মিরাজ দ্রুতপায়ে হাঁটছে। সে ধীরে হাঁটতে পারে
না। ধীরে হাঁটা মানে পিছিয়ে পড়া। সে ঘুমে থাকে
না, তার হিসাব থাকে। তবে তার মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত।
নানারকম অদ্ভুত ভাবনা আসছে, যাচ্ছে! মিরাজ একজন
সচেতন মানুষ। সে চোখ-কান খোলা রাখে। তাই
নানা বিষয় চলে আসে।
এই যেমন সেদিন একজনের মাথার ওপর গাছ
ভেঙে পড়লো। বেচারা বাসা থেকে বের হয়ে
অফিসের দিকে যাচ্ছিলো ধীরে সুস্থে, রয়ে
সয়ে। তখন একটা গম্ভীর, প্রাচীন গাছ এই
ফাজলামিটা করলো। সেদিন বেশ বাতাস ছিলো,
বাতাসের সাথে ছিলো মেঘের স্মরণিকা। তাই
বলে এভাবে ভেঙে পড়তে হবে? একজন
মানবসন্তানের ওপর কেন শতবর্ষী বৃক্ষ পতিত
হবে? প্রাচীন বৃক্ষের এমনতর খামখেয়ালী
আচরণে মিরাজের ভেতরটা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
লোকটার নাম মনে নেই তার। খবরের কাগজে
অদ্ভুত দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারীদের নাম মনে
রাখতে নেই। মিরাজের মাথায় বৃক্ষ এবং মৃত্যু বিষয়ক
এই দুর্যোগের কথা এমনি এমনি আসে নি। সে
নিজেও অফিসে যাচ্ছিলো, এবং ওপরে একটা গাছ
ছিলো। যদিও তেমন বাতাস নেই আজ, তারপরেও
বুকটা একটু হলেও কেঁপে ওঠে বৈকি! তবে মিরাজ
ভীরু নয়। সে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলো
কিছুক্ষণ। অনুযোগ নিয়ে তাকালো ওপরে। “জনাব,
আপনি নিশ্চয়ই আজ আমার কাঁধের ওপর গড়িয়ে পড়ার
কথা ভাবছেন না?” প্রশ্ন ছুড়ে দিলো হিসেব
করে। হিসেবটা পরিসংখ্যানের। সাতদিনের ভেতর
কাছাকাছি এলাকায় দুটি গাছ দুটি মানুষের ওপর ভেঙে
পড়ে জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেবে, এমন হবার
সম্ভাবনা কম, বেশ কম। তাই বুক দুরুদুরু করলেও
নিয়াজ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মানুষ
মরে গেলে হয় ভূত, আর গাছ মরে গেলে হয়
আসবাবপত্র। আহা কী নিষ্ঠুর নিশ্চলতা! মনের
ভেতর দার্শনিক চিন্তারা দানা বাঁধার আগেই সে জায়গা
থেকে চলে যাওয়াটা সমীচীন মনে হয় তার।
দার্শনিক ভাবনাদের মিরাজ প্রশ্রয় দেয়, তবে
সকালবেলায় বরং বস্তুবাদী জীবনের দিকে নজর
দেয়াই ভালো। গাছ পেরিয়ে যেতে হবে বড়
রাস্তায়, উঠতে হবে জনপরিবহনে, যেতে হবে
কর্মস্থলে। তবে বাসে একটা সুবিধাজনক আসন
পেয়ে গেলে এবং লম্বা পা দুটো ছড়িয়ে বসতে
পারলে কিছুক্ষণ দার্শনিক ভাবনায় মগ্ন হওয়া যেতেই
পারে। এই চিন্তাটি তাকে উৎসাহ যোগায়। সে
দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে।
যথারীতি ঠেলেঠুলে ওঠার পর দাঁড়িয়ে থাকতে
হয় গাছের মত। একদম নট নড়চচড়ন। কিছু আগের
