রুমা থাকে স্টোররুমে। এই ফ্ল্যাটের স্টোররুম কিচেসের পাশে। এবং রুমটি মোটামুটি ভালই। বহুকালের পুরনো একটা সিঙ্গেল খাট অকেজো হয়ে পড়েছিল। স্টোররুমের অন্যান্য প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে একপাশে খুলে রাখা হয়েছিল খাটটি। রুমা নিজেই স্টোররুমে সেটা ফিট করে নিয়েছে।
কাজের মেয়ে হলেও মেয়েটি ভাল। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশুনো করেছে। পিরোজপুর এলাকার গ্রামের মেয়ে। একদা স্বচ্ছল গেরস্ত ছিল বাবা। দিনে দিনে দরিদ্র হয়ে গেছে। অনেকগুলো ভাইবোন রুমাদের। বেচেঁ থাকার আশায় যে যেদিকে পেরেছে ছুটে গেছে। রুমা এসে পড়েছে এখানে । প্রায় বছর খানেক হল । রুমা এখন পিংকির সারক্ষনের সঙ্গী। পিংকিকে স্কুলে নিয়ে যায়। পিংকি যতক্ষণ স্কুলে থাকে পিয়কির অপেক্ষায় স্কুল গ্রাউন্ডে বুস থাকে। ছুটির পর রিকশা করে পিংকিকে নিয়ে বড়ি ফেরে। তারার পিংকির খাওয়া গোসল এবং ঘুম পাড়ানো, শুধুমাএ পিংকির কাপড় কাঁচা পিংকির বইপএ এবং খেলনা গুছিয়ে রাখা এ সবই করে রুমা।
বাড়ির অন্যান্য কাজ করার জন্য একজন মাঝবয়সী বুয়া আছে। বাজার টাজার করার জন্য আছে মান্নান নামের এা ছোকড়া। ছোকড়াটি সাহেবের ইনডেনটিং ফার্মের পিয়ন। সকাল আটটার দিকে এসে প্রথমে বাজার করে সে। তারপর সাহেবের সঙ্গে সাহেবের গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে অফিসে যায়।
রুমা আছে শুধু পিংকির জন্য।
পিংকিটা আবার রুমার খুব ভক্ত হয়েছে। দুপুরবেলা হোক রাতেরবেলা হোক ঘুমোবার আগে গল্প শোনা চাই পিংকির । পাঁচ বছরের মেয়ে কিন্তু গল্প না শুনে ঘুমোবে না। রুমা গুছিয়ে বেশ সুন্দর করে গল্প বলতে পারে পিংকিকে আদরও করে খুব। সুতরাং পিংকি গেছে রুমার দারুণ ভক্ত হয়ে। রুমা ছাড়া কিছু বোঝে না পিংকি।
আজ সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় রুমাকে না দেখে পিংকি তো অবাক। চোখ বড় বড় করে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন! রুমা কই?
পিংকির মা তখন পিংকিকে স্কুলের পোশাক পরিয়েছে সাদা কেডস এবং সাদা মোজা পরিয়েছে। চুলে ব্যান্ড লাগিয়ে ঝুটি করে দিয়েছে। পিঠে স্কুলের ব্যাগ ঝুলেয়ে দিয়েছে। তখুনি পিংকির এই প্রশ্ন।
মা বলল, রুমা শুয়ে আছে। রুমার জ¦র।
পিংকি অবাক গলায় বলল, তাহলে আমি স্কুলে যাব কার সঙ্গে?
আমার সঙ্গে যাবে।
তোমার সঙ্গে যাব কেন?
তারপরই বেঁকে বসল পিংকি। না আমে তোমার সঙ্গে যাব না। আমি রুমার সঙ্গে যাব।
গুট গুট করে হেঁটে রুমার রুমের দিকে চলে গেল পিংকি।
লীলা তখন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে পিংকির এসব কান্ড দেখছিল। পিংকি যখর রুমার রুমের দিকে চলে গেল, পিংকির মা, লীলার আপা লীলার দিকে তাকিয়ে হামল। দেখছিস কান্ড?
