ভারতবর্ষে তখন দিল্লি সালতানাতের শাসন চলমান। মুহাম্মদ বিন তুঘলক আসীন আছেন দিল্লির রাজসিংহাসনে। রাজ্যের মন্ত্রীদের মধ্যে মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ফিরোজ-বিন-রজব বিশেষ প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় রেখেছিলেন। আলী মুবারক নামে ফিরোজের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী একদিন এক নওজোয়ানকে নিয়ে হাজির হলেন রাজদরবারে, করলেন ওই নওজোয়ানের চাকরি মিনতি। নওজোয়ানের নাম ছিল ইলিয়াস, তার মা ছিলেন আলী মুবারকের ধাইমা। আলী মুবারকের উপর বিশ্বাস রেখে ইলিয়াসকে চাকরিতে নিযুক্ত করলেন ফিরোজ।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকল। এমন সময় এক ভজকট পাকালেন ইলিয়াস। ফিরোজের এক উপপত্নীর সাথে গভীর প্রেমে মশগুল হয়ে গেলেন তিনি। সেই ঘটনা ফিরোজের কানে পৌঁছানোর পর তিনি ইলিয়াসের জামিনদার আলী মুবারককে নির্দেশ দেন বিশ্বাসঘাতক ইলিয়াসকে পাকরাও করার জন্য। কিন্তু ইলিয়াস এই বিপদের আঁচ আগে থেকেই টের পাওয়ায় মাকে নিয়ে দিল্লি থেকে পালালেন।
ইলিয়াস আলী মুবারকের হাতছাড়া হওয়ায় মুবারকের উপর বেজায় চটলেন ফিরোজ। তাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। ঘোর অপমানের শিকার হয়ে নতুন জীবিকার সন্ধানে দিল্লি ছেড়ে লখনৌতি এলেন আলী মুবারক। সৎ, নিষ্ঠাবান, ও পরিশ্রমী আলী মুবারক লখনৌতির তৎকালীন প্রশাসক কদর খানের নজরে এলে তিনি আলী মুবারককে সেনাবাহিনীর কোষাগার নিয়োগ দেন। একাগ্রতার সাথে সফলভাবে নিজ কাজ ঠিকঠাকমতো করায় তার সুনাম চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। তা কানে গেলো ইলিয়াসেরও। আবারও তিনি এক চাকরির আর্জি করে আসলেন আলী মুবারকের নিকট।
পূর্ব কর্মকাণ্ডের জের ধরে আলী মুবারক ইলিয়াসের উপর রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। হাতের নাগালে পেয়ে বন্দি করলেন ইলিয়াসকে। নিজ মা এবং ধাইমার (ইলিয়াসের মা) অনুরোধে মন গলে আলী মুবারকের। তিনি ইলিয়াসকে ক্ষমা করে দিয়ে সপ্তগ্রামে আজম-উল-মুলকের সেনাবাহিনীতে চাকরি দেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বুদ্ধিকৌশলে পটু ইলিয়াস নিজ গুণেই দুই বছর পর সেনাপতি পদে উন্নীত হলেন।
কদর খানের মৃত্যুর পর ফখরউদ্দিন মুখলিস নামে এক ব্যক্তিকে লখনৌতির প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। আলী মুবারক আইনের এই লঙ্ঘন মেনে নিতে পারেননি বলে মুখলিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন মুখলিস। ফিরোজাবাদ (পাণ্ডুয়া) এবং লখনৌতির বাসিন্দারা আলী মুবারককে মেনে নেন তাদের অস্থায়ী শাসক হিসেবে। আলী মুবারককে তখন লখনৌতির শাসক হতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ইলিয়াস। কিন্তু নিয়মনিষ্ঠ আলী মুবারক তাতে সায় দেননি।
সপ্তগ্রামে আজম-উল-মুলকের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন আলী শাহ এবং ফখরউদ্দিনের দেখানো পথে হাঁটেন ইলিয়াস। তিনি নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোহে অন্ধ হয়ে মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ক্ষমতার লোভে পরোপকারী বন্ধু আলাউদ্দিন আলীর সাথে যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। সেই যুদ্ধে যেভাবেই হোক আলাউদ্দিন আলীর দেহরক্ষীদের হাত করে ফেলেন ইলিয়াস। ফলে নিজ দেহরক্ষীদের হাতেই খুন হন আলাউদ্দিন আলী। ইলিয়াস শাহ তখন হয়ে যান ‘শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ’। বসেন লখনৌতি-সপ্তগ্রামের গদিতে। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৩৪২ সাল।
