আমার চোখে খোশবাগ। প্রাচীন মুর্শিদাবাদের এক ছাই চাপা অগ্নিকুণ্ড
আসুন ইতিহাস জানি
মুর্শিদাবাদ যেতে আমার বড় ভালো লাগে। আসলে মনটা আমার ইতিহাস কেন্দ্রিক। কারণে-অকারণে বারে বারে ছুটে যাই ইতিহাসের গোড়াগুলো ধরে টান দিতে। ইতিহাস ভালবাসলে বাংলার যে অঞ্চলের ওপর প্রথম চোখ পরে তা হল মুর্শিদাবাদ। আজ আমার এই পোষ্টের মাধ্যমে আপনাদের সামনে আনতে চাই আমার একটি দীর্ঘ কর্মকান্ডকে। যে কর্মকাণ্ড আমার অন্যতম এক ভালোবাসা। তা হল নবাবী অধ্যায়টা নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা। কি ভাবছেন? কেন হঠাৎ মুর্শিদাবাদ নিয়ে পড়লাম? নামটি ছাপোষা, জায়গাটিও তাই। কিন্তু তা তো আজকে। যদি পিছিয়ে যাই ২৫০ টি বছর, তবে যে মুর্শিদাবাদের সাক্ষী থাকতে পারবো তা হয়তো আমরা কেউ কল্পনাতেই ভাবতে পারি না। কোথায় ছিল কলকাতা? কোথায় ছিল আধুনিক যন্ত্রপাতি? কিন্তু ছিল একটা ঝলমলে মুর্শিদাবাদ। যে মুর্শিদাবাদ অর্থে, সম্পদে বা জাঁকজমকে ছিল তৎকালীন লন্ডন শহরের চেয়েও অগ্রসর। আর সেই জায়গা আজ এক সাধারণ শহরতলি। এই অবনমনের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণটি অবশ্যই ইংরেজ যুদ্ধঅধিনায়ক রবার্ট ক্লাইভের কলকাতা আগমন৷ পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে নবাবদের ডানা ছেঁটে অধিনস্থ শাসকে পরিণত করা, সবটাই ক্লাইভের মস্তিষ্কপ্রসূত। আর নবাব সিরাজ পলাশীর যুদ্ধ হেরে প্রাণত্যাগ করলে মুর্শিদাবাদের পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ ইংরেজদের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার ক্ষমতা হাতে পাওয়া। আর এই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান পটভূমি যে জায়গায় রচিত, তা হল মুর্শিদাবাদ। তাই মুর্শিদাবাদ গেলেই কেমন যেন শিহরণ হয়৷ কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি একেবারে জৌলুশহীন সাদামাটা এক কবরে একা ঘুমিয়ে আছেন আলীবর্দি খাঁ বা সিরাজউদ্দৌলার মত চরিত্ররা। যে সকল চরিত্ররা বাংলার ইতিহাসের পালা পরিবর্তন ও যুগসন্ধিক্ষণের নায়ক, তারাই আজ কতটা অবহেলিত। বাংলার ইতিহাসও তারজন্য দায়ী কম নয়। নবাব আলীবর্দি তাঁর মায়ের সমাধি ক্ষেত্র হিসাবে তৈরি করেছিলেন খোসবাগ নামক বাগানের। সেখানে তৈরি করেন মসজিদও। শোনা যায় তখন খোসবাগে এমন সব গোলাপ ফুটতো যা আর কোথাও পাওয়া যেত না।
আজও অনাড়ম্বর ভাবে সেই খোশবাগে শুয়ে আছেন নবাব আলীবর্দি ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কোনো তাপ উত্তাপ নেই। আজ আর তাদের পাত্রমিত্র নেই, সৈন্য নেই, নেই সেই জয়ের তাগিদ। মাটির নীচে তাঁরা আজও শায়িত তাঁদের মুর্শিদাবাদকে বুকের উপর নিয়ে।
আমার সাথে মুর্শিদাবাদের যে কিসের টান সত্যিই আমি জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝি যে ইতিহাসের টান অপার্থিব। এই অমোঘ টানকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই ছুটে যাই মুর্শিদাবাদে৷ সেই মাটি স্পর্শ করে ছুঁয়ে আসি নবাবদের গড়। আর মুর্শিদাবাদ গেলে একা গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছে করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে৷ আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতা গ্রাস করে ক্ষণিকের জন্য। সেখানে কোনো পার্থিব চিন্তা নেই। নেই কোনো জয়ের তাগিদ। মনে হয় শুধু একখণ্ড মাটি নিয়ে কেমন একাকী নীরবে আমার পাশে শুয়ে আছেন তামাম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার এককালের অধিপতি মনসুর উল্ক মুলক সিরাজউদ্দৌলা। আর তাঁর পাশেই একেবারে মধ্যমণি হয়ে আছেন বাংলার আকবর হিসাবে পরিচিত নবাব আলীবর্দি খাঁ। এই দুই সমাধির মাঝখানে একা বসে থাকি আমি৷ আর তাকিয়ে দেখি সেই সমাধিগুলোর দিকে৷ আজ সেখানে কেউ নেই৷ কোনো জৌলুশ ঘিরে নেই আজ তাঁদের। সব কত শান্ত৷