গাছ এবং মানুষ বিষয়ক দ্বান্দ্বিক দার্শনিক চিন্তা বড্ড
খেলো মনে হয়। কী বিরক্তিকর এই দাঁড়িয়ে
থাকা! গাছেরা বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকে
কীভাবে? কী একঘেয়ে একটা ব্যাপার! দাঁড়িয়ে
থাকবে আর মাঝে মাঝে ভেঙে পড়ে মানুষের
ঘাড় মটকাবে। এই হলো তাদের কাজ। হ্যাঁ, তারা
অক্সিজেন সরবরাহের মত একটা মহান কাজ করে
থাকে বটে, তবে এ ছাড়া আর তাদের জীবনে
আছে কী? নেই গতি, শুধুই স্থবিরতা। জীবনে
গতি না থাকলে তার কোনোই তাৎপর্য থাকে না।
“আমার চালিকাশক্তি হলো গতি। আমার কাছে জীবন
মানেই ছুটে চলা”। তার ফেসবুক প্রোফাইলে বড়
বড় করে লেখা আছে এই জীবনদর্শন। গত দুই
বছরে তার জীবনটা দূরন্ত গতিতে ছুটে
চলেছে। এইতো সেদিনই তার বস তাকে “হি ইজ
আ ভেরি ডাইনামিক মাল্টিটাস্কিং ইয়ংম্যান” বলে পরিচিত
করে দিয়েছিলো নতুনদের সাথে। সে কথা
মনে হলে এই বাসের চাপাচাপির মধ্যেও তার আনন্দ
হয়। ব্যবসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে চার বছর কিছু পড়ালেখা
করে এবং প্রচুর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন
দিয়ে সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উত্তীর্ণ
হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চাকুরি পেতে
তাকে শয়ে শয়ে সিভি দিতে হয় নি, আর এই
চিত্তাকর্ষক প্রযুক্তির যুগে তো জুতোর সোল
ক্ষয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না! নিজের সম্পর্কে
নানা সুখভাবনায় মজে থেকে সে ভিড়-বাসের
বিড়ম্বনা অনেকাংশেই ভুলে যেতে সক্ষম হলো।
যন্ত্রযান এবং যাত্রীরাও তার ভাবনার সাথে সঙ্গত
করে কিছুক্ষণ পর একটি অপনির্মিত
স্পিডব্রেকারের ওপর দিয়ে যাবার সময় স্থিতিকে
অগ্রাহ্য করে সামনের দিকে ধাক্কিয়ে এগিয়ে
গেলো। প্রবল বিতণ্ডা এবং শাপ-শাপান্তের এক
পর্যায়ে কিছু লোক নেমে গেলে মিরাজ বসার
জায়গা পায়। কিন্তু বসে থাকার আমোদ মিইয়ে
যেতে সময় লাগে না। বিজয় সরণীর বিখ্যাত
সিগনালে বাস আটকে আছে তো আছেই! স্থবির,
বিষণ্ণ, বিস্রস্ত। এই শহরের বৃক্ষ, যানবহন, মানুষ
সবার ওপর চটে লাল হয়ে যায় মিরাজ। এরা কবে
জীবনের মানে শিখবে? আশেপাশের মানুষের
তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। এই ঢিমেতালে
চলা জীবন চলছে চলুক! যেন শামুক হলেও
কোন ক্ষতি নেই, শ্লথ হলেও কিছু এসে যায় না!
অস্থির ভাবনার প্রকাশ ঘটে তার মুখের খিস্তিতে।
পাশে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বসে থাকায়
তার খিস্তিটি অবশ্য মোটামুটি ভদ্রজনোচিতই হয়।
-মেজাজ বেশি গরম? অফিসে যাবার খুব তাড়া?
লোকটি যেচে পড়ে প্রশ্ন করে।
-হ্যাঁ।
মিরাজ তার কণ্ঠে পরিমিত পরিমাণ রূঢ়তা এবং বিরক্তি
প্রকাশ করতে দিলো।
-আমার জীবনদর্শন অবশ্য এরকম ছিলো না। আমি
কোনোকিছুর জন্যেই তাড়াহুড়া করতাম না। আমাদের
হলিবুকে দেখবে লেখা আছে “হে মানবজাতি
তোমাদের…”
-জ্বী আংকেল আমি জানি হলি বুকে কী বলা
আছে। “তোমাদের বড় তাড়াহুড়া”। এইটা অবশ্য আমি
হলি বুক পড়ে শিখি নাই। হুমায়ূন আহমেদ পইড়া জানছি।
জ্বী, আমার বড় তাড়াহুড়া, জীবন মানেই তো গতি,
গতি ছাড়া জীবনের কোনো স্বাদ আছে? যাই
হোক আপনার সাথে এইসব নিয়া আলোচনা করতে
চাই না।
বৃদ্ধ হাসলেন। বেশ সমঝদারের হাসি। দমে না গিয়ে
আবারও বক্তৃতা শুরু করলেন। বোঝা গেলো তার
আসলেই তেমন তাড়াহুড়ো নেই।
-আরে গতি মানে কী কেবলই ছুটে চলা? কোন
এক বিখ্যাত ব্যক্তি যেন একবার বলেছিলো, নাম
মনে নেই, বয়স হয়েছে তো, তুমি দৌড়ুতে না
পারলে হাঁটো, হাঁটতে না পারলে হামাগুড়ি দাও, হামাগুড়ি
দিতে না পারলে ছেচড়ে চলো, তবুও থেমে
থেকো না। এটা হচ্ছে গতি বুঝলে? গতি মানে
থেমে না থাকা, গতি মানে শুধুই ছুটে চলা না।
বৃদ্ধের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য মনে মনে আউড়ে
নিলো কয়েকবার মিরাজ। কথাটা খারাপ না,
পরবর্তীতে অনুজ সহকর্মীদের
মোটিভেশনাল স্পিচ দেবার প্রয়োজন হলে
ঝেড়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই
বক্তব্যকে সমর্থন করার কোনোরকম
প্রণোদনাই তার মধ্যে কাজ করছে না। আর
সবচেয়ে বড় কথা, অন্যদের কাছে যেমনই
হোক, তার কাছে জীবন মানে ছুটে চলাই। যখন
বৃদ্ধ হবে, কাজ করবার সামর্থ্য থাকবে না, তখন এসব
বড় বড় বোলচাল সে আরো ভালোভাবে দিতে
পারবে। তাই কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে সুন্দর সুন্দর শব্দ
সাজিয়ে সে বৃদ্ধের বক্তব্যকে চাছাছোলা
ভঙ্গিমায় প্রত্যাহার করে দিলো।
-দেখেন, আংকেল, আপনার সাথে এইসব নিয়ে
তর্ক করার ইচ্ছা আমার নাই। আপনি এই সিগনালে
সারাজীবন বসে থাকেন আর সবাইকে নীতিকথা
শুনায়ে যান, আমি এখন একটা ভাড়ার বাইক নিয়ে
অফিসে চলে যাবো। খোদা হাফেজ।
বাস থেকে নেমে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে
হাঁটতে কিছু বাটন টিপে একজন বাইকঅলাকে পেয়ে
গেলো। তাকে খুঁজে নিতেও বেশি সময়
লাগলো না। চালক বেশ চালাকচতুর। অলিগলি ভালো
চেনে। অবিরাম তাগাদার মুখে নানা কায়দা কসরৎ করে
সে যখন তাকে অফিসের সামনে নামিয়ে দিলো
তখন ঠিক আটটা উনষাট বাজে। কার্ড পাঞ্চ করে
নিজের ডেস্কের সামনে এসে যখন বসলো,
তখন নয়টা বাজে। চমৎকার! নিজেকে বাহবা দিলো
সে। ঐ বোকা বুড়োর সাথে দার্শনিক আলাপে
মত্ত হলে এতক্ষণে সে সেই অভিশপ্ত সিগনালটি
পার হতে পারতো কি না সন্দেহ।
যাক, যথাসময়ে এসে পড়েছে যখন, এক কাপ সবুজ
চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে সারাদিনের কর্মপরিকল্পনা শুরু
করা যেতে পারে বেশ আয়েশে।
-এই সোহেল, এক কাপ চা দিয়ে যাও। শুধু গরম
পানিতে টি ব্যাগ মিশায়া দিবা। গ্রিন টি। জলদি!
