কিছুদিন আগেই আমার আর শাহিদার ডিভোর্স হলো। তাই আমার কাছে এই ফাগুন বসন্তের ঋতু ভালো লাগেনা। কৃষ্ণচুড়ার লাল বর্ণে সেজে উঠাটাও আমি মেনে নিতে পারিনা। নদীর কলকল শব্দে মাতিয়ে তোলা তীর ভাংগা শব্দটাও আমার কাছে বিষদ মনে হয়। বসস্তের কোকিলের সুর কেমন যেন একঘেয়ে মনে হয়।
.
আমাদের জীবনটা খুব ভালোই ছিলো। সারাদিনের ব্যস্ততা মুখরিত জীবনে আমরাই শুধু যান্ত্রিক জীবন থেকে দুরে ছিলাম। সময়ে অসময়ে শাহিদাকে নিয়ে আনন্দ খুশী তে মেতে থাকাটা যেন একটি অভ্যাস ছিলো। এই তো সেদিন চায়ের কাপে চুমু দিতে শাহিদাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ছিলাম ‘‘কোন গগণ থেকে আনবো আমি সাতরংয়ের ধারা? কোন মেঘেরে ছায়ায় লুকাবো তোমার মায়া? কোন ঝর্ণার পানিতে করবো তোমায় স্লান? কোন ভালোবাসায় করবো তোমায় দান?”
.
সেও তো মিষ্টি হেসে আমার বুকে মাথা গুজে দিয়ে বললো ‘‘ঝড় ঝড় বাদল দিনে রাস্তার মোড়ল বাড়ির সামনের হালকা দুধে গরম চায়ের ভালোবাসাটাই আমার চাই”
.
খুব যতন করে ধরে রেখেছিলাম আমার শাহিদাকে। কিন্তু প্রতিটি গল্পের একটি অপরিবর্তিত নিয়ম থাকে যা আমরা চাইলেও মুছে ফেলতে পারিনা। চাইলেই তা পরিবর্তন পরিবর্ধন করা যায় না। এমন নিয়ম আমাদের জীবনেও ছিলো। কেইবা জানতো, একটি নিয়ম আমাদের দুটি মানুষকে দুই তীরে ঠেলে দিবে?
.
বাবা মায়ের অনুমতিহীন তাকে বিয়ে করাটাই হয়ত আমাদের উচিৎ হয়নি। যতবার ভেবেছি বিয়ের পড়ে আমাদের কে তারা মেনে নিবে, ততবারই আমাদের ভুল হয়েছে। আমার বাবা বড্ড কঠোর হৃদয়ের মানুষ। অবশ্য কঠোর বললেও ভুল হবে এটা তার অধিকার ছিলো। আমার বাবা মায়ের কোল জুড়ে আমিই একজন ছিলাম। আমাকে নিয়ে তাদের হাজারটা স্বপ্নের হাহাজারি ছিলো। আমি তাদের সমস্ত স্বপ্নগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে শাহিদাকে বিয়ে করে ফেলি। হয়ত যৌবনের ভুল ছিলো, তানা হলে ভালোবাসার পাগলামি। ভুল যে কারনেই হোক ভুল তো ভুলই হয়?
.
আজ আমার বাবা মৃত্যু সহ্যায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে মরণ সময় গুনছে। এমন সময়তেও বাবার কথা অটল ‘‘সেই ছেলে যেন আমার কবরে মাটি না দেয়, যে ছেলে আমার হাত ধরে বড় হয়ে, আমাকে ছাড়াই অন্যকারো হাত ধরে চলে গেছে” আমার বাবা যেমন শাহিদাকে মেনে নিতে পারেনি। শাহিদার বাবাও আমাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই দুজন মিলেই দুই পরিবারের সুখ ফিরিয়ে দিতে আজ আমরা স্বামী স্ত্রী থেকে দুজন অপরিচিত মানুষে পরিনত হলাম। একটি ডিভোর্স পেপার নামে কাগজের উপর সই করে।
..
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়। আমার বাবা শাহিদার বাবা চায় আমরা তাদের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করি। বাবার এমন অবস্থা দেখে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। শাহিদাকে শেষ বারের মত বিদায় জানাতে ফোন করলাম।
- আমি বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি? তুমি ভালো থেকো
০- কনগ্রাচুলেশন। আমিও আমার পরিবারের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো।
.
আর কোন কথা বের হলো না আমাদের মুখ থেকে। চুপচাপ ফোন কেটে দিয়ে দু চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। হয়ত শাহিদাও তা করেছে, কিন্তু ফোনের মধ্যে তো মানুষের আবেগ দেখা যায়না। তার ভালোবাসা হারানোর কষ্ট দেখা যায় না।
.
বাবা একটু সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে আসলেই। আমার বিয়ে নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়।
.
