‘এখন আমাদের দেখবে কে, তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব’

in verysade •  4 months ago 

নিহত সেলিমের স্ত্রী শোভা খাতুনের (ডানে) কোলে ৩ বছর বয়সী শিশু সন্তান। পাশে (বামে) নির্বাক হয়ে বসে আছেন মা। গত মঙ্গলবার চর ভবানীপুর গ্রামে
নিহত সেলিমের স্ত্রী শোভা খাতুনের (ডানে) কোলে ৩ বছর বয়সী শিশু সন্তান। পাশে (বামে) নির্বাক হয়ে বসে আছেন মা। গত মঙ্গলবার চর ভবানীপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো
‘আড়াই মাস আগে ওর বাবা মরে গেছে। আমার বেটার টাকায় চলত বড় ছোয়ালের পড়াশোনা আর চারজনের সংসার। বেটা আর নাইরে। এহন কিডা চালাবিনি সংসার?’ বিলাপ করতে করতে ভাঙা গলায় কথাগুলো বলছিলেন বুলজান খাতুন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জে একটি ভবনে হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে তাঁর ছেলে আবদুস সালামের (২৪) মৃত্যু হয়। গত শনিবার চিটাগাং রোড এলাকায় ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় এ ঘটনা ঘটে।

বুলজান খাতুন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের মৃত সাবের আলীর স্ত্রী। তাঁর ছোট ছেলে আবদুস সালাম নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় একটি ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ব্যাংকটির একটি শাখায় সাজসজ্জার কাজ করছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিসংতায় শনিবার বিকেলে ওই ভবনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সালাম।

ওই ঘটনার চার দিন পর গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুরে গ্রামের বাড়িতে সালামের লাশ আনা হয়। ওই রাতেই পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

চর ভবানীপুরে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডে আধাপাকা একটি ঘরের ভেতর সালামের মাকে ঘিরে বসে আছেন স্বজনেরা। আর তাঁর মা বিলাপ করে কাঁদছেন। আরেক কক্ষে বাকরুদ্ধ হয়ে শুয়ে আছেন সালামের স্ত্রী মারিয়া খাতুন। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনিও। পাশেই বিছানার ওপর খেলা করছে তাঁদের দেড় বছর বয়সী একমাত্র সন্তান। শিশুটিকে দেখে কেউ কেউ বলছিলেন, সে বুঝতেই পারছে না যে তার বাবা আর নেই।

সালামের মাকে ঘিরে বসে আছেন স্বজনেরা। ওই সময় তাঁর মা বিলাপ করে কাঁদছিলেন
সালামের মাকে ঘিরে বসে আছেন স্বজনেরা। ওই সময় তাঁর মা বিলাপ করে কাঁদছিলেনছবি: প্রথম আলো

ঘটনার প্রসঙ্গে সালামের বড় ভাই আলামিন বলেন, ‘গত শনিবার বিকেলে হঠাৎ ফোন দিয়ে সালাম আমাকে বলল, “ভবনে আগুন দিয়েছে। ধোঁয়ায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি (সালাম) মনে হয় আর বাঁচব না। তুই আমার স্ত্রী, সন্তান ও মাকে দেখে রাখিস।”’

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সেদিন (গত শনিবার) সালামের সঙ্গে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে সাজসজ্জার কাজ করছিলেন একই গ্রামের সেলিম মণ্ডল (২৮), মো. ফয়সাল মণ্ডল (১৮), মো. পারভেজ, হামিদুল ইসলাম (২৫) ও মাহবুব বিশ্বাস। ওই দিন আগুনে নিহত হয়েছেন সেলিম মণ্ডল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁর লাশও গ্রামে আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ফয়সাল, পারভেজ ও মাহবুব আহত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। হামিদুল ইসলাম ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।

একই ঘটনায় আহত হয়ে গ্রামের বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. ফয়সাল মণ্ডল
একই ঘটনায় আহত হয়ে গ্রামের বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন মো. ফয়সাল মণ্ডলছবি: প্রথম আলো
ফয়সালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে তাঁর দুই পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ১৪ জন মিলে ব্যাংকের ভেতর কাজ করছিলাম। সেদিন দুপুরেই ভবনের বাইরে থেকে শুধু গুলির আওয়াজ আসছিল। পুলিশের গুলিতে এক ছাত্র মারা গিয়েছিল। আর বিকেলে ব্যাংকের গেটে আগুন দেওয়া হয়। আগুনের কারণে প্রচুর ধোঁয়া ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমার কাকুরা (সেলিম ও সালাম) তিন তলায় চলে গিয়েছিল। প্রাণপণ চেষ্টা করে আমরা কয়েকজন নিচে চলে আসছিলাম।’

নিহত সেলিমের স্ত্রী শোভা খাতুন জানান, শনিবার বিকেলে ফোনে সেলিমের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। ফোনে বারবার তিনি বলছিলেন ‘প্রচুর ধোঁয়া। নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। হয়তো আর বাঁচব না। বাবা, মা, মেয়েকে দেখে রাখিস।’

বিলাপ করতে করতে শোভা বলছিলেন, ‘এখন আমাদের দেখবে কে? তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব?’

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!