সৃজনবহ্নি

in arrogance •  9 months ago  (edited)

সৃষ্টিশীল মানুষদের অনেকসময় এক ধরণের ক্রোধ থাকে যার উন্মেষ হয় ত্রুটি তথা imperfection এর প্রতি অসহিষ্ণুতা হতে। আসলে ত্রুটির প্রতিও না, বরং ত্রুটির অস্তিত্বের সম্ভাবনার প্রতি অসহিষ্ণুতাই এই ক্রোধের উৎস। ইংরেজিতে আমি এই ফেনমেননকে "Rage of creation" তথা "সৃষ্টির ক্রোধ" বললেও, বাংলাতে বলি "সৃজনবহ্নি"। সৃজনবহ্নিতে দহ্যমান সৃষ্টিশীল ব্যক্তি যে কাজে মাহির, সেই কাজ তিনি যখন তাঁর অধীন কোন নবিশকে করতে দেন তখন নবিশকে পদে পদে বাঁধা দেন; তাকে ঠেকে শিখতে দেন না। তিনি যেহেতু সেই কাজে সিদ্ধহস্ত, তিনি তো জানেন কোন ধারায় আগালে কাজটি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়বে। নবিশ কিন্তু জানে না, যে অমুক ধারা সঠিক আর তমুক ধারা বেঠিক। তবে তাকে ঠেকতে না দিলে যে সে শিখতে পারবে না, তা তাঁর গুরু নিজের "সৃষ্টিশীলতার ঠুলিরূপ" অহমের কারণে দেখতে পান না। আসলে তিনি এ নিয়ে চিন্তিতই না যে নবিশ কিছু শিখছে কি শিখছে না। সর্বাবস্থায় তাঁর প্রধান লক্ষ্য নিজের সৃষ্টিশীলতার শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করা; আমিত্বের মোহ তাঁকে নিজ অতিরিক্ত, স্বীয় স্বার্থের উর্ধ্বে আর কোন কিছু দেখতেই দেয় না। পদে পদে বাঁধা দেয়ার এই কাজটি তিনি করেন বড় কর্কশ ভঙ্গিতে; মাঝেমধ্যে তো গালিগালাজ আর গায়ে হাত তোলাও বাদ যায় না। নবিশের মনে আঘাত করে তিনি মনে করেন এটাই "ঠেকে শেখা"। কিন্তু এটা তার বিভ্রম তথা delusion বৈ কিছু না। এটাকে ঠেকে শেখা বলে না। বরং আমার তো মনে হয় এটা কোন ধরণের শেখার মধ্যেই পড়ে না। কারণ এই ধারায় এগোলে নবিশ শিখিতব্য বিষয়টির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে; তা তার মাঝে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক করবে না। কিন্তু তার গুরুর তো এসবে মন নেই! নিজের অন্যায্য দুর্ব্যবহারকে নবিশের "ঠেকে শেখার" নাম দেয়া ব্যস একটি কনফ্যাবুলেশন যার উদ্ভব তিনি করেছেন স্বীয় দম্ভের বিরুদ্ধে বিবেকের দংশনকে নির্মুল করতে, বিবেককে ঘুম পাড়াতে। মাঝেমধ্যে তো সৃজনবহ্নি রীতিমত দাবানলে রূপ নেয় আর তিনি নবিশের হাত থেকে কার্যসম্পাদনের আসবাবাদি ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই কাজটি করে ফেলেন; নবিশকে ক্রুদ্ধ কিন্তু দাম্ভিক ভঙ্গিমায় দেখিয়ে দেন, "This is how it's done, you good for nothing piece of crap!" আবার অন্যান্য সময়, নবিশের মনে সর্বোচ্চ আঘাতটা হেনে তার অসমাপ্ত কাজটা ধ্বংস করে দিয়ে তিনি দেখান যে নবিশ যা করেছে সব ছাইপাশ, সে এই কাজের জন্য যোগ্যই নয়... তাঁর মত সুযোগ্য নয় আরকি! এ দুই কাজকে দাবানলের সাথে তুলনা করলাম কারণ উভয় ক্ষেত্রেই নবিশের আর কিছু শেখা হয় না এবং তার স্পৃহারও মৃত্যু ঘটে, ঠিক যেমন দাবানল তার পথের সব সুন্দরকে ভস্মে পরিণত করে সদর্পে অগ্রসর হয়। সৃজনবহ্নিতে দহ্যমান সৃষ্টিশীল "গ্রান্ডমাস্টার" মুলতঃ এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে তিনি ছাড়া এই কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন আর কারো দ্বারা কখনো সম্ভবই না! নিজের লেগাসি রেখে যাওয়া ও নিজের ম্যান্টল পাস অন করার মত যোগ্য উত্তরসুরী তৈরির চেয়ে অধিক প্রিয় তাঁর কাছে হল মৃত্যুর পর তাঁর অভাব যে কতটা অপুরণীয় তার আলোচনা হওয়া বিভিন্ন সভা-সেমিনারে! এখন তাঁর কীর্তি যদি রিপ্রডিউসেবল হয় যোগ্য উত্তরসুরীর দ্বারা তাহলে তো তাঁর অভাব আর এতটা "অপুরণীয়" ঠেকবে না মানুষের কাছে, তাই না? The greater good seldom outweighs his own self-interest।