আমার ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা - "পদ্ম গোখরো-র তাড়া খাওয়া"
rme (80)ADMIN✠ Founder 🔯in আমার বাংলা ব্লগ • yesterday (edited)
Copyright Free Iamge Source
আমার যে গ্রামে জন্ম সেটা এতই অজ-পাড়াগাঁ ছিল যে কি আর বলবো । বিদ্যুৎ ছিল না, কাঁচা রাস্তা আর ঝোপ-ঝাড় জঙ্গলে পরিপূর্ন ছিল । গ্রামটির নামও তার চেহারারই মানানসই । দিনের বেলাতেই, সাপ, বন বেড়াল, বেজী আর শেয়াল কত দেখেছি ! আর ছিল বড় বড় গোসাপের দল । এরা আপাত নিরীহ হলেও সময়ে সময়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো । ছোট ছেলেমেয়েদেরকে তাড়া করতো । শেয়ালের কামড় আর সাপের কামড় খাওয়াও খুব একটা বিরল ঘটনা ছিল না ।
আমার মনে আছে ছোটবেলায় সন্ধ্যের পর বাড়ির থেকে বেরোনো নিষেধ ছিল শুধুমাত্র শেয়াল আর সাপের কারণে । আমার মা তার বিয়ের পর এই গ্রামে এসে সাপের উপদ্রব দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে ছিল । ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে আমাদের ফ্যামিলির কাউকেই কোনোদিন সাপে কাটেনি । কিন্তু, অনেকগুলি ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল আমাদের ফ্যামিলির অনেকেই । তার মধ্যে আমিও একজন আছি ।
আমাদের ফ্যামিলির আদি নিবাস এই গ্রামে ছিল না । পূর্ববঙ্গের অন্য একটি গ্রামে ছিল, বহুকাল আগে সেখানে আমাদের এক পূর্বপুরুষ এক জমিদারের নায়েব সরকারের চাকরি করতেন । যতদূর জানা কথা বেশ অত্যাচারী ছিলেন তিনি । প্রজাদের উপরে খাজনা আদায়ে বেশ কড়া ছিলেন । প্রভূত সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার পাপের ফল তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন । হাজার বিঘে জমি হারানো, বংশধরদের বাড়িতে অজস্রবার ডাকাতি হওয়া, আগুন লেগে বসতবাটীর পুরোটাই ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া, এসব তো ছিলই । কিন্তু, সব চাইতে বেদনাদায়ক ব্যাপার ছিল যেটি সেটি একটু বলি । এরপরে আমার সাপে তাড়া খাওয়ার গল্পটি করবো ।
আমার সেই পূর্বপুরুষের পুত্রবধূ । মাঝবয়সী । তাঁর অভ্যাস ছিল প্রত্যহ সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে গা ধুতে যাওয়া । সময়টা বর্ষার মাঝামাঝি । নদীতে তখন ভরা বর্ষার বান ডেকেছে । এই সময়টাতে গ্রামের মানুষ পুকুর বা দীঘিতেই স্নান সারে, কারণ পরে বলছি । সেদিন ঢেঁকি ঘরে ধান কোটার কাজ তদারকি করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে । ঠাকরুন স্নানে যাবেনই যাবেন । সকলের অজস্র নিষেধ অমান্য করে তিনি এসে দাঁড়ালেন বাড়ির পিছনদিকে প্রবাহিত সেই ছোট্ট নদীর ঘাটে । ঘাটের সিঁড়িতে এক ঝি-কে গামছা, তেল আর সিঁদুর দিয়ে বসিয়ে রেখে ঠাকরুন ঘাটের পৈঠা বেয়ে জলে নামলেন ।
সামান্য কিছু মুহূর্ত । জলে হঠাৎ একটা ভীষণ আলোড়ন উঠলো । বিশাল একটি কালো অবয়ব আবছা দেখা গেলো । তার দুই রাক্ষুসে বিশাল চোয়ালের ফাঁকে ঠাকরুনের শরীরটা ছটফট করছে । পরক্ষনেই জলের অতলে ডুব দিলো সেই রাক্ষস । ঝি চিৎকার করে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে পড়লো ।
কুমীর । লোনা জলের ভয়ঙ্কর দানব । শিকার ধরার আশায় ঘাটের কাছেই ওঁৎ পেতে ছিল । ঠাকরুন জলে নামার মুহূর্তে আক্রমন করে তাঁকে শিকারে পরিণত করে । লণ্ঠন আর প্রচুর লোকজন নিয়ে সবাই ঘাটের কাছে এলো । কোথাও কিছু নেই । নিস্তব্ধ চারিদিক । নদীর জলের কোথাও রক্তের লেশমাত্র নেই । থাকার কথাও নয়, যে স্রোত !
না, আর কোনোদিনও ঠাকরুনের খোঁজ মেলেনি । সেই ঠাকরুনের ছেলের ছেলে হলো আমার ঠাকুরদা, অর্থাৎ আমার বাবার বাবার বাবার বাবা হলো ওই ঠাকরুনের ছেলে । এই করুন ইতিহাস আমি ছোটবেলায় বহুবার শুনেছি ।
এবার আসা যাক আমার ঘটনায় । সাপের ছোটবড় বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো আমার ছোটবেলায় । খুব বেশিদিন গ্রামে থাকিনি তো । কে জানি আরো বেশি কিছুদিন থাকলে এতদিনে ছবি হয়ে যেতাম কি না । যাই হোক স্মৃতি থেকে দুটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করবো আমি ।
কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাত সেদিন । শ্রাবণ মাসের সবে শুরু । আমাদের বাড়িতে অনেক গুলি ঘর ছিল আগেই বলেছি একদিন । মোট ১১ খানা ছোট বড় মিলিয়ে ঘর ছিল । তো সেদিন আমি আমার মেজ জেঠুর ভেতর বাড়ির এক ঘরে শুয়েছিলাম । অনেক রাত্তির পর্যন্ত জেঠতুতো দিদিদের সাথে লুডু খেলে আর আমাদের ঘরে যাইনি । ওখানেই একটা খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ছোট মানুষ, খাটের এক কোনায় দিব্যি জায়গা হয়ে গিয়েছিলো ।
তো মাঝ রাত্তিরে আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো । হিসু পেয়েছে । গ্রামে যখন থাকতাম তখন মাঝরাত্তিরে প্রস্রাবের জন্য মা`কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তারপরে বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করতাম । পুরোটাই ঘুম চোখে , প্রায় চোখ বুজে । তো সেদিন ঘুম ভেঙে প্রথমে কিছুক্ষন মাথাটা ভোম্বল হয়ে থাকলো । কোথায় আমি, তাই মনে করার প্রানপন চেষ্টা করছি ।
এমন সময় একটা অদ্ভুত হিস্ হিস্ শব্দ শুনতে পেলাম । মনে হচ্ছে কেউ যেনো হুইসলে ফুঁ দিচ্ছে প্রানপনে কিন্তু শুধু তীব্র হিস্ হিস্ শব্দ হচ্ছে । প্রেশার কুকারে সিটি দেয়ার মতো । তবে শব্দের তীব্রতা অনেক বেশি । হিস্ হিস্ শব্দের সাথে তীব্র ফোঁসফোঁসানি প্রায় গর্জনের মতো । শুয়ে শুয়ে অনেক্ষন শুনলাম । কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না ।
এবার মশারি সরিয়ে মেঝেতে এক পা দিলাম । নামবো । হিসু না করলেই নয় । দু'বার মৃদুস্বরে মা মা করে ডাকলাম । তখন, হঠাৎ খেয়াল হলো আমি জেঠুর ঘরে । মা'কে কোথায় পাবো । আবার পা তুলে নিলাম । আজ এতো বছর পরে মনে পড়লে এখনো গাঁ শিউরে ওঠে । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ সেদিন পা তুলে নিয়েছিলাম ।
আমার ডাক শুনে আমার এক জেঠতুতো দিদির ঘুম ভেঙে যায় । সে সেই তীব্র ফোঁসফোঁসানি আর হিস্ হিস্ গর্জন শুনে মশারি সরিয়ে মেঝেতে টর্চের আলো ফেললো । সে মুহূর্তে আমরা দু'জনেই ভয়ে একদম পাথর । আমার পিঠ দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো । মাটির মেঝে । আর সেই মেঝেতে একটি চলমান মেটে কালো ধূসর বর্ণের সরীসৃপ । মেঝে থেকে প্রায় ১ হাত উঁচু ফণা তুলে তীব্র রাগে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কাউকে তাড়া করে চলেছে । বিশাল একটি পদ্ম গোখরো, কেউ কেউ বলে খৈয়া কেউটে । সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত ।
তীব্র বিষ এই কেউটের । এক ছোবলেই একদম ছবি । আমার দিদি যেভাবে বাড়ি মাথায় করে চিল চিৎকার দিলো আমি ভাবলাম তাকেই বুঝি কামড়ে দিয়েছে । তার চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ সবাই জেগে উঠলো । সবাই টর্চ নিয়ে দৌড়ে এলো । এত লোকের তাড়া খেয়ে সাপটি একটি ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়লো ।
আসলে, হয়েছে কি সন্ধ্যের পর কোনো এক সময় সাপটি ঘরে ঢুকেছে ইঁদুরের লোভে । ওই ইঁদুরের গর্তেই সে আশ্রয় নিয়েছিল । মাঝ রাত্তিরে ঘরে হঠাৎ ছুঁচো ঢুকলে সে ছুঁচো তাড়া করছিলো । আর ধরতে না পেরে নিষ্ফল ক্রোধে অমন তর্জন গর্জন করছিলো ।
সাপের গর্ত আবিষ্কার হলো । ব্যাঙ বড়শিতে গেঁথে গর্তের মুখে দিয়ে সাপ টেনে বের করে পিটিয়ে মারলো সবাই । পরে, আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে ফেলতে ভোর হয়ে গিয়েছিলো ।আমি অবশ্য সে সব দৃশ্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম । কারণ, মা আমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ।
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!