পল্লীসমাজ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় part - 1

in palli •  last year 

এক

বেণী ঘোষাল মুখুয্যেদের অন্তরের প্রাঙ্গণে পা দিয়াই সম্মুখে এক প্রৌঢ়া রমণীকে পাইয়া প্রশ্ন করিল, এই যে মাসি, রমা কই পা মাসি আহ্নিক করিতেছিলেন, ইঙ্গিতে রান্নাঘর দেখাইয়া দিলেন। বেণী উঠিয়া আসিয়া রন্ধনশালার চৌকাঠের বাহিরে দাঁড়াইয়া বলিলেন, তা হলে রমা, কী করবে স্থির করলে? জ্বলন্ত উনান হইতে শব্দায়মান কড়াটা নামাইয়া রাখিয়া রমা মুখ তুলিয়া চাহিল,

কিসের বড়দাঃ বেণী কহিল, তারিণী খুড়োর শ্রাদ্ধের কথাটা বোন! রমেশ তো কাল এসে হাজির হয়েছে। বাপের শ্রাদ্ধ খুব ঘটা করেই করবে বলে বোধ হচ্ছে: যাবে না কি?

রমা দুইচক্ষু বিস্ময়ে বিস্ফারিত করিয়া বলিল, আমি যাব তারিণী ঘোষালের বাড়ি? বেণী ঈষৎ লজ্জিত হইয়া কহিল, সে তো জানি দিদি। আর যেই হোক, তোরা কিছুতেই সেখানে যাবিনে। তবে শুনচি নাকি ছোঁড়া সমস্ত বাড়ি-বাড়ি নিজে গিয়ে বলবে- বজ্জাতি বুদ্ধিতে সে তার বাপেরও ওপরে যায় যদি আসে, তা হলে কী বলবে?

রমা সরোষে জবাব দিল, আমি কিছুই বলব না- বাইরের দরোয়ান তার উত্তর দেবে। পূজানিরতা মাসির কর্ণরন্ধে এই অত্যন্ত রুচিকর দলাদলির আলোচনা পৌঁছিবামাত্রই তিনি আহ্নিক ফেলিয়া রাখিয়া উঠিয়া আসিলেন। বোনঝির কথা শেষ না হইতেই অত্যুত্তপ্ত খৈ-এর মতো ছিটকাইয়া উঠিয়া কহিলেন, দরোয়ান কেন? আমি বলতে জানিনে? নচ্ছার ব্যাটাকে এমনি বলাই বলব যে, বাছাধন জন্মে কখনো আর মুখুয্যেবাড়িতে মাথা গলাবে না। তারিণী ঘোষালের ব্যাটা ঢুকবে নেমন্তন্ন করতে আমার বাড়িতে? আমি কিছুই ভুলিনি বেণীমাধব! তারিণী তার এই ছেলের সঙ্গেই আমার রমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনও তো আর আমার যতীন জন্মায়নি ভেবেছিল, যদু মুখুয্যের সমস্ত বিষয়টা তাহলে মুঠোর মধ্যে আসবে- বুঝলে না বাবা বেণী! তা যখন হল না, তখন ঐ ভৈরব আচায্যিকে দিয়ে কী-সব জপ-তপ, তুকতাক করিয়ে মায়ের কপালে আমার এমন আগুন ধরিয়ে দিলে যে, ছ'মাস পেরুল না বাছার হাতের নোয়া মাথার সিঁদুর ঘুচে গেল। ছোটজাত হয়ে চায় কিনা যদু মুখুয্যের মেয়েকে বৌ করতে! তেমনি হারামজাদার মরণও হয়েছে—ব্যাটার হাতের আগুনটুকু পর্যন্ত পেলে না । ছোটজাতের মুখে আগুন! বলিয়া মাসি যেন কুস্তি শেষ করিয়া হাঁপাইতে লাগিলেন। পুনঃপুন ছোটজাতের উল্লেখে বেণীর মুখ ম্লান হইয়া গিয়াছিল, কারণ তারিণী ঘোষাল তাহারই খুড়া। রমা ইহা লক্ষ করিয়া মাসিকে তিরষ্কারের কণ্ঠে কহিল, কেন মাসি তুমি মানুষের জাত নিয়ে কথা কও? জাত তো আর কারুর হাতে গড়া জিনিস নয়ঃ যে যেখানে জন্মেচে সেই তার ভালো।

