আদালতের রায় স্পষ্ট করা প্রয়োজন

in photo •  7 years ago 

images.jpg

index.jpg

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরদিন জাতীয় সংসদে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে। সরকার এই রায় অমান্য করতে পারছে না, করলে আদালত অবমাননা হবে।

আমরা কোটার বিষয়টি প্রধানত মন্ত্রীর বিতরণ করা রায়ের (সরকার বনাম জামাল উদ্দিন সিকদার মামলার রায়) আলোকে বুঝতে চাইব। তিনি কেবল আপিল বিভাগের দেড় পৃষ্ঠার একটি রায় সাংবাদিকদের বিতরণ করেছেন; অথচ হাইকোর্টের ৪৫ পৃষ্ঠার রায়টিই মূল ভিত্তি, যা কোথাও ছাপা হয়েছে বলে জানা যায় না। খাদ্য বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক জামাল উদ্দিন সিকদার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবসরকালীন বাড়তি সুবিধা পাননি। তাঁর রিটে হাইকোর্ট তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবসরকালীন সুবিধা দিতে নির্দেশ দেন, যা কখনো তামিল হয়নি। এমনকি এই রায় অমান্য করার দায়ে আদালত অবমাননার একটি মামলা চলমান রয়েছে।

২০১২ সালে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ওই রিটের নিষ্পত্তি করেন। রায়ে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পোষ্যদের প্রতি দেওয়া বৈশ্বিক সুবিধাদির চিত্র তুলে ধরেন। এতে ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি আলোচনা করা হয়। এই সাত দেশের মধ্যে শুধু ফ্রান্সে যুদ্ধফেরতদের (ওয়ার ভেটেরানস) জন্য সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ কোটা আছে। কিন্তু কোথাও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা তাঁদের নাতি-নাতনি কোটা নেই। সব দেশই যোদ্ধার পোষ্যদের (স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, নাতি-নাতনি নয়) পর্যাপ্ত ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করে থাকে। পোল্যান্ডের দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা সরকারি পরিবহন, ফ্ল্যাট কেনা, এমনকি বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলে ভর্তুকি বা কমিশন পান। আদালত লিখেছেন, ‘কিন্তু চাকরির কোটা নেই, সন্তানদের জন্যও কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।’ হাইকোর্ট সাতটি ‘পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা’ (অবজারভেশনস অ্যান্ড ডিরেকশনস) দিয়েছিলেন।

আদালতের নির্দেশনা বাধ্যতামূলক, পর্যবেক্ষণ ঐচ্ছিক। দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা এবং নির্বাচনের ৪১ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে সর্বোচ্চ আদালতের ‘পর্যবেক্ষণ’ এখনো বহাল। কিন্তু তা এক্সপাঞ্জ করতে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি।

হাইকোর্ট তাঁর ৩ নম্বর নির্দেশনায় লিখেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটা যতটা সম্ভব কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা পূরণ করতে সব দরকারি পদক্ষেপ নেবে এবং যে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদ কোটায় পূরণ হবে না, সে ক্ষেত্রে ২০১০ সালের ৬৪০৬ নম্বর রিটের নির্দেশনা অনুযায়ী সেসব পদ শূন্য রাখতে হবে।’ এই নির্দেশনা আপিল বিভাগ বাতিল করেছে কি না, তা বোধগম্য নয়। আপিল বিভাগের ২০১৫ সালের রায় বা আদেশে তিনটি আলাদা প্রসঙ্গ এসেছে।

