☘️বাংলার এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প - বহুরূপী☘️
আপনাদের বাংলার বহুরূপীর কথা মনে আছে? একসময় মাঠে ঘাটে ঘরের উঠানে তারা আসতো বিভিন্ন দেবদেবীর সাজে। বহুরূপী বললেই মনে পড়ে যায় ঘরের দোরগোড়ায় শিব, কৃষ্ণ বা কালী ঠাকুরের আগমনের কথা। কেন জানিনা আজ আমার খুব বহুরূপীর কথা মনে পড়ছে। আসলে এটি ছিল এমন এক শিল্প যা বাংলার একান্ত আপন। আজ আমরা বড় পরনির্ভরশীল। বাঙালি যখন বিদেশ ও বিদেশীকে নকল করে বাঁচতে ভালবাসে, তখন যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের একান্ত আপন রুটগুলোই। আমরা এখন অন্যান্য সম্প্রদায় বা জাতির সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে ভালোবাসি। কিন্তু নিজস্বতাকে ভুলে বহুদিন আগেই বেরিয়ে এসেছি সাবলীলভাবে। ঠিক সেই মতোই আমরা ভুলে গেছি বাংলার এক শিল্প বহুরূপীর কথা। এদের জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও সারাদিন মুখের রং কালি মাখিয়ে এরা ঘুরে বেড়াতো মানুষকে আনন্দ দিতে। মানুষ তাদের চলিত ভাষায় বলতো 'সং'। এক কথায় বলতে গেলে নিতান্ত ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু তার ভেতরেও কোথাও যেন ভীষণ অভিনবত্ব। প্রতিদিনে চলার পথে যদি আপনি দেখেন শিব ঠাকুর বা কালী ঠাকুর রাস্তায় হেঁটে চলেছে। হাতে তার খড়্গ ও ত্রিশূল, তাহলে বিষয়টা কেমন হয় বলুন তো। ঠিক এভাবেই আমরাও ছেলেবেলায় ঠাকুর দেবতাদের রাস্তায় হাঁটতে দেখতাম। তখন অবাক দৃষ্টিতে ভাবতাম এরা বোধহয় সত্যিই স্বর্গলোক ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে পৃথিবীর পথে। আমাদের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনে হাঁটবে বলে। অবাক বিস্ময়ে বাবা মাকে প্রশ্ন করতাম- বাবা কালী ঠাকুর স্বর্গ ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছে কেন? বাবাও একটু হেসে উত্তর দিত, মানুষ কেমন আছে দেখতে এসেছে বাবা। আমি হাসতে হাসতে চলে যেতাম নিজের কাজে। তার কিছুদিন পরে দেখলাম বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে একজন শিব ঠাকুর ধুমপান করছে। তখন আবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা শিব ঠাকুর বিড়ি খায়? সে কথার উত্তরে বাবা তীব্র হেসেছিল সেদিন।
তারপর একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে জানতে পারলাম বহুরূপী শিল্পের কথা। হাজার কান্না লুকিয়ে এরা ঠাকুর দেবতা সেজে মানুষকে আনন্দ দিত সারাদিন। আর দিনের শেষে সঞ্চিত দু চার পয়সা নিয়ে আবার মিশে যেত নিজের জীবনে। মুখ থেকে তুলে ফেলত রং কালি। প্রত্যেক দিনের এই বিচিত্র লড়াইতে এরা জয়ী হতো রোজ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত চরিত্র ছিনাথ বহুরূপীর কথা মনে পড়ে? যে বাঘের বেশ ধরে মানুষজনকে ভয় দেখাতো। সেই ছিল আমাদের কাছে বহুরূপীর প্রথম পরিচয়। তারপর গ্রামেগঞ্জে চারপাশে ঘুরতে দেখেছি বহুরূপীদের। গাজনের সময় হাজারো শিব ঠাকুর চলতে ফিরতে রেখেছি রাস্তায়। আমরা যদি একটু ইতিহাস অনুসন্ধান করি তবে দেখতে পাবো এরা কাজ করতো রাজা বা নবাবদের ইনফর্মার হিসাবে। আসলে ছদ্মবেশ মানুষের আসল চেহারাতে লুকিয়ে রাখার এক সুন্দর পন্থা। আর সেই ছদ্মবেশ গ্রহণ করে বহুরূপীর সাজে এরা খবর আনতো রাজা রাজরাদের জন্য। রাজারা আজ আর নেই। নেই রাজত্বও৷ কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেছে বহুরূপীরা। আজ বহুরূপী শুধুমাত্র একটি লুপ্তপ্রায় পেশায় পর্যবসিত। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি তরফে এদের কোন সংরক্ষণ বা আশ্বাস নেই। যা আছে তা হল কেবল অবহেলা। তাই ধীরে ধীরে এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কালের গহবরে। আর বাঙালি ও ভুলে গেছে ছিনাথ বহুরূপীদের কথা।
