🌸নমস্কার বন্ধুরা🌸

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

---

নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত

---

• কফি হাউসে চল বসি?

• কেন ? তোকে যে বলেছিলাম দেখা হলেই ঐতিহাসিক জায়গায় নিয়ে যাব।

• তা বলেছিলি, কিন্তু এখানে বই দোকান আর কফিহাউস ছাড়া আর আছে কি?

• অনেক আছে, চল আমি নিয়ে যাব তো।

• ঘোড়ার ডিম আছে। তিন বছর ধরে এখানেই রোজ কলেজে এসেছি আমি জানি না?

• জানিস নাই তো দেখছি। চল তোর কলেজের সামনে দিয়েই নিয়ে যাবো৷

• চল৷ মনে রাখিস এটা আমাদের প্রথম দেখা। ঘেঁটে দিস না সব কিছু।

• আমি জানি রে পাগলি, তুই স্মৃতি তৈরি করতে ভীষণ ভালোবাসিস। আমাকে ভরসা করিস না?

• করি বলেই তো হাজার জনের ভেতরে তোর সাথেই দেখা করতে এলাম৷

• তবে চল...

প্যারামাউন্ট, কলেজস্ট্রিটের ঐতিহ্য

কি ভাবছেন বন্ধুরা এ কেমন ব্লগের সূচনা যেখানে কথপোকথন দিয়ে শুরু করছি! প্যারামাউন্টের সূচনাটা আমার এমনই হয়েছিল৷ আজ সেই নিয়েই গল্প করব আপনাদের সাথে। তার আগে বলুন আপনারা কেমন আছেন? জায়গায় জায়গায় কম বেশি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আশাকরি যেখানে যেখানে খুব গরম সেই জায়গাগুলোতেও বৃষ্টি এসে যাবে আর সক্কলের মনে শীতল প্রশান্তি ছেয়ে যাবে৷ আমিও বেশ ভালো আছি৷ আমার এখানে বৃষ্টির মেঘ থাকলেও যখন তখন নীল আকাশ বেরিয়ে পড়ছে। ঘরের বারান্দা থেকে পশ্চিমঘাটের ওপর এই মেঘছায়া দেখতে আজকাল খুবই মনোরম লাগে৷

প্রবাসে যতই থাকি মন কিন্তু আমার প্রিয় বাংলাতেই পড়ে থাকে। কত কি মনে পড়ে৷ সেই স্মৃতির ঝুলি থেকেই আজকের ব্লগ শুরু করেছি। আমার খুব প্রিয় বন্ধু যে একদিন ভার্চুয়াল বন্ধু ছিল, তার সাথেই প্রথমবার গিয়েছিলাম প্যারামাউন্টে৷ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এই বিখ্যাত দোকানটি আমার কলেজের সামনেই পড়ে৷ তিন বছরে কোনদিন চোখে পড়েনি আর খেতেও যাইনি৷ চোখে পড়বেই বা কি করে? এতো ভিড়ের মধ্যে এমন দোকান চোখে পড়াটা কি খুব সোজা? যেখানে মুখের সামনে পরিচিত কেউ চলে গেলে আমার চোখে পড়ে না৷ সেদিন বন্ধুর পাশে হাঁটতে হাঁটতে গল্প শুনছিলাম প্যারামাউন্ট কেন এতো বিখ্যাত৷

দোকানের ভেতরের দেওয়াল

প্রেসিডেন্সির সামনে কফি হাউসের গলি দিয়ে খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই কবিতা প্রিয় মানুষরা জানেন মহাবোধি সোসাইটি হলের কথা৷ মহাবোধি সোসাইটি, অভিজান বুকস্টল পেরিয়েই প্যারামাউন্ট, যার প্রথম নাম ছিল প্যারাডাইস৷ অর্থাৎ জান্নাত। ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দ অর্থাৎ প্রায় একশ' বছর আগে যখন ভারতের ম্যাপ অনেক বড় ছিল, তখন বলিশাল থেকে কলকাতায় এসে সরবতের দোকান খোলেন বিপ্লবী নীহাররঞ্জন মজুমদার। কলেজস্ট্রিট বই পাড়া হিসেবে বিখ্যাত হলেও কলেজের কমতি নেই৷ ছাত্রছাত্রী সমেত বই প্রেমীদের ভিড়ে কলেজস্ট্রিট যুগ যুগ ধরেই। গরম কালের তৃষ্ণা মেটাতেই এমন পরিকল্পনা৷

যাঁরা একদা আসতেন

দেওয়াল জুড়ে সমস্ত বিখ্যাত মানুষদের নাম দেখে জানতে চাইলুম এনারাও আসতেন? আমার বন্ধু তখন হাসতে হাসতে বললে "ওটাই তো আসল রে", ভ্রু কুঁচকে তাকালাম, বললে, তৃষ্ণা মেটানো স্পেশাল সরবত এসব আসলে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দেওয়ার সোজা পদ্ধতি, (ততক্ষণে আমরা জায়গা খুঁজে বসে পড়েছি, সামনের পর্দা ঘেরা আর্ক এর কুঠুরিটা দেখাল, বলল, এই চোরাকুঠুরিকে ঢেকে রাখার জন্য এই সরবত ব্যবসা। তাছাড়া ব্যবসা করলে কিছু টাকাও আসে৷ অর্থাৎ রথ দেখা ও কলা বেচা দুই হবে৷

গোলাপি আর্ক, কুঠুরির দরজা

ওই কুঠুরি তে কি হত জানেন বন্ধুরা? বোমা বাঁধা থেকে নানান বিল্পবী মিটিং, আলাপ আলোচনা, এখানে নেতাজীও পর্যন্ত আসতেন৷ ভেতরটা জানেন এখনও সেই একই ধাঁচের৷ ইতালিয়ান মার্বেল পাথরের টেবিল, কাঠের বেঞ্চ৷ এসব শুনে আমার গায়ে শিহরণ দিচ্ছিল রীতিমতো। এসবের মাঝেই আমরা অর্ডার করলাম ডাব সরবত৷ ও প্রথম থেকেই বলত, "দেখা হলেই তোকে ডাবের সরবত খাওয়াব।" আমি ভাবতাম ডাবের সরবত! সে কেমন ভার্জিন মোহিতোর মতো? নানান ধরণের রান্নাবান্নার পাশাপাশি নানান ধরনের সরবত সহযোগে অতিথি আপ্যায়নটা আমার একটা বাতিক বলতে পারেন৷ তাই হয়তো আমি একটু বেশিই উৎসাহিত ছিলাম। আর গল্প শুনে উত্তেজনার শেষ ছিল না৷

ডাবের সরবত

অনেকটা সময় নিচ্ছিল সরবত আসতে৷ ততক্ষণ দোকানের ভেতর চোখ বোলাচ্ছিলাম। ওইটুকু দোকানে একটি সিটও খালি নেই। আর কারোও কোন বিরক্তিও নেই এতো ভিড় দেখে৷ সবাই যেন এই ঐতিহ্য পালকির বেহারা৷ ও বলছিল৷ এই ডাবের সরবতের রেসিপি নাকি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তৈরি৷ একদিন উনি নীহাররঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন সরবত হবে ছাত্রছাত্রীদের সাধ্যের মধ্যে৷ গরমের দিনে তারা এক গ্লাস সরবত খেয়ে একসাথে পিপাসা ও ক্ষণিকের খিদেও যেন মেটাতে পারে এমন কিছু মেনু কার্ডে রাখতে৷ সেই হিসেবেই ডাবের সরবতের কথা ভাবা হয়েছিল, প্রফুল্লচন্দ্রই বলে দেন কিভাবে সরবত তৈরি হবে আর গ্লাসের মধ্যে দেওয়া হবে ডাবের নরম দুধ সাদা মালাই৷ বর্তমান যিনি ক্যাশে বসেন উনি বললেন সেই রেসিপিই আজও চলে৷ তবে কাউকেই বলা হয়না ওই রহস্যময় অপূর্ব স্বাদের সরবতে আসলেই কি কি মেশানো আছে৷

নিজাম প্যালেস থেকে কেনা হরিণের সিং

অবশেষে ডাবের সরবত এলো, আর আমি এতো গল্প শুনে থাকতে না পেরে একটানেই অর্ধেক গ্লাস খালি করে ফেললাম। তারপর ভাবলাম এতো বিখ্যাত জিনিস রয়ে বসে খাওয়া ভালো৷ তাই গ্লাস নামিয়ে রেখে ঘরের চার পাশে দেখতে শুরু করলাম৷ সামনে দুটো হরিণের সিং ঝোলানো আছে৷ আর চারপাশে অনেক বিল্পবীদের ছবি৷ আমি ভেবেছিলাম কাঠের তৈরি করা হরিণের সিং দুটি, বন্ধু বলল না, সিং দুটি নীহাররঞ্জন মজুমদার নিজেই হায়েদ্রাবাদের নিজাম প্যালেস থেকে নিলামে কিনে এনেছিলেন। সেই থেকে আজও ওই দুটি শোভা বর্ধক ডান দিকের দেওয়ালে৷

মেনুকার্ড, আজকের দাম লেখা

জানেন বন্ধুরা এই ডাবের সরবত খেতে খেতেই দেখলাম আসে পাশের লোকেরা কেউ গোলাপী, কেউ সবুজ ইত্যাদি রঙের সরবত খাচ্ছেন৷ মেনু কার্ডে চোখ বোলালাম৷ অদ্ভুত সব নাম না জানি খেতে কেমন। ভালোই হবে নিশ্চই এতো মানুষ আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছে যেখানে। শুনেছি অনেকেই এই দোকানের শাখা খুলতে চেয়েছে। বর্তমান মালিক তা চান না। এই এক জায়গাতেই প্যারামাউন্ট তার ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে থাকবে এরমই তাঁদের আশা।

এমনই ছিল আমাদের কলেজস্ট্রিটে প্রথম দেখা হওয়ার চমৎকার দিন। সেই বন্ধু আজও আমার প্রিয় বন্ধু। আপনাদের ভার্চুয়াল বন্ধুরা প্রকৃত বন্ধু হয়েছে কোনদিন? তবে অবশ্যই শেয়ার করুন সেই গল্প৷ আর কলকাতার বন্ধুদের বলছি গেছেন এই প্যারামাউন্ট-এ? বাংলাদেশের বন্ধুরা, কলকাতা এলে প্যারামাউন্টের সরবত না খেয়ে দেশে ফিরে যাবেন না, এ আপনাদের মাটির সন্তানেরই প্রতিষ্ঠা করা ঐতিহ্য। জানেন, সৌরভ গাঙ্গুলিরও প্রিয় সরবতের জায়গা এই প্যারামাউন্টই৷ আপনাদেরও নিশ্চই ভালো লাগবে৷ আর সেই ভালোলাগার গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

তাহলে বন্ধুরা, কেমন লাগল আজকের ব্লগ? কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না৷ আবার আসব একটি অন্য গল্প নিয়ে। ততক্ষণ আপনারা ভালো থাকুন। আজ আসি?

টাটা!

সব ছবিই আমার স্যামসাং গ্যালাক্সি মুঠোফোনে তোলা

~লেখক পরিচিতি~

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। তবে বর্তমানে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ বর্তমানে ভারতবর্ষের পুনে তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।

---

কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾

---