বনফুল বাংলা সাহিত্যে একটি অতি প্রিয় নাম। লোককান্ত। রসিকচিত্ত-চমৎকারকারী। সাহিত্যের -বর্থে কলাকুশল জীবন-শিল্পী তিনি। কাব্যে নাটকে উপন্যাসে ছোটগল্পে তাঁর সৃষ্টিকর্ম যেমন অক্লান্ত তাঁর জীবনজিজ্ঞাসাও তেমনি অন্তহীন। প্রাচুর্যে ও বৈচিত্র্যে তাঁর লেখনী অজস্রবর্ষী। শিল্পরূপায়ণে—নব নব রীতি ও রূপনির্মাণে তাঁর তুলনা নেই। জীবনের গবেষণাগারে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের যেমন তাঁর শেষ নেই, সাহিত্যের রূপকর্মশালায় বাণীলক্ষ্মীর নব নব রত্নাভরণ-রচনাতেও তাঁর উৎসাহের অন্ত নেই। শুধু তাঁর উপন্যাসের কথাই যদি ধরা যায়, ‘তৃণখণ্ড’, ‘বৈতরণী-তীরে’, ‘কিছুক্ষণ’, ‘মৃগয়া’ থেকে আরম্ভ করে ‘দ্বৈরথ’, ‘নির্মোক’, ‘রাত্রি’, ‘সে ও আমি’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘নতৎপুরুষ’, ‘অগ্নি’, ‘স্বপ্নসম্ভব’, ‘জঙ্গম', ‘স্থাবর’, ‘ডানা’, ‘মানদণ্ড', ‘ভুবন সোম’ পর্যন্ত ছোট-বড় মাঝারি হরেক রকমের বহু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। উৎকর্ষের বিচারে সবগুলিই যে সমান আসন পাবে এমন কোনো কথা নেই; কিন্তু একটি বিষয় চক্ষুষ্মান না পাঠকমাত্রকেই বিস্ময়ের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, প্রায় প্রত্যেক উপন্যাসই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে রচিত। উপন্যাসের সংখ্যা তাঁর অল্প নয়, কিন্তু শিল্পরীতি ও রূপকর্মের দিক দিয়ে পুনরাবৃত্তি তাঁর সৃষ্টিতে কোথাও নেই। যুগান্তকারী প্রতিভার পক্ষেও এ শক্তি দুর্লভ। বস্তুত বিচিত্ররূপী কারুশিল্পী হিসাবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বনফুলের কীর্তি অতুলনীয়। র কা সাহিত্যের চতুরঙ্গ-বর্থে তাঁর সার্থক আত্মপ্রকাশের কথা বলা হয়েছে।
কাব্যে—বিশেষত প্রথমদিককার রঙ্গব্যঙ্গমিশ্র হাস্যসরস কাব্যে তাঁর পরিহাসরসিক চিত্তের সমধিক পরিচয় পাওয়া যাবে। নাট্য-সাহিত্যে—বিশেষত জীবনী-নাট্য-রচনায় মধুসূদন-বিদ্যাসাগরের স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে নবযুগের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। কিন্তু কথাসাহিত্যেই তাঁর শক্তিমত্তার সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়েছে। অবশ্য সেক্ষেত্রেও ঔপন্যাসিক বনফুল আর ছোটগল্প-স্রষ্টা বনফুলের মধ্যে পার্থক্য অনেক। উপন্যাস তাঁর নিত্যনবায়মান শক্তিমত্তার সাক্ষ্যমঞ্চ, কিন্তু ছোটগল্পেই রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। উপন্যাসে কত বিচিত্র মানুষ; কত বিচিত্র কাহিনী; কত বিচিত্র ধরনে তাদের কথা বলার সজ্ঞান সচেতন প্রয়াস। জীবনকে শিল্পে ধরে রাখার কত নতুন নতুন প্রয়োগনৈপুণ্য! সাহিত্য-শিল্পীর সেখানে কৃতিত্ব অপরিসীম। কিন্তু সৃষ্টিপ্রেরণা ও সৃষ্টিধর্ম যেখানে অপৃথগ্যত্নসম্ভূত সেখানেই বাণীপ্রকাশ চরমোৎকর্ষ লাভ করে। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টাও সেখানে স্বয়ংপ্রকাশ। ছোটগল্পের ক্ষেত্রেই বনফুলের এই আত্মপ্রকাশ সবচেয়ে সার্থক ও সহজ হয়ে উঠেছে। এখানেই তাঁর জীবনদর্শন সম্যক স্ফুর্তি পেয়েছে। তাঁর শিল্পরীতি তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রতীক হতে পেরেছে।