আমি এতে বাড়তি বলতে দুটো আলু দিয়েছি

in jjh •  3 years ago 

বাঙালির এ' এক হারিয়ে যাওয়া রেসিপি!

দেশভাগের আগের কথা। ব্রিটিশ আমলে চালু হয়েছে রেলপথ। ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়া যেত ট্রেনে। কিন্তু পুরোটা রাস্তা ট্রেন যেত না।

কলকাতার গঙ্গার ওপারে, হাওড়ার দিকে ছিল 'ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে', আর গঙ্গার এপারে ছিল 'ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে', একেবারে বাংলা পেরিয়ে বর্মা অবধি।

শিয়ালদা থেকে রাতে ছাড়ত ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস। পরদিন সকালে সে ট্রেন এসে পৌঁছত গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে।

ব্রহ্মপুত্র সেখানে যমুনা নাম নিয়ে এসে মিশে গিয়েছে গঙ্গায়, জন্ম নিয়েছে পূর্ববঙ্গের প্রাণভোমরা পদ্মা। বিশাল মোহনা, এপার ওপার ঠাহর করা মুশকিল।

সেখান থেকে ছাড়ত স্টিমার। নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, কাছাড়, সিলেট, চাঁদপুর অবধি স্টিমার যেত।

সেই স্টিমারের মাঝিদের হাতে জন্ম এই রান্নার—বিখ্যাত 'গোয়ালন্দ ফাউল কারি' বা 'স্টিমার কারি!'

ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের হাতে কিছু বিশিষ্ট দিশি রেসিপির জন্ম হয়— যেমন রেলওয়ে মাটন কারি বা চিকেন ডাকবাংলো।

সেসব এখনও টিকে আছে। এই গোয়ালন্দ স্টিমার কারিও তাদের একটি। বহু বিশিষ্ট বাঙালির মুখে, লেখায়, গল্পে রয়ে গেছে এই রান্নাটি।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, "সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ। ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা।...

এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই।

...কীরকম ভেজা-ভেজা, সোঁদা-সোঁদা যে গন্ধটা আর সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার।

...এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে-কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়।

তারপর হয় দেশভাগ, দাঙ্গা, ধর্মীয় হামলা, ঘর ছেড়ে, ভিটে ছেড়ে পালানো। বাংলাও দু'ভাগ হয়ে যায়।

সেই দেশ স্বাধীন হবার পরেও ১৯৬৪ সাল অবধি চলত সেই প্রবাদপ্রতিম ট্রেন। তারপর ভারত-পাক যুদ্ধ লাগতে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।

সম্ভবত, গোয়ালন্দ ঘাটেরও গৌরবে ইতি ঘটে। ফলে স্টিমার সার্ভিসের রমরমা বন্ধ হয়ে যায়। বিখ্যাত স্টিমার কারিও বিস্মৃতির দিকে পা বাড়াতে থাকে।

এই রান্নার মজাটাই হল এর সাধারণ সহজ রেসিপি! এ' রান্নায় মশলার দাবি একেবারেই নেই। টমেটো লাগে না, গরম মশলা লাগে না, ঘি, জিরে কিছুই লাগে না।

এ' রান্না স্টিমারের মাঝিদের হাতে তৈরি, ফলে সময়ও কম লাগে। এর আসল খেলাটাই হল 'ম্যারিনেশনে'। দিশি মুরগি হলে ভাল।

সেই মুরগির পিস ধুয়ে তাতে দিতে হবে অনেকটা পেঁয়াজ কুচি, অল্প আদা কুচি ও রসুন কুচি, পরিমাণমত নুন, হলুদ এবং অনেকটা সর্ষের তেল।

চাইলে অল্প পাতিলেবুর রস দিতে পারেন। তারপর দিতে হবে এই রান্নার রানি, কাঁচা মরিচ। একটু বেশি হলে ভাল, নয়ত আপনার স্বাদ অনুসারে।

অন্তত তিন থেকে চারটে কাঁচা মরিচ টুকরো করে দিয়ে দিতে হবে। সঙ্গে পানিতে ভিজিয়ে রাখা একটা শুকনো লাল মরিচ দিলেও হয়। ব্যাস। ভাল করে মাখিয়ে রেখে দিতে হবে ঘন্টাদুয়েক।

শোনা যায়, আসল গোয়ালন্দ স্টিমার কারিতে এত সর্ষের তেল দিয়ে মাখানো হত যে কড়াইতে আলাদা করে তেল দিতে হত না।

গরম কড়াইতে ডাইরেক্ট ফেলে দিতে হবে সেই মাখানো মাংস। আপনি চাইলে দু' চামচ তেল দিয়ে গরম করে নিতে পারেন।

তারপর দিয়ে দিন সবকিছু। দশ মিনিট হাই ফ্লেমে নাড়াচাড়া করতে হবে। ওতেই মাংস থেকে যা পানি বেরোবে, তাতে গ্রেভি এসে যাবে।

দশ মিনিট এইভাবে নাড়াচাড়ার পরে এক কাপ জল দিয়ে আরেকটু নেড়ে বিশ মিনিট থেকে আধঘন্টা ঢেকে রাখতে হবে। ব্যাস, তৈরি।

আর গন্ধটাকে একটু খোলতাই করতে গুঁড়ো ধনে এক চামচ জুড়েছি।

আর শুকনো লঙ্কা ছিল না বলে সানরাইজ কাশ্মীরি মরিচের গুঁড়ো এক চামচ দিয়েছি। রঙটা তাতে মন্দ আসেনি।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

image.png