লীলাও হাসল। পিংকিটা রুমার খুব ভক্ত। এমন তো করবেই।
চলত দেখি কী কথা বলছে রুমার সঙ্গে!
তারপর পিংকির পিছু পিছু দুবোন ুগয়ে দাঁড়িয়েছে রুমার মুমের দরজায়।
দৃশ্যটি ছিল একেবারে ফিলমের দৃশ্যের মতো। জ¦র নিয়েই বিছানায় উঠে বসেছে রুমা। বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে পিংকিকে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করছে ্। শিমুর মতো আধো আধো গলায় বলছে, আজ আম্মুর সঙ্গে স্কুলে যাও। আমার তো জ¦র। তোমাকে নিয়ে আজ স্কুলে গেলে আমে তো মরে যাব আপু। যাও আম্মুর সঙ্গে যাও।
পিংকি বলল, তোমার জ¦র হয়েছে কেন?
এমনি। মানুষের তো জ¦র হয়।
তুমি ওষুধ খাওনি কেন?
খেয়েছি তো।
তাহলে ভাল হওনি কেন?
এই তো কালই ভার হয়ে যাব।
কাল আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ।
সত্যি?
সত্যি।
আচ্ছা।
পিংকি তারপর স্কুলে গেছে।
সোনালি চলে যাওয়ার পর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে রুমার কথা মনে পড়ল লীলার । বুয়াকে আপা বলে গিয়েছিল রুমাকে চা নাস্তা দিতে। দিয়েছে কি না লীলা জানে না। বুয়াটা একটু হিংসুটে ধরনের। রুমাকে খুবই হিংসে করে সে। তার ধারণা তার মতো কাজের মানুষ হয়েও রুমা আছে মহাসুখে। সংসারের কোনও কাজই রুমার করতে হয় না। সব কাজই সে একা করে। রুমা করে শুধু পিংকির কাজ। পিংকির যেটুকু কাজ ও কোনও কাজ হল!
ডাইনিংস্পেসে দাঁড়িয়ে লীলার মনে হল বুয়া নিশ্চয় চা নাস্তা দেয়নি রুমাকে । রুমার জ¦র দেখে এক ধরনের প্রতিশোধ নিচ্ছে।
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুমার রুমে গিয়ে ঢুকল লীলা। ঢুকে অবাক হয়ে গেল। বিছানায় বসে চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটি খাচ্ছে রুমা আর বুয়া বসে আছে তার সামনে। মা যেমন নিজের অসুখে পড়া ছেলে মেয়েকে জোড় করে বকাঝকা করে খাওয়ায় কিংবা খাবার দিয়ে সামনে বসে থাকে, না খেতে চাইলে রেগে যায়, বুয়ার ভঙ্গিটা অনেকটা তেমন।
লীলা যখন রুমে ঢুকল বুয়া তখন রুমাকে বলছে, জ¦রজ¦ারি হইলে পেট ভইরা খাইতে হয়। না খাইলে জ¦র ভাল হয় না। খাও পেট ভইরা খাও।
দৃশ্যটি দেখে এবং বুয়ার কথা শুনে হাফ ছাড়ল লীলা। মনটা কী রকম ভাল হয়ে গেল তার। রুমার দিকে তাকিয়ে লীলা বলল, কী রে রুমা জ¦র কমেছে? রুমা কাতর গলায় বলল, এখন একটু কম।
দেখি।
লীলা এগিয়ে গিয়ে রুমার কপালে হাত ছোঁয়াল।
জ¦র আছে। তবে কম।
লীলাকে গেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল বুয়া। রুমার খাওয়া হয়ে গেছে। চায়ের কাপটাপ নিয়ে চলে গেল সে।
লীলা বলল, এখন একটা প্যারাসিটামল টেবলেট বের করল রুমা। পানির জগ গ্লাস হাতের কাছেই ছিল, টেবলেটটা খেয়ে নে। খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক । বিকেল নাগাদ ভাল হয়ে যাবি।
জ¦ী আচ্ছা।
বালিশের তলা থেকে একটা প্যারাসিটামল টেবলেট বের করশ রুমা। পানির জগ গ্লাস হাতের কাছেই ছিল, টেবলেটটা খেয়ে ফেলল।
লীলা বলল, আমি ভেবেছিলাম বুয়া তোর চা নাস্তা নিয়ে আসবে না। এজন্যে খবর নিতে এসেছিলাম।
রুমা ম্লান মুখে হাসল। না, বুয়া খুব একটা খারাপ মানুষ নয়।
তোকে তো খুব হিংসে করে।
তা করে। এই বয়সী কোনও কোনও মানুষ এমন হয়। তবে বুঝতে পারলাম হিংসে করলেও আমার জন্যে মায়াও আছে বুয়ার।
একসঙ্গে থাকতে থাকতে একজনের জন্যে আরেকজনের এমন মায়া নিজেদের অৎান্তেই হয়ে যায়।
রুমা একটু চুপ করে কী ভাবল। তারপর চোখ তুলে লীলার দিকে তাকাল। কে এসেছিল?
