এবং ঔষধপাতির অভাবে তার আম্মা মারা গেলেন। অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা থাকায় খাবারের সংকট লেগেই থাকতো। তাই উনি বিয়ে করলেন দেরিতে, এরপর ছেলের বয়স যখন ৬-৭ বছর তখন উনি বিয়ে করেন।

আমাদের এক আন্টি বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন তার ছেলেটা কে মানুষ করলো এতদিন। তখন উনি বললেন ওর কোন এক চাচাতো বোন এবং চাচাতো ভাই-বোন দেখাশোনা করে মানুষ করেছিলেন। এরপর উনি যখন বিয়ে করলেন নতুন বউ ঘরে আসলো, এতদিনে সে মোটামুটি চলার মত স্বাবলম্বী হওয়ার মতো হয়ে উঠছেন। আশা করেছিলাম তার সন্তানটা এবং নতুন বউ নিয়ে সুন্দর সংসার গড়বেন। কিন্তু দেখা যায় প্রায় মাঝেমধ্যে তার নতুন স্ত্রী ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করত এবং অত্যাচার করত। মাঝেমধ্যে চেষ্টা করত ছেলেটাকে কিভাবে মেরে ফেলা যায়। বৃদ্ধ ব্যক্তি তার কৃষি কাজে মাঠে চলে যেতেন বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে যেত। বাড়িতে আসলেই বিভিন্ন জনের মুখে বিভিন্ন কথা শুনতেন। এক কথায় তার স্ত্রী সন্তানটাকে চোখে দেখতে পারতেন না। তাই বৃদ্ধ এই সমস্ত কারণে তার বউয়ের গায়ে যখন তখন হাত উঠাতেন। পরবর্তীতে উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ও বউকে রাখবেন না। পরে অনেক কাহিনী হয়। এরপর মীমাংসা হয়। উনি সংসার শুরু করেন। নতুন বউ এর কলে দুইটা সন্তান হল। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। আগের সন্তান বড় হয়ে গেল। এভাবেই সংসার জীবন চলতে থাকে কিন্তু হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের আগে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেলেন।

বড় ছেলেটা ইতোমধ্যে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে, কিন্তু দেশের পরিস্থিতি ভালো না এজন্য বিয়ে করতে পারে না। এদিকে বৃদ্ধ সেই সময় বিয়ে না করলে তার সংসার চালাবে কে। তাই বড় ছেলেকে বিয়ে না দিতে পারলেও নিজে বিয়ে করে বসলেন। মুক্তিযোদ্ধা শুরু হল। ছেলের যুদ্ধে গেলেন। হঠাৎ একদিন শুনতে পারলেন তার ছেলে কে রাজাকারে ধরে নিয়ে গেছে। অতঃপর জানতে পারলেন তার ছেলেকে মেরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধ ব্যক্তির কিছুই করার ছিল না। দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়ে নিয়ে এবং তৃতীয় স্ত্রীর সাথে কোনো রকম দিন পার করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো দেশে কোনরকম স্বাভাবিক অবস্থা। এরপর স্ত্রীর কোলে তিনটা সন্তান হল। দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের সন্তান মানুষ করতে গিয়ে তার জমির জায়গা অনেক বিক্রয় হয়ে গেছে এবং বেদখলে চলে গেছে। তিনি একটা কথা বলেছিলেন আমার অবাক হয়েছিলাম। এক বাবার এক সন্তান হওয়াই তার ৫০ বিঘার উপরে জমি ছিল। তবুও খাবারের অভাব লেগে থাকতো। কিন্তু তৃতীয় বিয়ের পর দেশের বিভিন্ন কারণে তার জমি হারাতে হয় এবং জমি বিক্রয় করে একটি পর্যায়ে অল্প সংখ্যক জমি নিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। আর সেই জমির দেখাশোনা করে দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেটা। মা খারাপ ছিল কিন্তু ছেলেটা ভালো হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের ভাই-বোনদের দেখাশুনা করতো সে। তারপর থেকে কৃষি কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন বৃদ্ধ। মেটে হাড়ি কলসি বিক্রয় করতেন। বয়সের কারণে সেটা বাদ হয়ে যায়। এরপর বাদাম বিক্রয় করাটা তার কাছে ভালোলাগার পেশা হয়ে উঠল। কিন্তু দেখা যায় ১৯৯০ সালের আগে তার তৃতীয় স্ত্রী মারা গেলেন। ছেলেমেয়েগুলো লেখাপড়া করাতে পারেনি। তবে তারা তাদের মত গড়ে উঠছে। আর সে ওই মুহূর্তে বাদাম ব্যবসা করে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। ২০০৭ সালের দিকে তাকে শেষ দেখেছি। এরপর আর কোনদিন দেখি নাই।