এক. রিটকারী মুক্তিযোদ্ধার বরাতে ডেইলি স্টার ১৯ জুলাই এক রিপোর্টে বলেছে, সরকার হাইকোর্টের রায় মেনে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার অবসরজনিত অতিরিক্ত সুবিধা আজও দেয়নি। ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের জন্য এক বছর বয়স বাড়ানো হয়। কিছুদিন পরে তা আবার সবার জন্যই প্রযোজ্য হয়। রিটকারীর অবসরে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত সুবিধা নির্ধারণে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা কোনো পার্থক্য ছিল না। তখন সরকারি ঘোষণা ছিল, আবার এক বছর বাড়ানো হবে। হাইকোর্ট ২০১২ সালে তাই রিটকারীর যুক্তি মেনে বলেছিলেন, বয়স বাড়লে তাঁকে ভূতাপেক্ষভাবে বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। ২০১৩ সালে ঠিকই ৬১ বছর করা হয়েছে। লেখকের মতে, আপিল বিভাগের ২০১৫ সালের ওই রায়ের পরে এটা সরকারের দেওয়ার কথা নয়। কারণ, আপিল বিভাগ তাঁর আদেশে বলেছেন, ‘তাঁকে ভূতাপেক্ষভাবে আর্থিক সুবিধা সরকার দেবে কি না, তা পলিসি ম্যাটার বা নীতির বিষয়।’ আপিল বিভাগ অবশ্য এটুকু বলেই থেমে গেছেন। তাই হাইকোর্টের নির্দেশনাটি থাকল না চলে গেল, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। তবে এই রায় মেনে সরকার স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছে। কারণ, কোটা সংস্কার আরও বড় পলিসি ম্যাটার।

দুই. আপিল বিভাগ হাইকোর্টের উল্লিখিত ৩ নম্বর নির্দেশনাটি ‘পর্যবেক্ষণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার থেকেও গুরুতর বিচ্যুতি হলো ৩০ শতাংশ কোটা প্রসঙ্গে হাইকোর্টের উচ্চারিত ‘যতটা সম্ভব’ (অ্যাজ পসিবল) কথাটি বাদ দেওয়া বা বাদ পড়া। চলমান বিতর্ক বিবেচনায় এটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হাইকোর্টের রায়মতে, ৩০ শতাংশ কোটা না মানা দূষণীয় নয়, কিন্তু আপিল বিভাগের উদ্ধৃতিমতে ৩০ শতাংশ কোটাই মানতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতা কী, সেটা বিদেশি দূতাবাসের উদ্দেশ্যে দেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় পরিষ্কার, বিসিএসে গত বছর ৭০ শতাংশই মেধা কোটায় নেওয়া হয়েছে।

হাইকোর্ট বিভাগের রায় বা পর্যবেক্ষণের কোনো অংশ এক্সপাঞ্জ করতে হলে আপিল বিভাগের রায়ে তার উল্লেখ থাকতে হবে। এরপর তা বাদ দিতে হবে। মন্ত্রীর দাবি, ৩০ শতাংশের কোটাসংক্রান্ত বাক্যটি এক্সপাঞ্জ হয়নি, এক্সপাঞ্জ করা হয়েছে তার শর্তাংশ। যাতে বলা আছে, ২০১০ সালের ৬৪০৬ নম্বর রিটের রায়ের আলোকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হলেও পদ শূন্য থাকবে। লেখকের সবিনয় দাবি, মন্ত্রীর ব্যাখ্যা ভুল হতে পারে। কারণ, আপিল বিভাগ ৩ নম্বর নির্দেশনাটির কোনো কিছুই এক্সপাঞ্জ করেনি। এক্সপাঞ্জ করেছেন চিকিৎসার সুবিধাসংক্রান্ত ৫ নম্বর নির্দেশনা। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় রেয়াত পান, সেটা দিতে রাজি নয় সরকার। আপিল বিভাগও সরকারের সঙ্গে একমত হন।

তিন. লভ নামঞ্জুর করে দেওয়া আদেশে আপিল বিভাগ কী বলেছেন, তা নিয়ে আমি আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, দুজন জ্যেষ্ঠ ও এক তরুণ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলি। চারজন চার রকম মত দিয়েছেন। তবে মন্ত্রীর ব্যাখ্যা কেউ গ্রহণ করেননি। আদেশটিতে হাইকোর্টের দুটি উদ্ধৃতি আছে। ৩০ শতাংশ কোটা ছাড়া অন্যটি হলো সরকারি পরিবহনের মতো চিকিৎসার সুবিধাদানসংক্রান্ত হাইকোর্টের ৫ নম্বর নির্দেশনা। এটি অবিকল তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় নির্দেশনা’, যেখানে ‘অ্যাটর্নি জেনারেল মুক্তিযোদ্ধাদের রেয়াতি মূল্যে সরকারি ও আধা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধাদানসংক্রান্ত হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণকে “এখতিয়ারবহির্ভূত” গণ্য করেছেন। আমরা বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের দেওয়া বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ মনে করি। ওই “পর্যবেক্ষণ” (এক বচনে ব্যবহার) ওপরে যেভাবে উদ্ধৃত করা হলো তা এক্সপাঞ্জ করা হলো।’ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান মনে করেন, ‘পরের নির্দেশনা’ উল্লেখ করায় ৩০ শতাংশ কোটাসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের কিছুই এক্সপাঞ্জ হয়নি, হয়েছে চিকিৎসাসংক্রান্ত ৫ নম্বর নির্দেশনা। উল্লেখ্য, মন্ত্রীর বিতরণ করা লিভ টু আপিল খারিজের নথিতে দেখি, অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর তাঁর লিখিত আবেদনে কোটা বা চিকিৎসা নিয়ে কোনো প্রতিকার চাননি।

ড. শাহদীন মালিকের সঙ্গে কথা বলে আমরা একমত যা পর্যবেক্ষণ, আপিল বিভাগ তাকে অবশ্য মান্য আইনে পরিণত করতে পারেন না। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের উভয় রায় অস্পষ্টতার দোষে দুষ্ট। মন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং বর্তমান জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় রায়টি অধিকতর স্পষ্ট করার জন্য বিলম্ব মার্জনার আবেদনসহ অ্যাটর্নি জেনারেলের উচিত হবে রিভিউয়ের দরখাস্ত করা।

রিভিউ প্রসঙ্গে বা কোটা বিষয়ে আদালতের অবস্থান স্পষ্ট বুঝতে আরও একটি রায়ের দিকে নজর দেওয়া দরকার। কারণ মন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, ওপরে উল্লেখ করা ৬৪০৬ নম্বর রিটের নির্দেশনার ভিত্তিতে কোটা পূরণ না হলে কোটা খালি রাখাসংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা আপিল বিভাগ এক্সপাঞ্জ করেছেন। আসলে ওই ৬৪০৬ নম্বর রিট মামলায় হাইকোর্টের রায়টি (২০১২) ছিল খাদ্য বিভাগের সাত চাকরিপ্রার্থীর কোটা বঞ্চনাকে ঘিরে। হাইকোর্টের নয় পৃষ্ঠার রায়টি পড়ে দেখি, সেখানে কোনো গাইডলাইন নেই। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ একটা কথা সাফ বলেছেন, ৩০ ভাগ কোটা মানতে হবে। পূরণ না হলে শূন্য থাকবে। আর তা আদালতের নিজস্ব বক্তব্য ছিল না। তারা ২০১০ সালের জারি করা ওই সরকারি নীতি সরকারকে মানতে বলেছেন, ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ লিভ মঞ্জুর করেই হাইকোর্টের এই রায় সমর্থন করেছেন। আদালতের রায়ের সর্বত্র সন্তানের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন নাতি-নাতনিরাই কোটাপ্রার্থী।

একটি রাষ্ট্রে কোটা কখন কীভাবে থাকবে বা থাকবে না, তা সর্বদা সব যুগে একটি নীতির বিষয়। কোনো আদালত কখনো এর পরিবর্তনে বাধা আরোপ করতে পারেন না। ওই রায়গুলো যেটি যেভাবেই থাকুক, সময়ের সঙ্গে চলতে কোনো নীতি বদলে সরকার বা সংসদের জন্য তা বাধার কারণ হতে পারে না। কোটা যা পুরোপুরি দেওয়া যায় না, তা বহাল রাখা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির জন্ম দেয়। এক মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেছিলেন, ৬৫ জনকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নেওয়া হয়েছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখি তাঁরা সবাই মেধা কোটায় সুযোগ পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মেধাবী উত্তরাধিকারীরা খামোখা দুর্নাম কিনছেন।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Hi! I am a robot. I just upvoted you! I found similar content that readers might be interested in:
https://bodyspace.bodybuilding.com/

Thanks you robot.all right