লীলা মৃদু হাসল। একটি মেয়ে!
কি নাম?
সোনালি।
ও নাটক করে। ছোট মামার কাছে এসেছিল?
হ্যাঁ।
ছোট মামার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
রুমা বেশ চমকাল। কেন?
মনজুভাই তো বাসায় নেই।
জ¦ী?
হ্যাঁ। সে তো সকালে বেরিয়ে গেছে।
কোথায়?
কী জানি!
আপনি তাকে বেরুতে দেখেছেন?
না।
তাহলে কে বলল আপনাকে সে বেরিয়ে গেছে।
কেউ বলেনি। আমার মনে হল সে বাসায় নেই। বেরিয়ে গেছে।
রুমা হাসল। বেরোয়নি। সে এখনও ঘমোচ্ছে। এগারোটার আগে ঘুম থেকেই উঠে না।
লীলা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, যা ইচ্ছে করুক গে। আমার মনে হয়েছে বাসায় নেই আমি সোনালিকে বলে দিয়েছি।
মামা শুনলে খুব রাগ করবে।
কেন?
বোধহয় মোনালিকে সে আসতে বলেছিল।
তুই কী করে বুঝলি?
আমার মনে হচ্ছ্ েমেযেটি মামার সঙ্ঘে টিভিতে নাটক করে। বোধহয় নাটকের কাজেই মামা তাকে আসতে বলেছিল।
লীলা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মনজুর রুম থেকে তার ঘলা ভেসে এল। ভাবী, কফি দাও।
মনজুর গলা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল লীলা।
রুমা হাসল। কী বলেছিলাম!
লীলা বলল, রুমা তুই আমার একটা কাজ করবি?
কী কাজ?
সোনালি যে এসেছিল কথাটা আমি মনজু ভাইকে বলতে চাই না।
মানে?
মানে সোনালি আসেনি। আমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি।
কিন্তু সোনালির সঙ্গে মামার দেখা হবেই। সোনালি মামাকে বলবেই।
বললে আমি অস্বীকার করব।
কী অস্বীকার করবেন?
পুরো ঘটনাটাই।
রুমা অবাক চোখে লীলার দিকে তাকিয়ে রইল।
লীলা হাসল। সোনালি নিশ্চয় এখানে এসে আমার মুখোমুখি হয়ে ব্যাপারটা আর প্রমাণ করবে না!
রুমা কথা বলল না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল লীলার মুখের দিকে।
তুই যে ব্যাপারটা জানিস, মানে আমিই তোকে বলেছি, এটা তুই কখনও কারও কাছে স্বীকার করবি না। আমার এই কাজটা তোর করতে হবে।
রুমা কী বুঝল কে জানে! মুখ উজ্জ্বল করে হাসল সে। বলল, আমি কখনও কাউকে বলব না।
রুমার কাঁধে হাত রেখে লীলা বলল, তুই খুব ভাল মেয়ে । তোকে আমার খুব ভাল লাগল। আজ থেকে তুই আমার বন্ধু। তোকে বলার মতো অনেক কথা আছে আমার। পরে বলব। তোর হেলপ লাগবে আমার। বল তুই আমাকে যে বোনও রকমের হেলপ করবি!
রুমা আবার আগের মতো হাসল। করব। আপনাকেও আমার খুব ভাল লেগেছে।
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!