নবাব-বাদশাদের নয়, মুসলমান সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের জীবন আমাদের বেশির ভাগ গ্রুপ থিয়েটারে আজও উঠে আসেনি। নবাব-বাদশাদের নয়, মুসলমান বেশ কয়েক বছর আগে, সময়টা ঠিক মনে পড়ছে না, পরিচালক মানস ভৌমিক চারটি গল্প নিয়ে একটি টেলিফিল্মের সিরিজ় করেছিলেন দূরদর্শনের জন্য। সিরিজ়টির নাম ছিল ‘ভেদ-বিভেদ’। তার একটিতে আমাকে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন মানস। গল্পটি ছিল অল্পবয়সি এক স্বামী-স্ত্রী জুটিকে নিয়ে, যারা বিয়ের পর থাকার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না এই শহরে। কারণ ছেলেটি মুসলিম এবং মেয়েটি হিন্দু। এ বার নিশ্চয়ই সিরিজ়টির নামকরণের সার্থকতা বোঝা যাচ্ছে। আমার ‘ভট্টাদা’ নামের চরিত্রটি ছিল একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির, খানিকটা চালচুলোহীন টাইপের। ওই সদ্যবিবাহিত দম্পতি একটি ফ্ল্যাটের খোঁজে কলকাতার এ মাথা থেকে ও মাথা চষে ফেলার পর কারও পরামর্শে এই ভট্টাদার শরণাপন্ন হয়েছে। সব শুনেটুনে আমি ওদের কাছ থেকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স হিসেবে নিয়ে বেশ কিছু দিনের জন্য বেপাত্তা হয়ে যাই। ওরা তো ভেবেই নিয়েছে, এ বার বোধহয় আমও গেল ছালাও গেল। হঠাৎ এক দিন আমি যোগাযোগ করলাম ওদের সঙ্গে, একটা ঠিকানা দিয়ে ওদের দুজনকে মালপত্র সঙ্গে নিয়ে চলে আসতে বললাম। দেখা গেল, আমার ছোট বাড়িটার উঠোনে একটা প্রায়-পরিত্যক্ত ঘর সারিয়ে-টারিয়ে নিয়ে ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি— দেরিটা সেই কারণে। আর এ ব্যাপারে আমার প্রধান মদতদাত্রী হলেন আমার মা শোভা সেন। গল্প হলেও এ রকম একটি কাজ করতে পেরে খুব ভাল লেগেছিল।
গল্প হলেও সত্যি। সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয় বা সমস্যা নিয়ে কয়েক কিস্তিতে রিপোর্ট বেরিয়েছিল, যাতে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ ছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর আমাদের নাট্যদল সুধীর চক্রবর্তীর ‘সদর মফস্সল’-এর একটি সত্য কাহিনি নিয়ে একটা ছোট নাটক করেছিল, তাতে হিন্দু বাঙালিবাবুদের সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার চেহারাটা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। এ এক বিচিত্র শহর, ঢাকাতেই হোক, অসমেই হোক বা কলকাতায়— সে রকম লাগসই কোনও ঘটনা ঘটলে কয়েকজন মিলে শহরের কোথাও না কোথাও প্রতিবাদের বুড়ি ছুঁয়ে বুকভরা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে চলে যাই আমরা। মুসলিমদের তোষণ করে চলি ‘অসাম্প্রদায়িক’ লেবেলটা ধরে রাখার জন্য, কিন্তু পোষণ ততটা করি না— অর্থাৎ আদর করে তাদের কাছে টানতে পারি না, মূলস্রোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি না। বেশি কথা কী, নাট্যদলগুলোর দিকে তাকালে কী দেখতে পাই আমরা? ‘বহুরূপী’তে মহম্মদ জাকেরিয়ার কথা জানি, ওঁর অভিনয় দেখেছি ‘রক্তকরবী’ ও ‘সেদিন বঙ্গলক্ষ্মী ব্যাংকে’ নাটকে। পরে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন, সেখানে ওঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছে আমার। কলিম শরাফি ছিলেন, ছিলেন মহম্মদ ইসরাইল। নিজের গড়া ‘অনুশীলন সম্প্রদায়’-এ ছিলেন গণনাট্যশিল্পী মমতাজ আহমেদ, প্রয়াত ১৯৮৩ সালে। মুন্সী আবদুল বারি নামে এক মেক-আপ আর্টিস্টকে আমরা পাই সবিতাব্রত দত্তদের ‘রূপকার’-এ। ‘নান্দীকার’-এ কোনও মুসলিম সদস্য ছিলেন বা আছেন বলে আমার জানা নেই। আমি থাকাকালীন ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এও তাই। ‘সুন্দরম’-এ একজন অভিনেত্রী ছিলেন, বেশ কিছু দিন হল তাঁকে দেখছি না। আমার বর্তমান দলে এক জন মাত্র ছিল, সে-ও মুম্বই চলে গিয়ে বেশ ভালই আছে। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘সংসদ বাংলা নাট্য অভিধান’-এর নামগুলি দেখলে দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে তো এক-একটা দলে অনেক হিন্দু-মুসলিম ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে কাজ করতে দেখেছি। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের নানা প্রান্তে। অথচ শতকরা হিসেবে এই বঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা ওপার বাংলার হিন্দুদের সংখ্যা থেকে অনেকটাই বেশি। আমাদের মফস্সলের চিত্রটা ততটা জানা নেই আমার, খানিকটা ভিন্ন হলে হতেও পারে হয়তো।