রাজা রামমোহন রায়ের জন্মস্থানে কাটানো একটি স্মরণীয় দিন। (ভিডিও সমেত) পর্ব - ২

in hive-129948 •  4 months ago  (edited)

রাজা রামমোহন রায়ের পৈতৃক ভিটেতে কিছুক্ষণ


🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱


Onulipi_08_02_09_38_24.jpg

☘️ সকলকে স্বাগত জানাই ☘️

আগের একটি পর্বে আপনাদের সামনে তুলে এনেছিলাম হুগলির রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায়ের বাস্তুভিটের বর্তমান ছবি। আজ সেই সিরিজেরই পরের পর্বে আপনাদের দেখাতে চলেছি আরো একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। রাজা রামমোহন রায় জন্মেছিলেন হুগলির খানাকুলে রাধানগর নামক গ্রামে। সেখানেই তাঁর পৈত্রিক ভিটে।

আমি যখন রাধানগর গ্রামে রামমোহনের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম তখন শুনতে পেলাম এই বাড়িটি তাঁর পৈত্রিক ভিটে নয়। ধর্মেকর্মে মতি না থাকায় রামমোহন রায়কে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন বাবা রামকান্ত রায়। গোঁড়া ব্রাহ্মণ বাড়িতে জন্মগ্রহণের পর ছেলেবেলা থেকেই তিনি ধর্মভ্রষ্ট। মূর্তি পূজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম হিন্দু ধর্মের আচার উৎসব তাঁর ছিল একেবারেই না পসন্দ। কিন্তু তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে এই ছেলেকে সেই ব্রাহ্মণ পরিবার মেনে নেবে তা চিন্তা করাও এক বাহুল্যতা। তাই পৈতৃক ভিটে থেকে রাজা রামমোহন রায়কে বেরিয়ে আসতে হয় একটা সময়। এমনকি সম্পত্তি থেকেও তাঁকে বঞ্চিত হতে হয় আজীবন। কিন্তু এসব বিষয়-সম্পত্তি ভাববার মানুষ আর যেই হোক, রাজা রামমোহন ছিলেন না। তাঁর উন্নত দার্শনিক চিন্তা এবং আধুনিক সমাজ ভাবনা তৎকালীন যুগের থেকে একশ বছর এগিয়ে ছিল।


রাজা রামমোহন রায়ের পৈত্রিক ভিটে

রাধানগর গ্রামে তাঁর সেই ভাঙাচোরা বাড়ি দেখে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো তবে তাঁর পৈত্রিক ভিটেটি আজ কোথায়? তবে কি তা আজ নেই? বা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে? স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে জানলাম পৈত্রিক ভিটে আজও আছে। তাই আর অপেক্ষা না করে এগিয়ে পড়লাম সেই গন্তব্যে। মাত্র কয়েক কিলোমিটার মেঠো রাস্তা দিয়ে বাইক চালানোর পর গিয়ে পৌঁছলাম রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায়ের আসল বাড়িটিতে। যদিও সেই প্রাচীন বাড়ির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে বিশাল রামমোহন স্মৃতি মন্দির। সেখানে ঢুকেই রামমোহন রায়ের আবক্ষ মূর্তি নজর কেড়ে নিল। আর পেল্লায় সেই বাড়িতে রয়েছে বিশাল এক প্রার্থনা গৃহ। এবং পাশে মন্দির। আপনারা সকলেই প্রায় জানেন রামমোহন রায় এমন একজন মানুষ, যিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার একজন মূল কান্ডারী ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে ছিল তার প্রাণের বন্ধুত্ব। আপনারা জানেন এই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরী ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদু। রামমোহন রায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তৎকালীন কলকাতায় সমাজ সংস্কার বিষয়ে হাতে হাত লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া দুই পথিকৃৎ। আধুনিক সমাজের যে অর্থ রামমোহন শিখিয়ে গেছেন, তা আজও কতজন মানুষ বহন করতে পেরেছে সে বিষয়ে সন্দেহ আছে ঘোরতর।

IMG_20240204_144151_069.jpg

যাইহোক আমি রাজা রামমোহন রায়ের পৈত্রিক ভিটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম তার সেই আবক্ষ মূর্তিটির দিকে। এই সেই বাঙালির রাজা, যিনি সতীদাহ প্রথা রদ করার উদ্দেশ্যে সারা বাংলা জুড়ে ছুটে বেরিয়েছিলেন নিজের অসুস্থ শরীর উপেক্ষা করেও। এবং সফল হয়ে তৈরি করেছিলেন ইতিহাস। বাঙালির আসল রাজা তো তিনিই। লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী আজও তাঁর চরণ উদ্দেশ্য করে নিজের অজান্তেই প্রণাম জানায় প্রতিনিয়ত।

IMG_20240204_144125_641.jpgIMG_20240204_144040_892.jpg

রামমোহন স্মৃতি মন্দির এবং প্রার্থনা গৃহ

সেই আধুনিক মানুষটির জন্মস্থানে নিজে দাঁড়িয়ে মুহূর্তটিকে অনুভব করার মত অনুভূতি জীবনে এক মাত্র কয়েকবারই আসে। যখন গিয়ে দাঁড়ালাম তার জন্মস্থান বা সূতিকা গৃহের সামনে, তখন যেন মনের সব চঞ্চলতা কেউ গ্রাস করল মুহূর্তে। উনবিংশ শতাব্দীর একটি দীর্ঘ সময় যেন সেই মঞ্চ থেকেই গড়া হয়ে গিয়েছিল একদিন। তারপর সেই যুগের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষটির পথ হাঁটা এই বাংলার মাটিতেই। তাঁর পৈতৃক ভিটে আজ নতুন ভাবে তৈরি হলেও তা ভীষণ সযত্নে সংরক্ষিত। এই বিষয়টি বেশ ভালো লাগলো। আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দিই বন্ধুরা। গিয়ে জানতে পারলাম রামমোহনের এই বাড়িটির জায়গায় বর্তমানে যে সভাগৃহ প্রস্তুত হয়েছে তার প্রধান নকশাটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই রাধানগর গ্রামে এই বাড়িটিতে আজও মিলেমিশে আছে মধ্যযুগীয় বাংলার নবজাগরণের একটি উল্লেখযোগ্য সময়।

IMG_20240204_144537_766.jpg

সূতিকাগৃহ। জন্মস্থান

সেখানে গিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের বংশধরদের মধ্যে বর্তমান এক ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁর সাথে গল্প করলাম বেশ কিছুক্ষণ। তাঁর থেকে জানতে পারলাম রামমোহন জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা। তারপর প্রবেশ করলাম বাড়িটির ভেতরে উপাসনা কক্ষে। সেখানকার শান্ত পরিবেশ এক মুহূর্তে মনের সব জটিলতা যেন দূর করে দিলো। মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল সব। তারপর বাড়িটি একবার প্রদক্ষিণ করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। সেদিন সারাটা দিন ধরে আমার উদ্দেশ্য ছিল রাজা রামমোহন রায়ের গ্রাম চষে ফেলা। ইচ্ছামতো কাজও করেছি অনেকটা। তা ধীরে ধীরে নিয়ে আসব আপনাদের সামনে। আজ রামমোহন রায়ের পৈত্রিক বাড়ি নিয়ে তৈরি করা এই পোস্ট আপনাদের ভাল লাগলে নিশ্চয়ই কমেন্ট করে জানাবেন এবং আপনাদের মন্তব্য ব্যক্ত করবেন।

IMG_20240204_144158_898.jpg

রাজা রামমোহন স্মৃতিমন্দিরে আমি


চিত্রগ্রহণের বিবরণ
চিত্রগ্রহণ
ইনফিনিক্স হট ৩০
ক্যামেরা
৫০ মেগাপিক্সেল
চিত্রগ্রাহক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
লোকেশন
রাধানগর


1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

44902cc6212c4d5b.png


Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

বাহ আপনি আজকে আমাদের মাঝে বেশ দারুন একটি পোস্ট লিখে শেয়ার করেছেন। আপনার পোস্ট পড়ে বাঙালি জাতির ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম সত্যি বেশ ভালো লাগলো আসলে এগুলো শুধুমাত্র বই পড়েছি এখন আপনার পোস্টে পড়ে সত্যি বেশ ভালো লাগলো। আপনি রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন আসল বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন এবং রাজার বংশধরের সাথে আপনি দেখা করেছেন এবং সেই সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। এত সুন্দর ভাবে পোস্টটি গুছিয়ে লিখে আমাদের মাঝে উপস্থাপনা করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই।

আমার এই ধরনের পোস্টগুলি আপনি পড়লে ভালো লাগে ভাই। আপনি ইতিহাস প্রেমিক জানার পর থেকেই মন থেকে ভালোলাগা জন্ম নিয়েছে। ইতিহাসের সূত্রগুলি নিয়ে কাজ করতেই ভালোবাসি। তাই কোন ইতিহাস প্রেমী মানুষ দেখলে তাকে বড় আপন মনে হয়। সঙ্গে থাকবেন।

সব সময় আপনার সঙ্গে আছি সামনের দিকে এগিয়ে চলুন। ধন্যবাদ ভাই।

রাজা রামমোহন রায়ের জন্মস্থানে কাটানো আপনার মুহূর্ত গুলো দেখে খুব ভালো লাগলো। রাজা রামমোহন বাংলা সাহিত্যের একজন প্রাণপুরুষ ‌। আপনার পোস্ট দেখে অনেক কিছু জানতে পারলাম। রামমোহন রায়ের পৈত্রিক বাড়ি নিয়ে তৈরি ভিডিওগ্রাফি আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

ধন্যবাদ ভাই। আপনি আমার পোস্ট করলেন বলে খুব ভালো লাগলো। সত্যই রামমোহন রায় এক মহান মানুষ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান ভুলবার নয়। তার সমাজ সংস্কার আজকের আধুনিক সমাজ গড়ার একটি প্রধান জমিন।

ব্লগটা তো পড়ে খুবই ভালো লেগেছে তবে ভাবছি এবারে গেলে সময় থাকলে একবার ঘুরে আসব।

এ সমস্ত ঐতিহাসিক জায়গা পা দিলে গা শিউরে উঠে। কারণ এই জায়গাতেই আমাদের পরমপুরুষ থেকেছেন,যিনি এত সাধন করেছেন। যার কারনে আমরা আজও গর্বিত বাঙালি।

একদম৷ নিয়ে যাব। গেলে দারুণ ভালো লাগবে৷ এইসব জায়গায় গেলে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাভ করা যায়।

রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে অনেক পড়া রয়েছে তাছাড়া তার বিশেষ কীর্তি এখনো তাকে মনে করায়।আপনি তার পৈতৃক ভিটায় গিয়ে দারুন সময় কাটিয়েছেন।তাছাড়া সেই মুহূর্তের পোস্ট গুলো শেয়ার করেছেন।আবার রাজার বংশধরের সাথে দেখা করেছেন এবং বিষদে জেনেছেন।ভালো লাগলো পোস্টটি ।ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।

আপনার সুচিন্তিত মন্তব্য খুব ভালো লাগলো। সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। রামমোহন বাংলা নবজাগরণের এক পথিকৃৎ। তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। তিনি প্রণম্য