আজ পহেলা ফাল্গুন আমার বিয়ে। শাহিদার বিয়ে কবে তা আমি জানিনা। তাকে ফোন দিতে ইচ্ছে করলেও বিবেকের কাছে অপরাধী মনে হলে আর ফোন দিলাম না। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে আমি বাসর ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু আমার মনপ্রান জুড়ে তো সেই শাহিদা নামক মেয়েটিই রয়েছে।
.
বাসর ঘরে ঢুকে একটি মেয়েকে দেখলাম, লম্বা ঘোমটা দেওয়া। যেহেতু বাবার পছন্দে বিয়ে করেছি সেহেতু মেয়েটিকে দেখার প্রয়োজন মনে করিনাই। দুর থেকে দাড়িয়ে তাকে বললাম ‘‘আপনি হয়ত আমার স্ত্রী, আমার উপর আপনার সর্ব অধিকার আছে, কিন্তু আমি এখনো মানসিকভাবে পরিপূর্ণ নই। সপ্তাহ খানেক হলো আমার প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে। যতদিন আমি না নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছি, কিংবা আপনি আমার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন। ততদিন আমরা একই রুমে থাকলেও আমাদের মাঝে কিছুই হবেনা। আমি পাশের রুমে যাচ্ছি ঘুমাতে আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।”
.
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে শুধু হ্যা সুচক ইঙ্গিত দিলো। তার কিছুক্ষন পরেই আমার ঘরের দরজার কড়া নড়ার শব্দ শুনে আমি দরজা খুলে দিলাম। আমার বাবা সামনে দাড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই বাবা বলতে লাগলেন ‘‘তোর সুখের চেয়ে কোনদিন আমি বড় কিছু দেখিনি। তুই আমাকে একবার জানালেও পারতি তোর সুখ কোথায়, কিন্তু তুই আমাকে না জানিয়ে তোর সুখ খুজে নিলি। তুই কি জানিস না, তোর সুখ এনে দিতে পারলেই আমি তোর বাবা সবচাইতে বেশী সুখী। যাইহোক আজ আমি তোর সুখ তোকে এনে দিয়েছি। তোর সুখটা আমি নিজের হাতে এনে দেওয়ার জন্যই এত কিছু। এখানেই আমার সুখ রয়েছে।”
.
আমি বাবার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। যতক্ষনে বুঝে উঠবো তার আগেই শাহিদার বাবা আমার রুমে ঢুকে পড়লেন। আর বলতে লাগলেন ‘‘এবার সংসার করো জামাই রাজা তোমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে। তোমাদের সুখেই যে আমাদের সুখ তোমরা কেন সে কথা বুঝতে চাওনা?”
.
ততক্ষনে আমার বুঝতে বাকি রইলো না। আমার সদ্য বিবাহিত করার স্ত্রী আর কেউ নয় শাহিদা। সুখের জোয়ারে দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলাম। এই পৃথিবীতে প্রতিটি পুরুষ মহা পুরুষ না হলেও, প্রতিটি বাবা স্বর্গ পুরুষ হয়ে আসে সন্তানের জন্য। যারা শুধু সুখ এনে দিতেই জানে নিতে না।”
.
বাবা আমাকে আলতো বেশে জড়িয়ে ধরে কপালে একটি চুমু দিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন। আমি ধীর গতিতে আমার নববধুর কাছে গিয়ে ঘোমটা উঠালাম। তার চোখেও অস্রুর ফোটা জলজল করছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো ‘‘আমরা কেন এমন মহৎ পিতা মাতার মনে কষ্ট দেই। যারা আমাদের জন্ম থেকে শুধু আমাদের সুখের কথা চিন্তা করে বলতো পারো রাশেদ?”
.
আমার ভাষা নেই কিছু বলার, শাহিদাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললাম। আমরা যে ভুল করেছি তা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম না করে। যেই বাবা মা আমাদের সুখ ছাড়া কারো সুখের কথা ভাবেনা। আমরা না জেনেই সেই বাবা মা কে কষ্ট দেই। শাহিদার কপালে একটি চুমু দিয়ে বললাম ‘‘স্বাগতম আমার ভাংগা ঘরের ঘরনী হিসেবে। শাহিদাও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। আমি কিছুক্ষন পর উঠে বাবার রুমে গিয়ে বাবাকে বলতে লাগলাম। ‘‘না বুঝে কষ্ট দেই বলে স্যরি বাবা”
.
বাবা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলতে লাগলো ‘‘যেদিন তুই সব বুঝতে পারবি সেদিন তো তুই বাবা হয়ে যাবি। এখনো তো তুই ছোট তাই আমি তোর বাবা। ”
.
আজ আমার কাছে প্রতিটি দিন ফাগুন বসন্তের দিন। বাবা, মা, স্ত্রী আর শশুর বাড়ির ভালোবাসা নিয়ে সত্যিই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তাইতো মাঝে মধ্যে বলে উঠি ‘‘কোন বসন্ত আসে আর যায় রে? আমার আছে যে বসন্ত তা কভুনা যাবে রে”
।