পুরনো প্রথার খোলস ভেঙে প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন ইলিয়াস শাহ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বিগত শত বছরে মুসলিম শাসকেরা তাদের যুদ্ধবাহিনী সাজিয়েছেন ঘোড়ার উপর ভিত্তি করে। নিয়োগপ্রাপ্ত ঘোড়সওয়াররা সকলেই ছিলেন মুসলিম। এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসেন ইলিয়াস। তিনি প্রশাসনিক কাজকর্মে অনেক হিন্দু ব্যক্তিকে নিযুক্ত করার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও প্রচুর পরিমাণে হিন্দু লোকের সমাগম ঘটালেন। বাঙালী সেনাদের নিয়ে বৃহদাকারের পদাতিক সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন তিনি। বাঙালী মাঝিমাল্লা সহযোগে গড়ে উঠল বিশাল নৌবহর, শুধুমাত্র ফখরউদ্দিনের হামলা ঠেকানোর জন্য।
দুই বছরে সামরিক শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে সপ্তগ্রাম থেকে উড়িষ্যার দিকে পা বাড়ালেন তিনি। ওই আক্রমণ সামলাতে ব্যর্থ হলেন উড়িষ্যার সম্রাট নরসিংহ দেব এবং তার ছেলে ভানুদেব। একে একে জয়পুর, কটক, চিল্কা হ্রদ জয়ের পর ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ইলিয়াস শাহ। তিনি ভাবলেন, অনেক হয়েছে, এবার রণে ক্ষান্ত দেওয়া যাক। লুটকৃত ধনদৌলত, হাতি-ঘোড়া নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন তিনি। তবে কথায় আছে, উড়ে যায় পাখি, রেখে যায় পালক। ইলিয়াস শাহের মাধ্যমেই উড়িষ্যার উপর বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করা হয়।
আমৃত্যু রাজ্যের সীমানা বিস্তার এবং শাসনে মনোযোগী ছিলেন ইলিয়াস শাহ। যোগ্য একজন শাসক হিসেবে নিজ পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। মুসলিম সুফিসাধকদের প্রতি অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল তার। আখি সিরাজউদ্দীন, আলাউল হক, রাজা বিয়াবানির মতো যশস্বী সুফিসাধকদের জন্য তিনি মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ করেছিলেন। বিচক্ষণ এই সুশাসক জানতেন, সালতানাতের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব বৃদ্ধিকরণ এবং সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিমত উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই, বহু হিন্দু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
পুরো ভারতবর্ষে বাংলার গুরুত্বকে জ্বলন্ত শিখার ন্যায় তুলে ধরেছিলেন শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ। বাংলার লোকেদের দিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র পরিচয়। ২ লাখ ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এক অঞ্চলকে তিনি বেধে দিয়েছিলেন একক রাজনৈতিক ও জাতিগত পরিচয়ে। ১৩৫৮ সালে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে আসীন হন তাঁর সুযোগ্য সন্তান সিকান্দর শাহ।
টাইপ: চৌর্যবৃত্তি।
এ ধরনের পোস্ট আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটি Allow করে না। নতুন ইউজার হওয়ার কারণে শুধুমাত্র আপনার পোস্ট Mute করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার একই ধরনের কাজ করলে আপনার একাউন্ট কমিউনিটি থেকে ব্যান করা হবে।
কমিউনিটির নিয়মাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন
https://steemit.com/hive-129948/@rme/last-updated-rules-of-amar-bangla-blog-community-16-aug-22
যে কোন বিষয়ে জানার প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে Discord এ যোগাযোগ করুন।
Discord server link: https://discord.gg/ettSreN493
Source: https://archive.roar.media/bangla/main/history/biography-of-shamsuddin-ilyas-shah
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit