জীবনে সফল হওয়ার কিছু ব্যর্থতার গল্প

in my •  3 years ago  (edited)

জীবনে-সফল-হওয়ার-কিছু-ব্যর্থতার-গল্প-2.webp
জ্যাক মা-

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা-এর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সবাই জানেন যে চীনের এই ধনকুবের ব্যবসায়ী একদম সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আর বিখ্যাত মানুষদের একজন হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কোম্পানীগুলোর একটি। বিশ্বের শীর্ষ ১০ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলীবাবা একটি। আর এই অসাধারণ সফল মানুষটির ব্যর্থতার গল্প যেন একটি ট্রাজেডি সিরিয়াল।

তিনি জীবনে বহুবার ব্যর্থ হয়েছেন তারপরও হতাশ হননি, হাল ছাড়েননি। ব্যর্থ হয়েছেন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের প্রথম থেকেই ব্যর্থতার গল্প শুরু। কলেজে ভর্তি হবার সময়ে ৩ বার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে ৪র্থ বার সুযোগ পান। এরপর চাকরি করতে গিয়ে বহুবার বার ব্যর্থ হন! পুলিশে ১০ জন পরীক্ষা দিয়ে বাকী ৯ জন চাকরি পেল, বাদ পড়লেন শুধু জ্যাক মা। বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট কেএফসিতে চাকরীর জন্য পরীক্ষা দিলেন জ্যাক সহ ২৪ জন। ২৪ জনের মধ্যে জ্যাক ছাড়া বাকী ২৩ জনের চাকরি হলো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ বার চেষ্টা করেও তিনি সুযোগ পাননি। এতো ব্যর্থতার পরও তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি। বার বার ব্যর্থ হওয়ার পরও প্রতিবারই নতুন উদ্যমে ঘুড়ে দাঁড়িয়েছেন। এভাবে অনেক ব্যর্থতার পর চেষ্টা করতে করতে অবশেষে আলিবাবা প্রতিষ্ঠার পর তার কাছে সাফল্য এসে ধরা দেয়।

চার্লি চ্যাপলিন-

কমেডির রাজা চার্লি চ্যাপলিন-এর নাম কে না জানে। ১৮৮৯ সালে জন্ম নেয়া বিশ্ব বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিনকে সবাই চেনে। সিনেমার শুরুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত সব সিনেমা পাগল তাঁকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। পৃথিবীর সফলতম অভিনেতা ও পরিচালকদের একজন তিনি। কমেডির রাজা বলা হয় তাঁকে। এসব কথাও সবাই জানে। কিন্তু তাঁর পেছনের গল্প সবাই জানে না। চলুন জেনে নেয়া যাক এমন কিছু কথা যা সবাই জানে না।

চ্যাপলিনের বাবা ছিলেন একজন মাতাল। কোনও কাজ করতেন না, দিন-রাত মদ খেয়ে পড়ে থাকতেন। চ্যাপলিনের ২ বছর বয়সে তাঁর বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মা নামে মাত্র একটি কাজ করতেন তাতে সংসারের খরচ কোন ভাবেই মিটতো না। অভাবের তাড়নায় মাত্র ৭ বছর বয়সে চার্লি “ওয়ার্কহাউজ” এ যেতে বাধ্য হন। “ওয়ার্কহাউজ” হলো তৎকালীন সময়ে বৃটেনে গরিবদের জন্য একটি ব্যবস্থা চালু ছিল, যেখানে পরিশ্রমের বিনিময়ে খাবার ও শোয়ার জায়গা দেয়া হত। কিছুদিন পর আবার চার্লি সেখান থেকে ফিরে আসেন। আবার চার্লি’র ৯ বছর বয়সে তাঁর মা পাগল হয়ে যান এবং তাকে মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়। মায়ের মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার কারণে চ্যাপলিনকে আবারও “ওয়ার্কহাউজে” ফিরে যেতে হয়।

কিছুদিন পর চার্লির বাবা লিভার নষ্ট হয়ে মারা যান। এরপর তাঁর মায়ের পাগলামি এতই বেড়ে যায় যে তাকে সব সময়ের জন্য পাগলা গারদে বন্দী করে রাখার প্রয়োজন পড়ে। চ্যাপলিন ও তাঁর ভাই সিডনি একদম পথে বসে পড়েন। দিনের পর দিন না খেয়ে রাস্তায় ঘুরে কাটান। এভাবে চলতে চলতেই এক সময়ে তিনি মঞ্চে কাজ নেন। বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে করতে নিজের কমেডি প্রতিভাকে শক্তিশালী করেন। পরে হলিউডে পাড়ি জমান। তার পরের গল্প তো সবাই জানে। সেখান থেকেই সর্বকালের সেরা নির্বাক অভিনেতা হয়ে ওঠেন তিঁনি।

আব্রাহাম লিংকন-

আমেরিকার সফল প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ১৮০৯ সালে জন্ম নেয়া এই মানুষটি আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আমেরিকার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয় আব্রাহাম-কে। আমেরিকায় দাসদের স্বাধীনতা লাভের পেছনে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি ও খ্যাতির দিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসের সফলতম মানুষদের একজন।

আব্রাহাম লিংকনের শুরুটা কিন্তু ব্যর্থতার গল্প দিয়েই। ২৩ বছর বয়সে তাঁর চাকরি চলে যায়। একই সময়ে তিনি তাঁর প্রথম নির্বাচনেও হেরে যান। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি ২৯ বছর বয়সে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এর সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করে তিনি আবারও ব্যর্থ হন, নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। ১৮৪৮ সালে, ৩৯ বছর বয়সী লিংকন ওয়াশিংটনের জেনারেল ল্যান্ড অফিসের কমিশনার হওয়ার জন্য নির্বাচন করেন। ফলাফল এবারও একই নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। তারপরও আবার ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সেখানেও তিঁনি শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন।

এত ব্যর্থতার পরও তিঁনি কিন্তু থেমে থাকেননি রাজনীতি না ছেড়ে প্রতিবারই নতুন উদ্যমে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অবশেষে সাফল্য এসে ধরা দেয় তাঁর ঝুলিতে। ১৮৬১ সালে, ৫২ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের প্রায় পুরোটাই ছিল ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এরপর তিনি আমেরিকার ইতিহাস বদলে দেন। হয়ে উঠেন সর্বকালের সেরা প্রেসিডেন্ট।

বিল গেটস-

বর্তমান সময়ের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি বিল গেটস’কে কে না চেনে। যদিও এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি আমাজনের জেফ বেজোস, কিন্তু এখনও অনেকে মনে করেন যে বিল গেটসই পৃথিবীর ধনীতম মানুষ। কারণ, এতদিন ধরে তিনি বিশ্বের এক নম্বর ধনী ছিলেন যে, অন্য কেউ তাঁর জায়গা দখল করেছে। এটা অনেকে জানে না। তার বানানো অপারেটিং সিস্টেম ইউন্ডোজ কম্পিউটার আমরা ব্যবহার করি। আজকের বিশ্বের কম্পিউটারের বিপ্লবের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যাদের, তাঁদের অন্যতম হলেন তিনি। সবাই তার সফলতাকে জানি কিন্তু সফলতার পিছনের গল্প আমার কতজন জানি!

আপনি কি জানেন, বিল গেটসের প্রথম প্রজেক্ট অপমানজনক ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল? মাইক্রোসফট এর কো-ফাউন্ডার এবং বাল্যবন্ধু পল এ্যালেন আর বিল গেটস মিলে “Traf-O-Data” নামে একটি মেশিন তৈরী করেছিলেন যেটি ট্রাফিক কাউন্টার গুলো থেকে ডাটা সংগ্রহ করে সরকারি ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারদের তা গুছিয়ে সরবরাহ করবে। এমনিতে কাজটি হাতে করতে হতো। এই যন্ত্রটির ওপেনিং এ স্বয়ং শিয়াটলের ট্রাফিক সুপারভাইজার এসেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রটি চালু করার পর কোনওভাবেই কাজ করেছি। এমন লজ্জা আর অপমান গেটসের জীবনে আর আসেনি। কিন্তু তাঁরা থেমে যাননি। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বিল আর পল মিলে পরে মাইক্রোসফটকে সফল করেন।