আজ আমরা সময়ের সঙ্গে পথ চলতে চলতে অনেক কিছুকেই হারিয়ে ফেলেছি আবহমান কালের গভীরে। বাঙালি ঐতিহ্যের কতটুকুই বা পালন করতে পারি আমরা? আজকাল যেমন মনসা পূজো বা শিতলা পূজোর থেকেও বেশি গনেশ পুজো দেখা যায়। আজকাল যেমন ইতু লক্ষ্মীর পুজোর বদলে ধনতেরাস দেখা যায়। ঠিক সেভাবেই বাঙালির লোকসংস্কৃতিকেও আমরা হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। বাউল শিল্পীরাও আজ বিপন্নপ্রায়। টুসু, ভাদু, ভাটিয়ালি তো প্রায় শোনাই যায় না। শুধুমাত্র কিছু লোকসংস্কৃতির গবেষক এবং শিল্পী ভিন্ন আর কেউ এসব গানের চর্চাও করেন না। তাই ধীরে ধীরে বাঙালির লোকসংস্কৃতি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ আমরা অনুকরণে ব্যস্ত। তাই বহুরূপী না খুঁজে সময় নষ্ট না করে আমরা আইনক্সে সিনেমা দেখি। থিয়েটার না দেখে আমরা ওয়েব সিরিজ দেখি। কিন্তু বাংলা ও বাঙালি তার ঐতিহ্যকে ছাড়া পথ চলতে পারবে কি? ঠিক যেভাবে বহুরূপীরা হারিয়ে গেছেন, সেভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে না তো বাংলার সমস্ত সংস্কৃতির ধারা? চিন্তা হয় বৈকি। খুবই চিন্তা হয়। ভাষাটাই যেখানে বিভিন্ন ভাষার আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে, সেখানে আর বাকি কী থাকে? আজ কোথাও বাংলা ভাষা হিন্দির আগ্রাসনে জর্জরিত। আবার কোথাও সেখানে উর্দু বা আরবি ভাষার দাপট। আর সবকিছু মিলিয়ে পথ চলার ভাষা ইংরেজির দাপট তো আছেই। তাই এমন বিপন্নতার মাঝে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, আর কিছুদিনের মধ্যেই বাঙালি জাতিটাই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তার আবহমান সংস্কৃতিকে মুছে ফেলবে না তো? চিন্তাটুকু আপনাদের মধ্যেও বুনে দিলাম। যদি পারেন একটু ছড়িয়ে দেবেন। ভালো থাকবেন সকলে। আজ এর বেশি কিছু বলার নেই।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1855602380403851603?t=D7N7JY5NUenQBJCoLI2upw&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমাদের যে অনেককিছুই আছে সেই বিশ্বাসটুকুই আজ আর নেই৷ এই কথাটাই তোমায় বলি৷ বাঙালি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি৷ আজ বাঙালি নেচে নেচে গনপতি পুজো করে সুখহরতা দুখ হরতা গায়৷ কদিন পর ছট পুজোও করবে৷ যেমন বিয়েতে মেহেন্দি পরে, সঙ্গীত হয়। অথচ আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি, পড়াশুনা থেকে শিল্প সংস্কৃতি সব দিকেই৷
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
একদম ঠিক কথা বললি। বাঙালির অনুকরণপ্রিয়তা তার সমস্ত সত্তাকে দূরে করে দিচ্ছে। অচিরেই যদি আমরা আমাদের নিজস্বতাকে না আঁকড়াই তবে একটা জাতি হারিয়ে যাবে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমি সরাসরি কখনও বহুরূপী দেখিনি। তবে ফেসবুকে কয়েকমাস আগে দেখেছিলাম। অদ্ভুত ধরনের পোষাক এবং সাজ এবং সঙ্গে নিজের তৈরি করা ছড়া বা গানের মতো কিছু একটা বলে যায়। শুনতে ভালোই লাগে। পরবর্তীতে কমেন্ট পড়ে কিছুটা জানতে পেরেছিলাম। আপনার পোস্ট থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম এদের সম্পর্কে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যাঁ ভাই। ওরা এক ধরনের ছড়া বলে। পারলে সম্প্রতি রিলিজ হওয়া বহুরূপী ছায়াছবিটি দেখে নেবেন। অনেক কিছু জানতে পারবেন। মন্তব্য করে পাশে থাকবার জন্য ধন্যবাদ।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমরা এখন নিজের সংস্কৃতির চেয়ে বিদেশী সংস্কৃতিতে আসক্ত। আজ আমরা হ্যালোইন উৎসব পালন করি। কিন্তু লালন ,ভাটিয়ালির চর্চা করি না। বেশ ভালো লাগলো আপনার লিখাটি পড়ে। অনেক কিছু জানা হলো বহুরুপীদের সম্পর্কে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ঠিক বলেছেন আপু। আমরা এখন বিদেশি সংস্কৃতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। আসলে আমরা নিজেদেরকেই বিপন্ন করে তুলছি পৃথিবীর বুকে। এভাবে চলতে থাকলে বাঙালি জাতিতাই হারিয়ে যাবে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit