কৃতজ্ঞতাবোধ শব্দটি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত

in writing •  10 months ago 

বর্তমানকালে "কৃতজ্ঞতাবোধ" শব্দটির অপমৃত্যু ঘটে গিয়েছে । কারণ, এই শব্দটির ব্যবহার এখন প্রায় নেই বললেই চলে । কি ভাবে প্রয়োগ হবে, এখন তো কেউই উপকারীর কৃতজ্ঞতাবোধ করে না কখনো । উপকারীর উপকার স্বীকার করে কৃতজ্ঞ এখন আর কেউই থাকতে চায় না । ছোটবেলায় আমরা বাংলা ব্যাকরণ বইতে "এক কথায় প্রকাশ" অনুচ্ছেটিতে পড়তাম -

"উপকারী উপকার স্বীকার করে যে" - কৃতজ্ঞ
"উপকারীর উপকার স্বীকার করে না যে" - অকৃতজ্ঞ
"উপকারীর অপকার করে যে" - কৃতঘ্
o-GRATEFUL-facebook.jpg

বিশ্বাস করুন এই শেষের শব্দটি আমার মনেই থাকতো না ভালো করে । "কৃতঘ্ন" । কী খটোমটো নাম । বাংলা ভাষায় এই শব্দের প্রয়োগ ছিল কম । মূলতঃ এটি সংস্কৃত শব্দ । আমাদের ছোটবেলায় কৃতঘ্ন শব্দটির প্রয়োগ কম ছিল তার কারণ মানুষ এখনকার মতো এতো অমানুষ হয়ে যায় নি তখনো । উপকারীর উপকার স্বীকার না করুক তার ক্ষতি করতো না সেভাবে তেমন কেউ । তাই প্রয়োগও করা পড়তো না ।

ইংরেজিতে শুধুমাত্র দুটি ওয়ার্ড আছে - "Grateful" আর "Ungrateful" - "কৃতজ্ঞ" আর "অকৃতজ্ঞ" । বিশ্বাস করুন, কৃতঘ্ন শব্দটি এতো রেয়ার ছিল একসময় যে বাংলা ভাষা এমনকি ইংরেজিতেও অপ্রচলিত ছিল । হিন্দিতেও অকৃতজ্ঞ বোঝাতে "নিমকহারাম" বা "বেঈমান" প্রচলিত ।

দুনিয়ায় কৃতঘ্ন হওয়ার মতো এতো নিকৃষ্ট পাপ আর কিছুতেই নেই । এক জনকে খুন করা আর কৃতঘ্ন হওয়া প্রায় সেইম ।

আমাদের ফ্যামিলিতে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এই কৃতঘ্ন হওয়া বহুবার দেখেছি জীবনে । মানুষ কী করে এতটা নিচে নামতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে । দু'একটা ঘটনার কথা বলি খুব সংক্ষেপে -

০১. অকৃতজ্ঞতা - এক এতিম বাচ্চাকে ফুটবল মাঠ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে নিজের পরিবারে ঠাঁই দিয়ে তাকে ছোট ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিলো আমার বাবা । সেই ছেলেটির পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরি-বিয়ে অব্দি সবই করেছিল আমার বাবা । সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে আমাদের পরিবারে লালিত পালিত হয়ে সেই লোকটা যখন নিজের পরিবার নিয়ে পৃথক হয়ে গেলো তখন আমার বাবার অসুস্থতার সময়ে বিন্দুমাত্র কোনো হেল্প করেনি । সেই লোকটার মেয়ের বিয়েতেও আমার বাবাকে নিমন্ত্রণ অব্দি করেনি । এর চাইতে অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে !

০২. কৃতঘ্ন - আমার বাবার আপন মেজো ভাইয়ের পরিবারের কোনো বড় খরচ সব সময় আমার বাবাই বেয়ার করতো - "বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পরিবারের কারো অসুখের চিকিৎসা, অপেরেশন" ইত্যাদি । এ ছাড়াও কত অজস্র উপলক্ষ করে যে আমার বাবার কাছ থেকে টাকা আনতো তার সীমা ছিল না । সেই বাবার মেজ ভাই ও তার ছেলে-মেয়ে একটা সময় আমার বাবা-মায়ের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করেছিল । বাবার ব্যাংকের চেকবুক লুকিয়ে রাখা, পৈতৃক সম্পত্তি যাতে বেদখল করতে পারে সে জন্য দলিল লুকিয়ে রাখা - প্রভৃতি জঘন্য কাজের সাথে দুর্ব্যবহার তো ছিলই । তবে, মৃত্যুর আগে তিনি ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিলেন বাবার কাছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ।

০৩. অকৃতজ্ঞ - বাবার এক বোন সাংসারিক অশান্তি সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে । সৌভাগ্যবশত দড়ি ছিঁড়ে পড়ে বেঁচে যায় । তারপরে বাবাই তার সেই বোন আর ভাগ্নীকে বাড়ি নিয়ে এসে আশ্রয় দেয় । তারাও বাবার অন্নে লালিত পালিত । বাবার সেই বোন আর কখনো স্বামীর বাড়ি ফেরত যায়নি । তার মেয়েকে খুব ছোট থেকে লালিত পালিত করেছে আমার বাবাই । পড়াশোনা, চাকরি এবং বিয়ের পর সেই মেয়ে একদিন বাবার সাথেই সব চাইতে বড় বেইমানি করলো । বাবার বোন এবং সেই ভাগ্নী শুধুমাত্র টাকার লোভে বাবার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করলো ।

০৪. অকৃতজ্ঞ - আমার এক জেঠতুতো বড় বোনের চাকরির জন্য আমি টাকা দিয়েছিলাম । বেশ মোটা অংকের টাকা । ধার হিসেবে দিয়েছিলাম যদিও, তবে টাকা ফেরত নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমার । তো চাকরি পাওয়ার পর আমার সেই বোন নানান রকম ফন্দি-ফিকির করা শুরু করলো যাতে ওই টাকাটা আর ফেরত না দেয়া লাগে । আমার নামে আর কি দুর্নাম করবে, তাই আমার বাবা-মায়ের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করা শুরু করলো । ব্যাপারটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে দেখে আমি একজনের মাধ্যমে বলে পাঠালাম যে সে যদি এমন খারাপ ব্যবহার করে আমার বাবা-মায়ের সাথে তবে ওই টাকা আমি ফেরত নেবো এবং কি ভাবে নেবো সে পথ আমার জানা আছে । যাই হোক এরপরে সে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল । তবে দীর্ঘ ১৩ বছর পরেও সেই টাকা কিন্তু আমি আজও পাইনি, অবশ্য পাওয়ার আশাও করিনি কখনো ।

০৫. কৃতঘ্ন - একদম লেটেস্ট একটা ঘটনা শেয়ার করেই আজকের লেখা এখানেই সমাপ্ত করছি । মাত্র সপ্তাহ দু'য়েক পূর্বে আমাদের পরিবারের খুব বিশ্বস্ত একজন চরম বিশ্বসঘাতকতা করলো আমাদের ফ্যামিলির সাথে । এই লোকটা সুদীর্ঘ তেইশ বছর ধরে আমাদের ফ্যামিলি থেকে নানান সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে । বলতে গেলে তার ফ্যামিলিই চলতো আমাদের টাকায় । যাকে আমরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম সেই লোকটা আমার মায়ের চেক জালিয়াতি করে ছ'লক্ষ টাকা তুলতে গিয়ে কোমরে দড়ি পরেছিলো । ব্যাংকের ম্যানেজার পুলিশে হ্যান্ডওভার করার ঠিক আগের মুহূর্তে ফোন করে আমরা তাকে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচাই । জেলের হাত থেকে বাঁচানো হলেও তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেছি । চরম কৃতঘ্ন এই লোকটাকে পুলিশে দেইনি শুধু তার দু'টো বাচ্চার জন্য । একটার বয়স মোটে ৬ বছর ।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...