টমাস আলভা এডিসন-

টমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন মার্কিন উদ্ভাবক এবং ব্যবসায়ী। আজকের পৃথিবীতে এমন কোনও শিক্ষিত মানুষ নেই যে টমাস আলভা এডিসন এর নাম জানে না। বৈদ্যুতিক বাতি, চলচ্চিত্র, অডিও রেকর্ডিং, এনক্রিপটেড টেলিগ্রাফ সিস্টেম, আধুনিক ব্যাটারী- এ ধরনের হাজারের ওপর আবিষ্কার করে তিনি পৃথিবীকে ঋণী করে গেছেন। এডিসন ইতিহাসের অতিপ্রজ বিজ্ঞানীদের অন্যতম একজন বলে বিবেচিত, যার নিজের নামে ১০৯৩টি মার্কিন পেটেন্টসহ যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্স এবং জার্মানির পেটেন্ট রয়েছে। গণযোগাযোগ খাতে বিশষ করে টেলিযোগযোগ খাতে তার বহু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার অবদানের জন্য তিনি সর্বস্বীকৃত। সফলতার গল্প তো শুনলেন, এবার চলুন সফলতার পেছনের গল্প শোনা যাক।

১৮৪৭ সালে আমেরিকার ওহাইওতে জন্ম নেয়া এই জিনিয়াসের ছোটবেলায় “স্কারলেট ফিভার” নামে একটি জটিল অসুখ হয়। যার ফলে তিনি কানে প্রায় শুনতেই পেতেন না। তাঁর স্কুল জীবন ছিল মাত্র ১২ সপ্তাহের। কারণ তাঁর পড়াশুনার পারফরমেন্স এতই খারাপ ছিল যে স্কুলে আর তাঁকে রাখতে চাইছিল না। স্কুল থেকে দেয়া চিঠিতে লেখা ছিল যে টমাস পড়াশুনায় খুবই অমনযোগী ও তার মেধাও ভালো নয়, এই ধরনের দুর্বল ছাত্রকে স্কুলে রাখা যাবে না। কিন্তু টমাসের মা চিঠি খুলে ছেলেকে শুনিয়ে পড়েছিলেন যে, টমাসের মেধা সাধারণ ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি, এত বেশি মেধাবী ছাত্রকে পড়ানোর ক্ষমতা সাধারণ স্কুলের নেই। কাজেই তাকে যেন বাসায় রেখে পড়ানো হয়।

মায়ের থেকে পাওয়া এই আত্মবিশ্বাস থেকেই টমাস পরে জটিল জটিল সব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে থাকেন এবং এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তিনি কোনও কিছুতেই ব্যর্থতাকে মেনে নিতেন না। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সময়ে ১০ হাজার বার তাঁর এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও অনেকের ধারণা তিনি ১ হাজার বার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। যাইহো ১ হাজার বার এক্সপেরিমেন্টও কিন্তু কম না। কিন্তু তিনি তবুও চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কারণ ছোটবেলায় তাঁর মা তাঁর মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, কিছুই অসম্ভব নয়।

স্কুলের সেই চিঠিটি এডিসন অনেক বছর পরে খুঁজে পেয়েছিলেন, তাঁর মা সেটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। ততদিনে মা মারা গেছেন। টমাস ততদিনে হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও ধনী উদ্যোক্তা। চিঠিটি পড়ে টমাস সব বুঝতে পারেন এবং নিজের ডায়েরীতে লেখেন, “টমাস আলভা এডিসন একজন ছিল এক মেধাহীন শিশু। একজন অসাধারণ মায়ের প্রেরণায় সে হয়ে উঠে যুগের সেরা মেধাবী।“

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!