বেণী লজ্জিতভাবে একটুখনি হাসিয়া কহিল, না রমা, মাসি ঠিক কথাই বলেচেন । তুমি কত বড় কুলীনের মেয়ে, তোমাকে কি আমরা ঘরে আনতে পারি বোন! ছোটখুড়োরকথা মুখে আনাই বেয়াদবি আর তুকতাবের কথা যদি বলো তো সে সত্যি। দুনিয়ায় ছোটখুড়ো আর ঐ ব্যাটা ভৈরব আচায্যির অসাধ্য কাজ কিছু নেই। ঐ ভৈরব তো হয়েছে। আজকাল রমেশের মুরুব্বি। মাসি কহিলেন, সে তো জানা কথা বেশী। ছোঁড়া দশ-বারো বছর তো দেশে

আসেনি এতদিন ছিল কোথায়

কী করে জানব মালি। ছোটগুড়োর সঙ্গে তোমাদেরও যে ভাব, আমাদেরও তাই। শুনচি

এতদিন নাকি বোম্বাই না কোথায় ছিল। কেউ বলতে ডাক্তারি পাস করে এসেছে, কেউ

কাচে উকিল হয়ে এসেছে, কেউ বলছে সমস্তই ফাঁকি ছোঁড়া নাকি গাঁড় মাতাল। যখন

বাড়ি এসে পৌঁছল, তখন দুচোখ নাকি জবাফুলের মতো বাকা ছিল। বটে। তা হলে তাকে তো বাড়ি ঢুকতে দেওয়াই উচিত নয়। বেশী উৎসাহভরে মাথার একটা ঝাঁকানি দিয়া কহিল, নাই তো! হাঁ রমা, তোমার রমেশকে মনে নিজের হতভাগ্যের প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়ায় রমা মনে মনে লজ্জা পাইয়াছিল। সল

হাসিয়া কহিল, পড়ে বৈ কি। সে তো আমার চেয়ে বেশি বড় নয়। তা ছাড়া শীতলাতলার

পাঠশালে দুজনেই পড়তাম যে। কিন্তু তার মায়োর মরণের কথা আমার খুব মনে পড়ে।

বুড়িমা আমাকে বড় ভালোবাসতেন।

মাসি আর একবার নাচিয়া উঠিয়া বলিলেন, তার ভালোবাসার মুখে আগুন। সে

ভালোবাসা কেবল নিজের কাজ হাসিল করবার জন্যে তাদের মতলব ছিল, তোকে

কোনোমতে হাত করা।

বেশী অত্যন্ত বিভোর মতো সায় দিয়া কহিল, তাতে আর সন্দেহ ी म

ছোটখুড়িমার যে-

কিন্তু তাহা বক্তব্য শেষ না হইতেই রমা অপ্রসন্নভাবে মাসিকে বলিয়াই উঠিল, সেসব

পুরনো কথার দরকার নেই মাসি।

রমেশের পিতার সহিত রমার যত বিবাদই থাক, তাহার জননীর সম্বন্ধে রমার কোথায়

একটু যেন প্রচ্ছন্ন বেদনা ছিল। এতদিনেও তাহা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় নাই। বেশী

তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিলেন, তা বটে। ছোটগুড়ি ভালোমানুষের মেয়ে ছিলেন। মা আজও

তাঁর কথা উঠলে চোখের জল ফেলেন।

কী কথায় কী কথা আসিয়া পড়ে দেখিয়া বেদী এ সকল প্রসঙ্গ চাপা নিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, তবে এই তো স্থির হল দিদি, নড়চড় হবে না তো রমা হাসিল। কহিল, বড়মা, বাবা বলতেন আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ কখনো রাখিসনে মা তারিণী ঘোষাল জ্যান্তে আমাদের কম জ্বালা দেয়নি বাবাকে পর্যন্ত জেলে দিতে চেয়েছিল। আমি কিছুই ভুলিনি বড়দা, যতদিন বেঁচে থাক, ভুলব না। রমেশ সেই শত্রুনাই ছেলে তো! তাছাড়া আমার তো কিছুতেই যাবার জো নেই। বাবা আমাদের দুই ভাইবোনকে বিষয় ভাগ করে দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু সমস্ত বিষয় রক্ষা করার ভার শুধু আমারই উপর যে আমার তো নয়ই, আমাদের সংস্রবে যারা আছে, তাদের পর্যন্ত যেতে দেব না। একটু ভাবিয়া কহিল, আচ্ছা বড়দা, এমন করতে পার না যে, কোনও ব্রাহ্মণ না তাদের বাড়ি যায়

