ছাদ পেটানোর গান নিয়ে দু-চার কথা

in rndailylife •  2 years ago 

selim.jpg
সেলিম মণ্ডল

আমাদের ‘তবুও প্রয়াস’ পত্রিকায় লোকসংস্কৃতির ওপর কয়েকটি কাজ হয়েছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কোনও বইয়ের সম্পাদনা করব সত্যিই ভাবিনি। তবুও যখন বিষয় ‘ছাদ পেটানোর গান’! এই কাজটা শুরুর আগে পর্যন্ত এই বিষয় সম্পর্কে একেবারেই অবগত ছিলাম না। আমাদের পাশের পাড়ায় একজন গান করে। ছোটবেলা থেকে জানি। কিন্তু ওটা কী গান জানি না। লোকটা পাড়ায় পাড়ায় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-বাসন বিক্রি করত। কেউ কেউ যখন বলত, “ও বদর কাকা, দুটো গান শোনাও না”। কারও ধানের গোলা বা কুঁড়ে ঘরের দেওয়ালে সাইকেল ভর্তি হাড়ি-বাসন ঠেস দিয়ে রেখে, উঠোনের মাঝখানে গান করত। ওকে গোল করে ঘিরে কত লোক থাকত ঠিক নেই! আমি বহুবার শুনেছি। কথায় কথায় একদিন সন্দীপদার (জনসন সন্দীপ) থেকে জানতে পারি ওগুলো ‘ছাদ পেটানোর গান’। বদর মিস্ত্রি আসলে ছাদ পেটানোর কাজ করত। এখন ঢালাই ছাদ আসার পর পেটানো ছাদ উঠে গেছে বলা যায়। প্রথম উৎসাহটা দেয় সন্দীপদা। আমি, রবিউলকে বলি। রবিউল ইসলাম। আমার বন্ধু। ‘তবুও প্রয়াস’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর একজন। আমাদের চাপড়াতে বাড়ি। ও গবেষণার থিসিস জমা দিয়ে বাড়িতে বসে। ও ভীষণ উৎসাহ দেখায়। দু-জন নেমে পড়ি কাজে। রোদে জলে-পুড়ে প্রায় একবছর ধরে চলে জলঙ্গির পাড়ে আমাদের গানের রেকর্ডিং।

‘ছাদ পেটানোর গান’ কোনও স্বতন্ত্র গান নয়। এটা সারিগানের একটি ভাগ বলা যায়। সারিগান বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি ধারা। এই ধারার মধ্যে মাঝিদের গান, ছাদ পেটানোর গান, ক্ষেত নিড়ানির গান, পাট কাটার গান, ধান ভানার গান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ছাদ পেটানোর গান সারিগানের পর্যায়ভুক্ত। ‘সারি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল গমন করানো। ‘সারি’ শব্দের অপর একটি অর্থ হল পঙ্‌ক্তি বা শ্রেণি। নৌকা চালানোর সময় মাঝিরা সারিবদ্ধভাবে বৈঠা টেনে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং কাজের স্ফূর্তির জন্য গান গাইত। এই কারণে এই গানকে সারিগান বলা হয়। তবে বর্তমানে সারিগান আর শ্রমসঙ্গীত একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

লোকশিল্পী বদর মিস্ত্রি তাঁর ছাদ পেটানোর যে অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করেছিলেন সেটি সংক্ষেপে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি—

ছাদ তৈরি হত লাল পাথর (এই এক ইঞ্চি দেড় ইঞ্চির মতো), সুরকি আর চুন মিশিয়ে ছাদে দেওয়া হত মোটা করে। চুন, সুরকি আর পাথর ভিজিয়ে ভালো করে মাখা হত। তারপর সে মাখাগুলি ছাদে ঢেলে মুনিশ বাটাম মারতে মারতে যেত পিছনে মিস্ত্রিরা। মাখা হয়ে গেলে ঢাল ঠিক করা হত। কোণাগুলো ৪ ইঞ্চি ও সেন্টারে ৬ ইঞ্চি। নালির মুখে দেওয়া হত ৩ ইঞ্চি ঢাল। যাতে জল না জমতে পারে। এরপর চুন-সুরকি চালনে ঢেলে বাটাম মারার পর যেখানে যেখানে দাঁত আছে সেখানে আবার ভালো করে মেখে পাটা দিয়ে সমান করা হত।

দু কামরা ঘর যদি হয় তাহলে প্রায় ১৮ জন লাগত। তারপর পিটুনি দিয়ে ছাদ ঘষতে হয়। তারপর কিছু সিমেন্ট দিয়ে আবার ন্যাপার মতো মুছে মসৃণ করতে হয় যাতে ছোট ছোট গর্তগুলো বুজে যায়। আবার সিমেন্ট দিয়ে ঘষে ভালো করে পিটনি দিয়ে ঘুঁটতে হয়। এরপর কর্নিক দিয়ে পালিশ করা হয়। যাতে ঘরের মেঝের মতো হয়ে যাবে, চকচক করবে। ওর উপরে মসনির তেল হলে ভালো হয়, মসনির তেল আঠালো হয়। মসনির তেল যদি না পাওয়া যায় তাহলে সরষের তেল দেওয়া হত। বৃষ্টি হলে বৃষ্টি দাঁড়াবে না, সেজন্য। তেল দিয়ে তার উপর জারমানি দিয়ে ঢেকে রাখা হত। এই জারমানিগুলো দিন পনেরো রাখা হত। তারপর জারমানিগুলো ফেলে দিয়ে ছাদ জল দিয়ে ধুয়ে দিলেই হয়ে গেল।

লোকসঙ্গীতের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ‘ছাদ পেটানোর গান’ও তার ব্যতিক্রম না। নীচে এই গানের কিছু বৈশিষ্ট্য দেওয়া হল—

১। এই সঙ্গীতের নির্দিষ্ট কোনও নিয়মবিধি নেই।
২। প্রেম-বিরহ, হাসি-কান্নাই মূলত এই গানের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
৩। এই গান কখনও একজন, কখনও একের অধিক মিলে গাওয়া হয়।
৪। এই গানের ভাষা সহজ ও সরল।
৫। এই গান খুব বেশি নিজের জীবনযাপন ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
৬। এই গানগুলোর অধিকাংশ মুখে শুনে শুনেই প্রচলিত।
৭। এই গান ভাব ও অর্থের দিক দিয়ে খুব সমৃদ্ধ।
৮। এই গান কখনও কখনও আঞ্চলিক গান হয়ে ওঠে। কারণ, এই গানে নিজস্ব আঞ্চলের ভাষা ও বিষয় খুব প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
৯। এই গান চর্চার জন্য নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন হয় না।
১০। এই গানে অনেকসময় গ্রাম বাংলার নানা মিথ উঠে আসে।

নীচে ‘ছাদ পেটানোর গান’ বই থেকে তিনটি গান দেওয়া হল। গানগুলো পাঠ করলেই আমরা অনুধাবন করতে পারব এই গানের ধারা বা বৈশিষ্ট্য।


এত কী ভালোবাসো কালা
কদম গাছের তলা
আরে ও কালা চাঁদ… ও কালা…

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!