"জাহিন এটা তুমি কি রেজাল্ট করলে? এ প্লাস তুমি পাওনি? "
"মা আমিতো এতো খারাপ পরীক্ষা দেইনি, এমন রেজাল্ট কেন হলো বুঝতেছি না "
"৩ সাবজেক্ট এ তোমার প্লাস ছুটেছে জাহিন। সবাইর কাছে এই রেজাল্ট কি করে বলবো? আমাদের মান সম্মান রাখলে না তুমি "
"মা কোথাও ভুল হইছে, আমি ভালো পরীক্ষা দিয়েছি বিশ্বাস করো "
"বন্ধুবান্ধবী আর নেট নিয়ে থাকলে এই রেজাল্ট হবে, তোমার ক্লাসের ২০ রোলের মেয়েটাও প্লাস পেয়েছে। "
"আমি চ্যালেঞ্জ করবো, এই রেজাল্ট আমি বিশ্বাস করছিনা "
"কি লাভ হবে তাতে? এক সাবজেক্ট হলে কথা ছিলো, ৩ সাবজেক্ট! "
বিকালবেলা মেয়েকে ঘরে না দেখে ভাবলাম হয়ত ছাদে গেছে, মাঝেমধ্যে যায়। কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম ---
"কিরে জাহিন কি ছাদে গেছে? "
"আমনে দুপুরবেলা ঘুমানোর পরেই আপা বাইর হইয়া গেছে "
"মানে কি? তুই আমার ঘুম ভাঙাবি না? কই গেলো মেয়েটা? "
"শোনো জাহিন না বলে বেরিয়ে গেছে "
"একটু পরে আমার মিটিং, আমি খুবই ব্যস্ত তুমি ওর বন্ধুবান্ধবদের বাসায় খবর নাও? মেয়েকে কি বেশী বকেছিলে? "
আর কিছু না বলেই জাহিনের বাবা ফোন রেখে দিলো, সে অসম্ভব ব্যস্ত মানুষ। আমি জাহিনের সব বন্ধুদের কাছে খবর নিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম, নাহ জাহিন কারো বাসায় যায়ইনি। ওর বাবাকে ম্যাসেজ দেবার আধাঘণ্টার মাঝে সে সব ফেলে বাসায় ছুটে এলো। জাহিনের ফোন বন্ধ দেখে সব রিলেটিভদের বাসায় খবর নিতে শুরু করলাম। বড় ছেলে রিজভী চুয়েটে পড়ে ওকেও জানিয়ে দিলাম। নাহ জাহিন নেই, যেন হাওয়া হয়ে গেছে। রাত আটটায় দুজনেই পুলিশের কাছে গেলাম জিডি করতে। রাত সাড়ে নয়টায় মেয়েকে পাওয়া গেলো রেলস্টেশন। ভাইয়ের কাছে যাবার জন্য ট্রেনের অপেক্ষা করছিলো।
"মামনি তুমি জানো না দেশ কতো খারাপ! কিভাবে এই দু:সাহসিনী হলে তুমি? কিছু বিপদ হলে আমরা তোমাকে পেতাম জাহিন? "
"ভাইয়ার কাছে যেতে ইচ্ছে করছিলো বাবা "
"মা হয়ত রেজাল্ট এর জন্য বকেছে তাই বলে তুমি কিছু না বলে বেরিয়ে যাবে? মা ভালোর জন্যই বলেছে। আচ্ছা আগামী সপ্তাহে আমি তোমাকে চিটাগাং নিয়ে যাবো তুমি কথা দাও এমন উদ্ভট কাজ আর মাথায় আনবেনা কখনো। "
"আচ্ছা আর করবো না কথা দিচ্ছি "
"হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো, আমার খুব খিদে পেয়েছে "
"আজ আমি তোমার হাতে ভাত খাবো আব্বু "
খাবার টেবিলে জাহিনের স্বাভাবিকতা দেখে স্বস্তির নি:স্বাস ফেললাম দুজনেই। জাহিন ঘুমাতে যাবার পরে রুমে এসে আমি বললাম ---
"তোমার আহ্লাদ পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠছে মেয়ে। এতবড় অন্যায় করার পরেও কিছুই বললে না তুমি? "
"শোনো অনেক ধকল গেছে, এখন এসব কথা থাক, আমার ঘুম পাচ্ছে, সকালে অফিস আছে "
আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাতে মনে হলো কেউ একজন রুমে ঢুকেছে, আমি জাহিনের বাবাকে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে গিয়ে দেখি জাহিন বাবার কপালে চুমু খাচ্ছে।
"জাহিন তুমিতো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে "
"তোমাদের আদর করতে ইচ্ছে করছিলো মা "------বলেই জাহিন আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
"এতো রাতে তুমি ঘুমাওনি "
"এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বো বাবা "
আমরা দুজন এতো ক্লান্ত ছিলাম যে, অন্যকিছু মাথায় আসেনি। জাহিনের বাবার ডায়াবেটিস, সকালে উঠেই মেয়েকে নিয়ে হাঁটতে বের হয় প্রায়। জাহিনের বাবার আর্তনাদে ঘুম ভেঙে গেলো। মেয়ের রুমের দরজা বন্ধ দেখে জানালার পর্দা সরিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখে মেয়ে ঝুলছে ফ্যানের সাথে। আমরা ঘুমিয়ে যাবার পর কাজের মেয়েটাকে বলেছিলো ড্রইং রুমে ঘুমাতে।
পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন , বন্ধুবান্ধব, আর পুলিশ বাসায়। প্রতিবেশী কেউ একজন খবর দেবার পর দরজা ভেঙে জাহিনকে নাকি নামানো হয়েছিলো। আমার কিচ্ছু মনে নেই শুধুমাত্র মনে পড়েছিলো হাসপাতালে নার্স কোঁকড়া চুলের এক পুতুলকে আমার কোলে তুলে দিয়েছিলো। মেয়েটার গায়ের মিষ্টি গন্ধ মনে আছে।