(২)
সকাল ৯-০৫
-মিরাজ, গতমাসের গ্রোথ হ্যাক রিপোর্টটা দাও।
স্যার দেখতে চাইছেন।
মিরাজ প্রথমে একটু ভড়কে গেলেও সামলিয়ে
নিয়ে বুঝতে পারলো যে তার রসিক সহকর্মী
কৌতুক করছে। এই লোকটা এমন নির্বিকার মুখে
প্র্যাকটিকাল জোক করে যে বোঝা মুশকিল! হাহা!
সকাল নয়টা পাঁচে স্যার এসে পড়েছেন, আবার এত
বড় রিপোর্টও দেখতে চাইছেন! এটা দেয়ার কথা
এই সপ্তাহের শেষে। ঠিক আছে, রসের কৌশল
সেও তো জানে। চালিয়ে নেয়া যাক!
-এখনই মেইল করে দিচ্ছি জনাব। এটা তো দু
আঙ্গুলের খেলা!
সাথে সাথেই স্যারের ফোন এলো।
-মেইলটা পেয়েছি মিরাজ। ভেরি গুড জব।
ওয়েলডান! তুমি দেখছি ডাইনামিক থেকে সুপার
ডাইনামিক হয়ে যাচ্ছো দিনদিন। ব্রাভো!
-জ্বী স্যার, ধন্যবাদ। এ আর এমন কী!
ফোনটা রেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো মিরাজ।
আসলেই স্যার ফোন করেছিলেন, এবং সে
কথোপকথনটি চালিয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবে। কী
মানে এসবের!
ফোনটা রেখে মিরাজ দ্রুতহাতে মেইলের
সেন্ট আইটেমে গেলো। দেখতে পেলো
সে ঠিকই একটি বেশ বড়সড় ফাইল স্যারকে
পাঠিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ফাইলটা নামিয়ে
দেখতে শুরু করলো। বেশ ডিটেইলস আর নিখুঁত
কাজ।
স্যার এমনি এমনি প্রশংসা করেন নি। স্যার এমনি এমনি
প্রশংসা করেন না! ঘটনার হতভম্বতা কাটিয়ে সে
সামলে নিলো দ্রুতই। মাল্টিটাস্কিং ডাইনামিক একজন
তরুণের তো এই গতিতেই চল্রা কথা! ঠিক আছে,
ঠিক আছে। মিরাজ এখন মোটিভেশনের চূড়ান্ত
শিখরে। মিরাজের শরীরের রক্ত তীরবেগে
ছুটছে। তাকে আরো গতিশীল হতে হবে।
আরো!