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, দাবানল যেমন জীবনের স্পন্দনে সমৃদ্ধ সবুজ-শ্যামল গাছগাছালিকে পরিণত করে প্রাণহীন কৃষ্ণবর্ণ কাঠকয়লায়, তেমনি সৃজনবহ্নিতে দহ্যমান সৃষ্টিশীল মানুষও একসময় তাঁর সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন। কারণ সৃজনশীলতার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য উপকরণ হল নতুনকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা, বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতাই নয়, বরং আকর্ষণ এবং ভুল থেকে সুন্দরের জন্মের সম্ভাবনায় বিশ্বাস। সৃজনবহ্নি এই গুণত্রয়কে ধ্বংস করে। কার্যসম্পাদনকালে নবিশ ভুল পথে এগোচ্ছে হয়তো। কিন্তু তার দাম্ভিক গুরু বুঝতে চান না যে এটা "আপাতদৃষ্টে" ভুল পথ, তাঁর "এযাবৎ" অভিজ্ঞতায় ভুল পথ, "আপেক্ষিক" ভুল পথ - এর মানে এ নয়, যে তা পরম ভুল পথ। হয়তো এই পথে এগোতে গিয়ে সে এক নতুন সৃষ্টির সম্মুখীন হবে; হয়তো নতুন কোন সৌন্দর্যের আবির্ভাব সে ঘটাতে পারবে; হয়তো নতুন কিছু সে ডিস্কভার করবে। একেবারে আর কিছু না হলেও, কমপক্ষে সে অভিজ্ঞতা তো লাভ করবে! কিন্তু তাকে চরম রূঢ়তার সাথে পদে পদে বাঁধা দেয়া সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটায় না, বরং অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। নিজের প্রতিভার অহংকার, নবিশের সম্ভাব্য নবআবিষ্কারের খ্যাতির প্রতি পরশ্রীকাতরতা এবং মৃত্যুর পর সৃজনশীল পরিমন্ডলকে "তাঁর চলে যাওয়ায় অপুরণীয় ক্ষতিতে" পীড়িত হতে দেখার লোভ - এ তিনটি রিপু ইন্ধনরূপে জন্ম দেয় ক্রোধ নামক রিপুর "সৃষ্টিশীল" রূপের - আর একেই আমি আদর করে "সৃজনবহ্নি" বলি।
অনেকে বলতে পারেন, সৃজনশীল মানুষের খানিকটা অ্যাটিটিউড তো থাকেই বা থাকা লাগেই। তা সত্য। তবে সে অ্যাটিটিউডের লক্ষ্যবস্তু হয় নতুনত্ব, বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতা পরিপন্থী প্রতিবেশ; তারা নয় যারা সৃজনশীলতার মশাল ভবিষ্যতে বয়ে এগুবে। বরং ওপরের আলোচনায় আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে কিভাবে সৃজনবহ্নিজনিত রুঢ়তা নতুনত্ব ও সৃষ্টিশীলতার অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। প্রকৃত সৃজনশীল অ্যাটিটিউড কখনোই এমনটা হতে দিতে পারে না। কেও কেও বলতে পারেন, অনেকে নবিশকে ওভার-কনফিডেন্ট হয়ে নিজের সর্বনাশ ডাকা থেকে রক্ষা করতে তাদের কাজের প্রশংসা থেকে বিরত থাকেন। ঠিক কথা। পেশাদারিত্বের গন্ডির মধ্যে থেকে নবিশকে কাজে নিয়ত উন্নতি করতে থাকার প্রেরণা যোগাতে অনেক সৃজনশীল গুরু এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। কিন্তু কতটুকু "ঋণাত্মক" আচরণে নবিশ আরো ভালো করতে উদ্বুদ্ধ হবে আর কতটুকুতে তার কাজের স্পৃহা ধ্বসে যাবে, সেই প্রভেদটা আন্তরিক ও পেশাদার মেন্টরগণ জানেন। যারা এ দুইয়ের মাঝে পার্থক্যটা ধরতে পারেন না, তাদের ব্যাপারেই আমার বক্তব্য যে তারা "সৃজনবহ্নিতে দহ্যমান সৃজনশীল মানুষ।"
যদিও আমি আমার উল্লিখিত বক্তব্যে নবিশের প্রতি রুঢ়তার বিষয় দিয়েই সৃজনবহ্নিতে দহ্যমান সৃজনশীল ব্যক্তির পরিচয় করিয়েছি, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই রুঢ়তা কখনোই নবিশের প্রতি সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এমন ব্যক্তির আশেপাশের সবাই এই আগুনের হিংস্র হলকায় আহত হন। আর এভাবে ধীরে ধীরে একজন সৃজনশীল ব্যক্তি, যাঁর সৃষ্টিশীলতা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে আকৃষ্ট করার কথা ছিল, হয়ে পড়েন সবার কাছে অবাঞ্ছিত : তাঁর ক্ষেত্রে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে জলজল করে এই উক্তি,
"দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।"
raging_fire_of_creation.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...