পলাশীর যুদ্ধের পরে পলাতক নবাব সিরাজকে বন্দি করে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। তারপর তাঁর মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে সারা শহরে ঘোরানো হয়৷ এই হল শাসকের পরিণতি৷ মুর্শিদাবাদে প্রায় সব শাসকদের মৃত্যুই অস্বাভাবিক। যদিও আলীবর্দি খাঁ বার্ধক্যজনিত রোগের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ কিন্তু তাঁর আদরের নাতি সিরাজের মৃত্যু বড় করুণ। আর তারপর শুরু হয় দেশে ইংরেজ শাসন। ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দ্বৈত শাসন চালু করে৷ বাকিটা ইতিহাস৷ প্রায় সকলের জানা৷
মুর্শিদাবাদ গেলে হোটেলে বসা হয় না। শেষ যেবার গেলাম, গরমের মধ্যেই সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছি এদিক ওদিক। খাওয়াদাওয়া অবধি হয়নি। পাছে সময় কম পড়ে যায়। ভোরে গিয়ে ভাগীরথী পেরিয়ে পৌঁছে গেছি খোশবাগের বাগানে। সেখানে পর পর একাধিক কবর পেরিয়ে যখন গিয়ে পৌঁছালাম সিরাজের কবরের পাশে, তখন সেখানে আর কেউ নেই। সম্পূর্ণ ফাঁকা খোশবাগ প্রাঙ্গনে আমি তখন একা। কিন্তু সেখানে বিরাজমান এক অদ্ভুত প্রশান্তি৷ সমাধির পাশে বসে কিভাবে যে কেটে গেল সময়, বুঝিনি। যখন একটু বেলা হল, একে একে বিভিন্ন মানুষ আসতে শুরু করলো খোশবাগে৷ আর আমি আর একবার ভালো করে কবরটির দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে৷ আমার তখন উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে৷ নবাবদের সাথে কিছুক্ষণ একা সময় যাপন। দৈনন্দিন দিনগুলিতে আজও আমি সবসময় সেই ঘরটিকে যেন স্বপ্নে দেখি৷ এখনো মনে হয়, নিজের অজান্তেই মুর্শিদাবাদের মাটিকে দোষারোপ করছেন নবাব সিরাজ আর তাঁর আশপাশে থাকা সকল শত্রুরা তাঁকে ঘিরে ধরে টেনে নামাচ্ছে মসনদ থেকে৷
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
বাহ! আজ আপনার পোস্টটি পড়ে যেন স্টিমিটে এ যাবতকালের যতগুলো পোস্ট পড়েছি সবচেয়ে ভালো লেগেছে এটি। লেখার সৌন্দর্যের জন্য নয়, প্রিয় নবাব সিরাজের সমাধি আর তার প্রিয় নানার সমাধির চিত্ররূপ তুলে ধরেছেন।
খুব খারাপ লাগছে, মীর জাফরের কবর আজ কত সমাদর পেয়ে চারপাশ অলঙ্কৃত করে রাখা আছে। অথচ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্রের বেলায় জুটলো অবিরাম অবহেলা । এ কষ্ট কাকে বোঝাই ?
বাংলার স্বাধীনতাটুকুু টিকিয়ে রাখার জন্য সিরাজ কি না করেছে, বারবার বিশ্বাসঘাতক সিপাহসালারকে বিশ্বাস করে আখেরে ঠকেছেন। চরম প্রতিদান দিল তার পাত্র অমাত্যরা।
ইতিহাস পুরোটা সত্য তুলে ধরে না, তাই তো ইতিহাস। কিন্তু যখন অনুমান করে বুঝতে পারি, সিরাজকে ধরে বেঁধে ইংরেজরা নিয়ে যাচ্ছে, লর্ড ক্লাইভ বলে গেছে, ' যদি আশেপাশের প্রজারা বা মানুষরা একটি করে ঢিল ছুড়তো, বাংলার স্বাধীনতা তখনো অক্ষুন্ন থাকতো৷!
মস্ত বড় আফসোসের কথা ! 🥲
যা হোক, যা হবার তা তো ঘটতোই। মুর্শিদাবাদ তথা খোশবাগে একদিন যাবই যদি কলকাতা যাওয়ার সৌভাগ্য হয় বাংলাদেশ থেকে। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতি আহবান থাকবে, অনুরোধ একজন বাঙালি হিসেবে যেন সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতি রক্ষার্থে ওনারা যত্নবান হোন।
এমন ঐতিহ্য যাতে কখনোই না হারিয়ে যায় কালের বিবর্তনে।
অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি পড়ে সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে, ❤️
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর করে বিস্তৃত আকারে মন্তব্য করবার জন্য। আমি মুর্শিদাবাদ গেলে হারিয়ে যাই। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তুলে আনার চেষ্টা করি সঠিক ইতিহাস। কিন্তু বর্তমানে সঠিক ইতিহাস বিকৃত। সব নবাবের সব স্থাপত্য না পেলেও কিছুটা আন্দাজ করা যায় যে মুর্শিদাবাদ ঠিক কেমন ছিল তখন। অবশ্যই আসবার আহ্বান জানালাম। নিজের সুবিধামতো কলকাতায় এসে সেখান থেকে মুর্শিদাবাদ ঘুরে যাবেন। স্বাগতম।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit