🍁নমস্কার বন্ধুরা🍁

🙏🙏🙏

---

নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত

🪷🪷🪷

---

কেমন আছেন বন্ধুরা? শোকাহত পরিবারের কুশলমঙ্গল জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর পাওয়া যায় জানি না তাও মনখারাপের মধ্যেও সবার সুস্থতাটুকু কামনা করে আজকের পোস্ট শুরু করছি।

কবি হিসেবে মনখারাপ বা আনন্দ যাই ঘটুক আমার নিত্য সঙ্গী বই। ঘরে তো অনেক বইই আছে তাও কিছু কিছু বই আশ্রয়ের মতো। যার অক্ষরের ভেতর ডুব দিলে দেখতে পাই সৃষ্টির গর্ভ৷ সেরকমই একটা বই টেরাকোটার আঙুল। বইটি একটি কবিতার বই। আর কবি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় কৌশিক চক্রবর্ত্তী। @kausikchak123

মূর্তি স্থাপন হলে সহনীয় উচ্চতা
ঘরোয়া চাঁদোয়ার নীচে তখনও নিশ্চিন্ত সহবাস...
কেবল
শূন্যস্থান পূরণের উদ্দেশ্যে নির্জলা উপবাস বাকি-

... উচ্চতা সম্পর্কে আমি কোনদিনই খুব একটা ওয়াকিবহাল নই। ভার্টিগো নেই। তাও একাকী পর্বতের ধার কিংবা সম্পর্কের চরমতম উচ্চতায় দাঁড়িয়ে কখনও শূন্য হয়ে পড়ে যাবার ভয় করি আবার কখনও জন্মস্থানের রাস্তাঘাট খুঁজে জড়ো করি অক্ষর বন্ধু। "টেরাকোটার আঙুল" পড়ে নিজের ভেতরের এই বলয়বদ্ধ আমিটুকু চিনে নিলাম।

অনেকদিন আগেই শেষ করেছি। তবে আবার শুরু করে বার বার শেষ করার মতো একটি বই এর কথা বলছি। "টেরাকোটার আঙুল" - কবি কৌশিক চক্রবর্ত্তী। টেরাকোটার আঙুল মানে কি? আঙুলে টেরাকোটা ভাস্কর্য নাকি লাতিন শব্দের হাত ধরে বলব পোড়ামাটির আঙুল? কবি নিজেকে কতখানি পুড়িয়ে এমন একটি দুই মলাটে ঢাকা চার ফর্মা লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন সেটি বইটি না পড়লে বোঝা যায় না৷ বইএর উৎসর্গ পাতাতেই শব্দের খেলা। স্পষ্ট উচ্চারণ "নির্জনতায় ভাগ হয় না ধুলো মাখার অধিকার" সত্যিই তো কিছু অধিকার ভাগ করা যায় না৷ তিন লাইনে উনি বুঝিয়ে দিলেন দৈর্ঘ্যহীন আঙুল ধরেই বাকি চৌষট্টি পাতা আমাদের এগোতে হবে৷

উচ্চারণ করতে না পারলেও
আমি প্রতিদিন নিয়ম করে খালিপেটের কথা বলি-

ফিনিক্সের ডানায় করে বাকিবর্তা ঋণশোধের স্বীকারোক্তি করেছেন। আরও স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন কবির মতো অনেক দলাপাকা মানুষ ও মুখোমুখি ওইপার, লড়াই যতই হোক ঋণের দাগ সর্বত্র। তাই তো! জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের ঋণজাল বোনা হয়ে যায়। বোনা হয়ে যায় অধিকার সংক্রান্ত নির্বিকার রাস্তার বাঁক। কোথাও থেমে যাওয়া নেই অথচ নিলাম আছে। নিলামে ওঠা প্রাণহীন শরীরকে সামনে রেখে একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা চিহ্ন -

নিজেকে গতিশীল প্রমান করতে পেরেছি কি?

জানিনা আমরা কতটা গতিশীল। তবে আমাদের চিন্তা এবং শব্দের হাত থেমে থাকার নয়৷ যে কারণে কবিতা লেখার জীবনকে আমরা পথ বলে উচ্চারণ করে থাকি। এখানে রূপকের হাত ধরলে শব্দ মন্থনে উঠে আসে গাণিতিক ফর্মুলা সমেত পিথাগোরাস, কলোনিয়াল মাঝরাত, টিনের ছাদ, ভেষজ অভিমান ইত্যাদির নিপুণ প্রয়োগ। এতোদিন কবির ছন্দ কবিতায় বুঁদ হয়ে থেকেছি। কিন্তু টেরাকোটার আঙুল খুব স্পষ্টই দেখিয়ে দিতে চায় গদ্য কবিতাতেও কবির কতখানি শিরোনামসহ ঝকঝকে মেজাজ৷

পড়তে পড়তে চোখ আটকায় -

রুমাল ছাড়া সবকিছু ব্যক্তিগত।

আহা কি সুক্ষ্ম প্রয়োগ। খুব সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা সকলেই জানি রুমাল মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবহার। কিন্তু এখানে রুমালের ব্যক্তিগত কোণ কবিতাটির লাইনগুলো একটু অন্যরকম করে ভাবতে বাধ্য করে। যেখানে কবি বিপরীতধর্মী ঘুমের জন্য শোবার জায়গা দাবী করছেন। বলছেন,

জড়িয়ে ধরবার জন্য ক্ষণজন্মা হতে হয়।

সকলেই কি জড়িয়ে ধরতে পারে? নাকি জড়িয়ে বাঁচতে পারে? না পারে না৷ গাছেদের জড়ানো কিংবা একটা আঙুল জড়ানোর জন্য ক্ষণজন্মা হতে হয় বৈকি। আর সেই ক্ষণজন্মার দিকেই যেন অধিকারের গোপন বিকেল যেখানে সনাতন হয়ে উঠছে বাঁচার ইচ্ছে৷

এর পর যে কবিতাটির কথা না বললেই নয় সেটি হলো সাইকো৷ শুরুতেই লিখেছেন -

অতয়েব আমি সাইকো

খুব নরম মনের ব্যতিক্রমী মানুষরা যেমন হয় তাদের কথা লিখেছেন। নক্ষত্রের আলো কুড়িয়ে তোলে সমস্ত বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী মানুষরা৷ কিন্তু কবি লালন করছেন নক্ষত্রের গোপন ছায়া৷ ওই ব্যতিক্রমীর ভিড়ে সকলের থেকে সরে গিয়ে কবি নিজের কথা বলছেন৷ চিহ্নিত করছেন

হেরে যাওয়া সাইকো অভিমান।

অভিমান হেরে গেলেই যেন সাইকো হয়ে যাওয়া হয়। মানে মানসিক অসুস্থতা। শরীরের মতো মনের রোগ। যার উপসর্গ দেখলে আমজনতা অদ্ভুত ঠাওরায় কিংবা ভাবে বর্তমান সমাজের জেনারেশন গ্যাপ! কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের ভেতর দুটো ছেড়ে অনেকগুলো আমি কে পুষে রাখি। যার কেউ কেউ পাগলামি সহ মানসিক দোলাচলে সর্বদাই ভোগে৷ এই কবিতা সুচারু দীপ্তি নিয়ে অভিমান বাঁচিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কথা বলছে৷

এভাবেই একের পর এক কবিতার শরীরে গাছ নির্মাণ করেছেন কবি কৌশিক চক্রবর্ত্তী৷ বাস্তবতার পটভূমিতে কখনও একটি মেয়ের কথা লিখছেন কখনও বাবার কথা কখনও আবার ছোট ছোট লড়াইএর মাধ্যমে তুলে এনেছেন খিদে, টিকে থাকা নৌকার প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি। নিজেকে ভেঙেই নিজেকে নতুন করে গড়তে হয় আর তাতে ইগোর ছায়াদৌড় রাখতে নেই সে স্বীকারোক্তি ভয়ংকর ভাবে উল্লেখযোগ্য। এ তো সতিই জীবনের সার কথা৷ ক্রমশ এগিয়ে যাবার জন্য প্রতি বাঁকে নিজেকে নিপুণ হস্তে ভাঙতে হয়৷ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হয়। তবে না নতুন সৃষ্টি। নতুন জন্ম। নতুন প্রজন্ম। নতুন করে উচ্চতা ছাড়িয়ে আরও ওপরে ওঠা। তবে কি নিজেকে ভাঙা একটা কৌশল। সেই কৌশল জানতে হয়। শিখতেও হয়। নইলে নিজেদের নামাঙ্কিত নদীর স্রোতে নির্বাক ভেসে যেতে হয়। কিংবা গন্তব্যে ছুটতে গিয়ে গন্তব্য পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় কোন এক কোথাও৷