বেশী একটু সরিয়া আসিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, সেই চেষ্টাই তো করচি বোন। তুই

আমার সহারা থাকিস, আর আমি কোনও চিন্তা করিনে। রমেশকে এই কুঁয়াপুর থেকে না

তাড়াতে পারি তো আমার নাম বেণী ঘোষাল নয়। তার পরে রইলাম আমি, আর ঐ ভৈরব

আচায্যি। আর তারিণী ঘোষাল নেই, দেখি এ ব্যাটাকে এখন কে রক্ষা করে।

রমা কহিল, রক্ষে করবে রমেশ ঘোষাল। দেখো বড়দা, এই আমি বলে রাখলুম, শতা করতে এত কম করবে না। বেশী আরও একটু অগ্রসর হইয়া একবার এদিক-ওদিক নিরীক্ষণ করিয়া লইয়া চৌকাঠের উপর উবু হইয়া বসিল। তারপর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মৃদু করিয়া বলিল, রমা, বাঁশ নুইয়ে ফেলতে চাও তো, এই বেলা, পেকে গেলে আর হবে না তা নিশ্চয় বলে দিচ্ছি। বিষয়-সম্পত্তি কী করে রক্ষে করতে হয়, এখনও সে শেখেনি-এর মধ্যে যদি না শত্রুকে নির্মূল করতে পারা যায় তো ভবিষ্যতে আর যাবে না; এই কথাটা আমাদের দিবারাত্রি মনে রাখতে হবে যে এ ভারিণী ঘোষালেরই ছেলে আর কেউ নয়। সে আমি বুঝি বড়া।

তুই না বুঝিস কী দিদি। ভগবান তোকে ছেলে গড়তে মেনে গড়েছিলেন বৈ তো নয়। বুদ্ধিতে একটা পাকা জমিদারও তোর কাছে হটে যায়, এ-কথা আমরা সবাই বলাবলি করি। আচ্ছা, কাল একবার আসব। আজ বেলা হল যাই, বলিয়া বেশী উঠা পড়িল। রমা এই প্রশংসায় অভ্যন্ত প্রীত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিনয়-সহকারে কী একটু প্রতিবাদ করিতে গিয়াই তাহার বুকের ভিতর ছাং করিয়া উঠিল প্রাণের একপ্রান্ত হইতে অপরিচিত গম্ভীর কণ্ঠের আহ্বান আসিল-রানী, কই বো

রমেশের মা এই নামে ছেলেবেলায় তাহকে ডাকিতেন। সে নিজেই এতদিন তাহা ভূলিয়া গিয়াছিল। বেণীর প্রতি চাহিয়া দেখিল তাহার সমস্ত মুখ নীলবর্ণ হইয়া গিয়াছে । পরক্ষণেই রুক্ষ-মাথা, খালি পা, উত্তরীয়টা মাথায় জড়ানো -রমেশ আসিয়া দাঁড়াইল। বেণীর প্রতি চোখ পড়িবামাত্রই বলিয়া উঠিল, এই-যে বড়দা, এখানে বলিয়াই কপাটের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। পালাইবার উপায় নাই, রমা ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল। রমেশ মুহূর্তমাত্র তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মহাবিশ্বর প্রকাশ করিয়া বলিয়া উঠিল, এই-যো আরে ইশ, কত্তবড় হয়েছিস রে? ভালো আছিস?

রমা তেমনি অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। হঠাৎ কথা কহিতেই পারিল না। কিন্তু রমেশ একটুখানি হাসিয়া তৎক্ষণাৎ কহিল, চিনতে পাচ্ছিস রো আমি তোদের রমেশদা। এখনও রমা মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না। কিন্তু মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, আপনি ভালো আছেন।

হাঁ ভাই, ভালো আছি। কিন্তু আমাকে আপনি কেন রমা। বেণীর দিকে চাহিয়া একটুখানি মলিন হাসি হাসিয়া বলিল, রমার সেই কথাটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারিনি বড়া। যখন মা মারা গেলেন, ও তখন তো খুব ছোট। সেই বয়সেই আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, রমেশদা তুমি কেঁদো না, আমার মাকে আমরা দুজনে ভাগ করে নেব। তোর সে-কথা বোধ

করি মনে পড়ে না রমা, না। আচ্ছা, আমার মাকে মনে পড়ে তোর কথাটা শুনিয়া রমার ঘাড় যেন লজ্জায় আরও ঝুঁকিয়া পড়িল। সে একটিবার ঘাড় নাড়িয়া জানাইতে পারিল না যে, মুড়িমাকে তাহার খুব মনে পড়ে। রমেশ বিশেষ করিয়া রমাকে উদ্দেশ করিয়াই বলিতে লাগিল, আর তো সময় নেই, মাঝে শুধু তিনটি দিন বাকি, যা করবার করে দাও ভাই, যাকে বলে একান্ত নিরাশ্রয়, আমি ভাই হয়েই তোমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েচি। তোমরা না-গেলে এতটুকু ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে পারচি না।

মাসি আসিয়া নিঃশব্দে রমেশের পিছনে দাঁড়াইলেন। বেশী অথবা রমা কেহই যখন একটা কথারও জবাব দিল না, তখন তিনি সুমুখের দিকে সরিয়া আসিয়া রমেশের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, তুমি বাপু তারিণী ঘোষালের ছেলে না। রমেশ এই মাসিটিকে ইতিপূর্বে দেখে নাই; কারণ সে গ্রাম ত্যাগ করিয়া যাইবার পরে ইনি রমার জননীর অসুখের উপলক্ষে সেই-যে মুখযোবাড়ি ঢুকিয়াছিলেন আর বাহির হন নাই।

রমেশ কিছু বিস্মিত হইয়াই তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। মাসি বলিলেন, না হলে এমন বেহায়া

পুরুষমানুষ আর কে হবে। যেমন বাপ তেমনি ব্যাটা! বলা নেই, কহা নেই, একটা গেরস্তর

বাড়ির ভিতর ঢুকে উৎপাত করতে শরম হয় না তোমার?

রমেশ বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো কাঠ হইয়া চাহিয়া রহিল। আমি চললুম, বলিয়া বেণী ব্যস্ত হইয়া সরিয়া পড়িল ।

রমা ঘরের ভিতর হইতে বলিল, কী বোক্‌চ মাসি, তুমি নিজের কাজে যাও না- মাসি মনে করিলেন, তিনি বোনথির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা বুঝিলেন। তাই কন্ঠস্বরে আরও একটু বিষ মিশাইয়া কহিলেন, নে রমা, কিস্ নে। যে কাজ করতেই হবে, তাতে আমার তোমাদের মতো চক্ষুলজ্জা হয় না। বেণীর অমন ভয়ে পালানোর দরকার কী ছিল? বলে গেলেই তো হত। আমরা বাপু তোমার গোমস্তাও নই, ঘাস-ভালুকের প্রজাও নই যে, তোমার কর্মবাড়িতে জল তুলতে, ময়দা মাখতে যাব। তারিণী মরেচে, গী-সুদ্ধ লোকের হাড় জুড়িয়েছে-এ কথা আমাদের ওপর বরাত দিয়ে না গিয়ে নিজে ওর মুখের ওপর বলে গেলেই তো পুরুষমানুষের মতো কাজ হত।

রমেশ তখনও নিস্পন্দ অসাড়ের মতো দাঁড়াইয়া রহিল। বস্তুতই এ-সকল কথা তাহার একান্ত দুঃস্বপ্নেরও অগোচর ছিল। ভিতর হইতে রান্নাঘরে কপাটের শিকলটা অব করিয়া নড়িয়া উঠিল। কিন্তু কেহই তাহাতে মনোযোগ করিল না। মাসি রমেশের নির্বাক ও অত্যন্ত পাংশুবর্ণ মুখের প্রতি চাহিয়া পুনরপি বলিলেন, যাই হোক, বামুনের ছেলেকে আমি চাকর দরোয়ান দিয়ে অপমান করাতে চাইনে একটু হুঁশ করে কাজ কোরো বাপু যাও। কচি খোকাটি নও যে, ভদ্দরলোকের বাড়ির ভেতরে ঢুকে আবদার করে বেড়াবে। তোমার বাড়িতে আমার রমা কখনও পা ধুতেও যেতে পারবে না, এই তোমাকে আমি বলে দিলুম।