"ওনার পোস্ট মর্টেম করতে হবে তবে আপনার স্বামী কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। নিয়ম আমাদের মানতেই হবে "
ফ্যালফ্যাল চোখে আমি তাকিয়েই রইলাম। আমার মেয়েটা সুঁই বড়ো ভয় পেতো। চিৎকার, চেঁচামেচি করতো বলে ওকে ভ্যাক্সিন দিতেও অনেক ভোগান্তি পেতে হয়েছে। আজ কি করে ----
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পরে ছেলে রিজভী আমাদের দুজনকে নিয়ে এলো শেষবার দেখাতে। আমার পুতুলটা ঘুমিয়ে আছে। কি শান্ত মুখ! কিন্তু জাহিন শান্ত ছিলো না। বাসায় থাকলেই এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াতো বলে আদর করে ওর বাবা বলতো তিতলী। জোরেশোরে গান শুনতো। জাহিন একাই বাসা মাতিয়ে রাখতো।
"জাহিন মারে তুই নিশ্চুপ কেন? দেখ তোর ভাই এসছে মারামারি করবি না! তুই সবসময় বলতি ছেলে বেড়াতে এলে আমি নাকি স্বজনপ্রীতি করি, জেগে উঠে দেখ মায়ের কলিজা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে আমি কথা দিচ্ছি কোনোদিন কিছুই বলবো না, তুই ফিরে আয়। আমরা তোকে ছাড়া কি করে বাঁচবো মা! ""
সবাই তিনদিন বাদে চলে যাবার পর পুরো বাসা খালি হয়ে গেলো। ছেলে যাবার আগে বললো ----"মা আমাকে যেতে হবে "
"জাহিনকে নিয়ে তোর বাবার চিটাগাং যাবার কথা ছিলো "
"মা তুমি কি ওকে অনেক বকেছিলে? কেন বকেছিলে মা? জানো ও একটু অভিমানী মেয়ে তবুও কেন বকলে মা? "
জাহিনের বাবার চোখেও আমি ঘৃণা দেখেছি। সবাই আমাকেই দুষছে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে আরো কতো কি বলছে! মেয়ের গায়ে নাকি হাত তুলেছি, আবার কেউ বলেছে একা বাহিরে ছিলো রেপড হয়ে ঘরে এসে সুইসাইড করেছে। সদ্য সন্তানহারা মাবাবার আকুতি বোঝার চেয়ে নুনেরছিটে দিতেই সবাই ব্যস্ত। হায়রে মানুষের মন! আমি কাঁদতেও ভুলেছি। জীবন এতো কঠিন কেন?,আমি কাউকেই কিছু বলতে পারছিনা, দেখাতেও পারছিনা দেহ কতবড় শত্রু! আমাকে বেঁচে থাকার জন্য সবাই জোর করে খাওয়ায়। আমিতো মা নই রাক্ষুসী তাই অনুভুতি অসাড় হয়ে গেছে।
সারা দুনিয়া মায়ের ভুল খুঁজে বেড়ায়। প্রতিবছর কতো ছেলেমেয়ে এভাবে যে হারায়! যে শিক্ষাব্যবস্থা আংগুল তুলে ভালমন্দ দেখায় সেই শিক্ষা বদল। হয় না। মেয়ে আমার পরীক্ষা খারাপ করে সুইসাইড করেনি, শিক্ষাপদ্ধতি তাকে মেরে ফেলছে।
"""আম্মু,আব্বু,
জানি চ্যালেঞ্জ করেও আমার হয়ত প্লাস আসবেনা। আমি ভালো কোন কলেজে চান্স পাব না। ইন্টারে ভালো করলেও এই রেজাল্ট এরজন্য আমার পয়েন্ট সবসময় কমই থাকবে। ভাইয়াটা দুটো গোল্ডেন আর আমি-----------!!সবাইকে বলতে হবে, সবার চোখে মুখে আহা দেখতে ইচ্ছে করছেনা। তোমাদের লজ্জায় ফেলার জন্য সরি। আমার কাছে কুইট সহজ মনে হয়েছে।
-------জাহিন
শশ্মানেই শুধুমাত্র চিতা জ্বলে না। বুকের ভিতরে আমাদেরো আগুন জ্বলে। জোর করে সহজ হতে ইচ্ছে করেনা।সবকিছু ঠিকঠাকমতন চলছে শুধু আমাদের জীবন থেমে গেছে। আমি, জাহিনের বাবা, জাহিনের ভাই ------আমাদের দিন কাটে অসহ্য যন্ত্রণাময়। প্রায় রাতেই ঘুম ভেংগে গেলে দেখি জাহিনের বাবা পাশে নেই, মেয়ের রুমে গিয়ে একাকী বসে আছে। আমাকে না জানিয়ে চাকুরী পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। গত কয়দিনে ওর চেহারা দেখে আমিই ভয় পাচ্ছি। চাকুরী তে থাকলে ব্যস্ততায় সময় চলে যেতো। আমাদের শুন্যত্তা আমৃত্যু আমাদের বয়েই বেড়াতে হবে।
১১/৫/১৮
#জাহিনের জন্ম, বড় হওয়া, মৃত্যু -----চোখের সামনে দেখেছি বলেই মনে হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো জরুরী।
Congratulations @niloy699! You received a personal award!
You can view your badges on your Steem Board and compare to others on the Steem Ranking
Do not miss the last post from @steemitboard:
Vote for @Steemitboard as a witness to get one more award and increased upvotes!
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit