কুঞ্জবাবুর আশঙ্কাই সঠিক দেখা গেলো । কুকুরটির মালিকেরাই কুকুরটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে শেষ করার জন্য । তারাই গুলি করেছে । কিন্তু, এই কুকুরটি একটা অসাধারণ কুকুর । সারমেয়প্রেমী কুঞ্জবাবু তাঁর সারা জীবনেও এমন অসাধারণ কোনো কুকুর দেখার কথা তো দূরে থাক, শোনেননি পর্যন্ত । তাহলে, তার মালিকেরা কেন এত উঠে পড়ে লেগেছে সেটিকে শেষ করতে ? কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না । সব কিছু কেমন যেন রহস্যের একটা ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া । এই কুয়াশার চাদর ছিন্ন না করলে কোনো কিছুই আর বোঝা সম্ভবপর নয় ।
এবার কুঞ্জবাবু পল্টু আর পাঁচুকে সবটা খুলে বললেন । পল্টু আগেই শুনেছিলো কুঞ্জবাবুর কুকুরপ্রাপ্তির বিষয়টি । সেই সাঁঝবেলায়ই । তাই মাঝরাত্তিরে ঝিলের ধারে ওই অদ্ভুত ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সে আর পাঁচু সর্বপ্রথম ছুটে এসেছে কুঞ্জবাবুর কাছেই । সব কিছু খুলে বলার জন্য । কুঞ্জবাবুও পাঁচু আর পল্টুর কাছে তাই কিছুই আর গোপন রাখলেন না ।
রাইফেল, পিস্তল আর শটগানের গুলি খেয়েও যে কুকুর দিব্যি বেঁচে থাকে সেটি যে একটি অসাধারণ কুকুর এ ব্যাপারে পাঁচু আর পল্টুও একমত হলো । তারাও জীবনে এমন অসাধারণ কোনো কুকুরের কথা শোনেনি কোথাও । এরপরে কুঞ্জবাবু তাদেরকে সেই মাইক্রো ট্র্যাকার চিপটি দেখালেন ।
পল্টু আর যাই হোক মাধ্যমিক পাশ করা ছেলে । উচ্চ মাধ্যমিকে এখন সায়েন্স নিয়েই পড়ছে । সে লহমায় বুঝে গেলো কুঞ্জবাবুর আশংকার কথা । সত্যিই তো ঝিলের ধারে সেই বুড়োটে লোকটার হাতে একটা টিভি রিমোটের মতো যন্ত্র ছিল যেটা দিয়ে সে কুকুরটির অবস্থান ট্র্যাক করার চেষ্টা করছিলো । যন্ত্রটা সেই মুহূর্তে কোনো কারণে কাজ করছিলো না এটা ঠিক, কিন্তু তারা তো একদম নির্ভুলভাবে ঝিলের ধারে যেখানটায় কুকুরটিকে পাওয়া গিয়েছিলো সেখানে হাজির হতে পেরেছিলো ।
তাহলে, তো সেই দুর্বৃত্তের দল খুব শীঘ্রই কুকুরের খোঁজে কুঞ্জবাবুর বাড়িতেও হানা দিতে পারে । বিশেষ করে যখন ট্র্যাকার চিপটা হঠাৎই আবার সক্রিয় হয়েছে । কিন্তু, কিছুতেই এই অসাধারণ প্রাণীটিকে ওই দুর্বৃত্তদের হাতে অসহায়ের মরতে দেওয়া যায় না । কিছু তো একটা করতেই হবে । যে করেই হোক কুকুরটিকে বাঁচাতে হবে ।
কুঞ্জবাবু বিড় বিড় করে বললেন - "নিকুঞ্জ তোকে আমি যে করেই হোক বাঁচাবো ওদের হাত থেকে ।"
খুব দ্রুত ছোট্ট একটা মিটিং হলো তিনজনের মধ্যে । মিটিংয়ে সবাই মিলে রাজি হলো যে, সবার আগে ওই মাইক্রো চিপটাকে দূর করা উচিত । কুঞ্জবাবু মাইক্রো চিপটি পল্টুর হাতে দিয়ে বললেন -
"যা বাবা, এটাকে দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয় । বাড়ির বাইরে এমন কোথাও ফেল যাতে এর অবস্থান জানতে পারলেও বদমাশের দল এটাকে হাতে না পায় ।"
পল্টু মুহূর্তের মধ্যে চিপটি নিয়ে দরজা খুলে রাতের অন্ধকারে হাওয়া হয়ে গেলো ।
তার ইচ্ছে এটাকে নিয়ে গাঁয়ের পশ্চিমদিকের চন্ডী মণ্ডপের পাশে যে মজা দীঘিটা আছে ওটার মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া । মজা দীঘিটা এক সময় প্রকাণ্ড একটা জল টলটলে সুপেয় জলের দীঘি ছিল । এখন কালক্রমে দীঘির জল কমে অসংখ্য ঝোপঝাড়, শ্যাওলা, কলমি আর কচুরিপানার দামে ভর্তি হয়ে আছে । জল দেখাই যায় না । জলের চাইতে কাদা প্রচুর । অসংখ্য ঝোপঝাড়ে সাপের আড্ডা শুধু । ওখানে একবার ফেললে ছোট্ট এত্তটুকুন এই চিপটা খুঁজে বের করা এক প্রকার অসম্ভব ।
গাঁয়ের অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যতটা দ্রুত ছোটা সম্ভব ততটা জোরে ছুটছে পল্টু । চণ্ডীমণ্ডপের থানটা এখনো বেশ কিছুটা দূরেই রয়েছে । ছুটতে ছুটতে পল্টু টের পেলো অন্ধকারের মধ্যে কেউ তার পিছু নিয়েছে । এক জোড়া ছুটন্ত পায়ের শব্দ পাচ্ছে সে প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক তার পিছু পিছুই । ছোটার গতি একটু বাড়ালো পল্টু । পিছনে পদশব্দের শব্দও সেই সাথে বাড়লো ।
নিঝুম শীতের রাতের ঘুমন্ত গাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে পল্টুর সর্বাঙ্গ দিয়ে ঘাম ছুটছিল । তার মাথায় শুধু একটা চিন্তাই আসছে - "লেজার গান আছে ওদের কাছে, আর ট্র্যাকার চিপটা এখন পল্টুর কাছেই রয়েছে । খুবই সহজ টার্গেট ।"
ওদের টার্গেট এখন পল্টুই । কথাটা ভাবতেই দারুন আতঙ্কে দিশেহারা পল্টু গতি বাড়িয়ে দিলো ছোটার ।