PB8ro82ZpZP35bVGjGoE93K3E4U5KX8KtMBJ2rhmkyLqtRRZvVw9YH8hEBg7DJQKSJLWf7VJRhnjGRYSDmuGDMSHAPBRbiRis5HV4ATHTF7QvLHc.png


পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ



received_434859771523295.gif


পোস্ট এর বিবরণ


বিষয়গল্প
ফটোগ্রাফি ডিভাইসHuawei P30 Pro-40mp
Photo editingPicsArt app
ক্রেডিট@jannatul01
W3w locationsource
দেশবাংলাদেশ
ব্লগারআমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটি


আমার পরিচয়


আমার নাম মোছাঃ জান্নাতুল ফেরদৌস শশী। আমার বাসা গাংনী মেহেরপুর, বাংলাদেশ। আমি আপনাদের সুপ্রিয় বিদ্যুৎ জিরো ওয়ান এর পরিবার। আমি একজন গৃহিণী। স্বামী সন্তান সহ আমাদের যৌথ পরিবার। আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটির চারজন সদস্য রয়েছে আমাদের পরিবারে, তার মধ্যে আমি একজন। এইচএসসি পাশ করার পর বিয়ে হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার লেখাপড়া স্থগিত হয়। আমার ইচ্ছে আমি এই কমিউনিটিতে দীর্ঘদিন ব্লগ করব। পাশাপাশি আমার নিকটস্থ প্রিয়জনদের সহায়তা করব এই কমিউনিটিতে কাজ করার জন্য।


2N61tyyncFaFVtpM8rCsJzDgecVMtkz4jpzBsszXjhqan9xBEnshRDSVua5J9tfneqYmTykad6e45JWJ8nD2xQm2GCLhDHXW9g25SxugWCoAi3D22U3571jpHMFrwvchLVQhxhATMitu.gif



99pyU5Ga1kwqSXWA2evTexn6YzPHotJF8R85JZsErvtTWXkFkcDg5ibdZCen8p3uDxVoV5q1NZLwPPeBug1jepgK3e2Zdtv5gFKAP1J8S7nez1ced4GsXM4bVpnBb88Np6.png


Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

অজানা কোন বিষয় জানতে আমার ভালো লাগে। ঠিক তেমনি এক কমিউনিটিতে যারা গল্প উপস্থাপন করেন আমি চেষ্টা করেছি গল্পগুলো থেকে বেশ কিছু জানার। ইতোমধ্যে একটি বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতার জীবন কাহিনী জানতে পারলাম। আসলে মানুষের জীবন বিভিন্ন রকমের কাহিনী দিয়ে গড়া। তবে এটা ভালো লাগলো দ্বিতীয় স্ত্রী ভালো না হলেও তার ছেলে সন্তান টা ভালো হয়েছিন। পেতে হয়তো বৃদ্ধ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।

মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।

বাদাম বিক্রেতা বাল্যবিবাহ করেছে জানতে পেরে আগেকার দিনের কথা মনে পড়ে গেল। যাইহোক গল্পটা বেশ সুন্দর ছিল এই ধরনের গল্প আমাদের জীবনে তো ঘটে নাই তবে শুনতে অনেক ভালো লাগে যাই হোক ধন্যবাদ আপনাকে এমন সুন্দর একটি গল্প আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য।

চেষ্টা করব এমন জানা ঘটনা শেয়ার করতে