চোখে চোখে কীভাবে যেন চলে এসেছি পঁয়ত্রিশ নম্বর পাতায়, যেখানে তারাখসা কবিতায় কবি লিখছেন

যে নগরে খসে পড়েনি স্বাবলম্বী উল্কাপিণ্ড / সেখানে খুঁজে দেখেছি নির্বিবাদী মানবীর ছায়া

আর দু হাত পেতে ভরে নিচ্ছেন

উদ্বৃত্ত তারাদের শোক আর ভাঙাচোরা কয়েকটা চাঁদ

যা না ভরলেও চলত৷ কিংবা যাদের আশ্রয় না দিলেও চলত৷ কিন্তু জেনেশুনে বিষ করেছি পান মেনেই তারাখসার রাতে জেগে কাটিয়েছে। অপূর্ব প্রয়োগ৷ এই রূপকের আড়ালে দেখি কবির বুকের ভেতর জমা আছে একটি নরম উপত্যকা৷ যেখানে অহরহ বৃষ্টি হয়, যার মাটি ভেজা আর সবুজ বলতে অল্প খানিক নরম ধান, নীল বলতে মুখের ওপর ঝুলতে থাকা নক্ষত্রে ঠাসা আকাশ৷

কবি অন্ধকার ভালোবাসেন। ভালোবাসেন আঙুলের ইতিবৃত্তান্ত৷ তাই খুব সহজে অন্ধকারের নামকরণ করে আলো নিয়ে জিগস পাজল খেলে গেছেন লোডশেডিং কবিতায়। অথচ পোড়া শরীরে যতবার হাত দিতে গেছেন ততবার দায়ী হয়েছেন লোডশেডিং হবার দায়ে। অন্ধকার প্রিয় মানুষের জীবনে এর থেকে বেশি কি আশা করা যায়? তারা হাঁটতে সাবলীল আর সাবলীল সিঁড়ি ভেঙে দাঁতের হিসেব করতে৷

টেরাকোটার আঙুলের এক একটি কবিতাকে আমি এক একটি নদী ভাবলে বলতে পারি প্রতিটি কবিতারই নিজস্ব বাঁক আছে। এবং বয়ে চলাও আছে৷ যা প্রচন্ড ভাবে আত্মনির্ভরশীল৷ আর এখানেই কবি পাঠকের প্রতি সৎ ও স্বচ্ছ। অতিরিক্ত রঙ দিলে যেমন ছবি বিগড়ে যায় তেমনি অতিরিক্ত শব্দের খেলাও কবিতাকে অহেতুক কঠিন করে তোলে। সারা বইতে এমন কোন পংক্তি নেই যেখানে এই কথাগুলো বলে বইটিকে হোঁচট খাওয়ানো যেতে পারে।

বইটির বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ স্বরূপ রয়েছে পঞ্চাশ ও একান্ন নম্বর পাতা। ছাতার মতো শিরোনাম- যেকটি বিচ্ছিন্ন আঙুল এবং তার তলায় অনেকগুলি শিশু সন্তান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আটটি ফোর লাইনার৷ যে যার নিজস্ব নাম নিয়ে৷ অর্থাৎ কেউই বেওয়ারিশ না৷ এই দুই পাতা দেখে আমার একান্নবর্তী পরিবারের কথা মনে পড়ল। যেভাবে দাদু ঠাকুমার ছায়ায় কাকু পিসিরা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিয়েছে দীর্ঘ জীবন৷ এখানেও অনেকটা সেই রকমই আদল। আসলে প্রতিটি অভিভাবকেরও যে অভিভাবক থাকে সে কথা কবি ভোলেননি।

বই যে মনের উথালপাথালের বড় সঙ্গী একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বইটি আবারও পড়ে যে প্রতিক্রিয়া জন্মেছিল তা নিজের মতো করে সাজিয়েছি। আপনাদের কেমন লাগল জানাবেন।

কাল আবার আসব নতুন কিছু নিয়ে৷ আজ আসি। আপনারা সকলেই সুস্থ থাকুন নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ঈশ্বরের কাছে এই কামনাই করি। ভালো থাকবেন।

টাটা।