হঠাৎ রমেশ যেন নিদ্রোখিতের মতো জাগিয়া উঠিল এবং পরক্ষণেই তাহার বিস্তৃত বক্ষের ভিতর হইতে এমনি গভীর একটা নিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল যে, সে নিজেও সেই শব্দে সচকিত হইয়া উঠিল। ঘরের ভিতর হইতে কপাটের অন্তরালে দাঁড়াইয়া রমা মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল। রমেশ একবার বোধ করি ইতস্তত করিল, তাহার পরে রান্নাঘরের দিকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, যখন যাওয়া হতেই পারে না, তখন আর উপায় কী! কিন্তু আমি তো এত কথা জানতাম না- না-জেনে যে উপদ্রব করে গেলাম, সেজন্য আমাকে মাপ কোরো রানি। বলিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। ঘরের ভিতর হইতে এতটুকু সাড়া আসিল না। যাহার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করা হইল, সে-যে অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, রমেশ তাহা জানিতেও পারিল না। বেশী তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। সে পালায় নাই, বাহিরে লুকাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল মাত্র। মাসির সহিত চোখাচোখি হইতেই তাহার সমস্ত মুখ আহ্লাদে ও হাসিতে ভরিয়া গেল, সরিয়া আসিয়া কহিল, হাঁ, শোনালে বটে মাসি। আমার সাধ্যিই ছিল না অমন করে বলা। এ কি চাকর- দরোয়ানের কাজ রমা। আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিনা, ছোঁড়া মুখখানা যেন আষাঢ়ের মেঘের মতো করে বার হয়ে গেল। এই তো—ঠিক হল।

মাসি ক্ষুণ্ণ অভিমানের সুরে বলিলেন, খুব তো হল জানি; কিন্তু এই দুটো মেয়েমানুষের পর ভার না নিয়ে, না সরে গিয়ে নিজে বলে গেলেই তো আরও ভালো হত। আর নাই যদি বলতে পারতে, আমি কী বললুম তাকে, দাঁড়িয়ে থেকে শুনে গেলে না কেন বাছা? অমন সরে পড়া উচিত হয়নি। মাসির কথার ঝাঁজে বেণীর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল। সে-যে এই অভিযোগের কী

সাফাই দিবে ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু অধিকক্ষণ ভাবিতে হইল না, হঠাৎ রমা ভিতর হইতে তাহার জবাব দিয়া বসিল, এতক্ষণ সে একটি কথাও কহে নাই। কহিল, তুমি যখন নিজে বলেচ মাসি, তখন সেই তো সকলের চেয়ে ভালো হয়েছে। যে যতই বলুক না কেন, এতখানি বিষ জিভ দিয়ে ছড়াতে তোমার মতো কেউ তো পেরে উঠত না- মাসি এবং বেণী উভয়েই যারপরনাই বিস্ময়াপন্ন হইয়া উঠিলেন। মাসি রান্নাঘরের দিকে

ফিরিয়া কহিলেন, কী বলি কিছু না। আহ্নিক করতে বসে তো সাতবার উঠলে যাও না, ওটা সেরে ফেল

না রান্নাবান্না কি হবে না? বলিতে বলিতে রমা নিজেও বাহির হইয়া আসিল এবং কাহাকেও কোনো কথা না বলিয়া বারান্দা পার হইয়া ওদিকের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। বেশী শুষ্কমুখে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কী মাসি কী করে জানব বাছা! ও রাজরানীর মেজাজ বোঝা কি আমাদের মতো দাসী-বাঁদীর

কর্ম! বলিয়া ক্রোধে, ক্ষোভে তিনি মুখখানা কালিবর্ণ করিয়া তাঁহার পূজার আসনে গিয়া উপবেশন করিলেন এবং বোধ করি বা মনে মনে ভগবানের নাম করিতেই লাগিলেন। বেণী ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...