সকাল ৯-১০
মিরাজের হাতে একটা খাম। খামের ভেতর বিশেষ
কিছু আছে। খামটা খুললেই মিরাজ জানতে পারবে
তার কত টাকা ইনক্রিমেন্ট হয়েছে, এবং তার
প্রমোশন হয়েছে কি না। মিরাজের ঘেমে
টেমে কেঁপে দ্রুত খুলে ফেললো খামটি।
সকাল ৯-৩০
মিরাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করে ফেলবে।
উদ্দাম গতিতে ছোটা তো অনেক হলো। একটু
থিতু হওয়া দরকার। এই বিশ মিনিটে সে দুটো
প্রমোশন বাগিয়েছে, আয় রোজগারও মন্দ না।
এখন বিয়ে না করলে কখন! সকাল নয়টা একত্রিশ
মিনিটে সে তার পরিবার পরিজন সহ মেয়ে দেখতে
গেল জিগাতলার একটি বাড়িতে। নয়টা পয়ত্রিশ মিনিটে
সোবহানবাগের একটি কমিউনিটি সেন্টারে শুভ বিবাহ
সম্পন্ন হলো। বিয়ের অনুষ্ঠানের
উল্লেখযোগ্য দিক হলো মেনুতে ভেড়ার মাংস
রাখা।
সকাল ১০টা
-এই শোনো, আজ তুমি একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে,
কেমন?
আহ্লাদী গলায় আবদার করলো মিরাজের স্ত্রী
মিরা।
-কেন, কী হয়েছে?
-আসোই না, এলেই বলবো।
মিরাজের মাথা বেশ দ্রুত কাজ করে। সে বুঝে
ফেললো পনের সেকেন্ড আগে তার
স্ত্রীর বমি করার রহস্য। আর মাত্র পাঁচ সেকেন্ড
পর বাসায় পৌঁছেই সে জানতে পারবে বাবা হতে
যাওয়ার সুসংবাদ।
সকাল ১০-৩০
পরবর্তী আধাঘন্টায় মিরাজের জীবনে বেশ
বদল এলো। ওয়ার্কএ্যাহোলিক স্বভাবটা অনেকখানি
বদলে ফেলেছে সে। বুঝতে শিখেছে
জীবনে ক্যারিয়ার, প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট,
চোখা চোখা কথাবার্তা আর ভাঁজ না ভাঙা
স্যুটকোটের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে।
সকাল দশটা চল্লিশ মিনিটে সে পিতৃত্বের স্বাদ
পেলো। এ উপলক্ষ্যে সাতশত টাকা কেজি দরের
মিষ্টি কেনা হলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভেড়ার মাংস
দেবার পর সাতশত টাকা কেজি দামের মিষ্টি সবার হৃদয়
এবং পাকস্থলীতে তীব্র অনুভূতি যোগালো।
বেলা ১২-০০
পরবর্তী দেড় ঘন্টা তার জীবনের স্বর্ণালী
সময়। তার ভেতরকার ছটফটানি কমে এসেছে
অনেকটাই। শরীর ভারি হয়েছে, ভারি হয়েছে
পকেটও। ভালোবাসার পানপাত্র উছলে পড়ছে।
নিয়ম করে সময় বের করে নেয় সন্তানের দিকে
তাকিয়ে থাকার জন্যে। স্ত্রীকে আগের
চেয়ে বেশি চুম্বন করে। অফিসের পাওনা
ছুটিগুলো কড়ায় গণ্ডায় উশুল করে নিচ্ছে। ঘুরে
আসছে পাথর, পাহাড়, সমুদ্র, বন।
তবে সুসময় কখনই চিরস্থায়ী হয় না। পার্বত্য এলাকা
থেকে ঘুরে আসার পর প্রচণ্ড জ্বরে বেহুঁশ
হতে লাগলো সে বারবার। প্রায় পাঁচ মিনিট অসুস্থ
থাকলো। ডাক্তার, কবিরাজ, যাদুকর, সবার চেষ্টা
বিফলে গেলো। অবশেষে দেশের বাহির
থেকে চিকিৎসা করে এসে আরো কিছুদিন
বিশ্রামে থেকে আবার যখন কাজে যোগদান
করলো, তখন বেলা একটা বেজে গেছে। এই
দীর্ঘ বিরতিতে স্বাস্থ্যক্ষয় হয়েছে, কমেছে
উদ্যম আর উৎসাহ। তবে তার স্ত্রী, সহকর্মী
আর ঊর্ধ্বতনদের আন্তরিক সহযোগিতায় বেলা
একটা পনেরোর মধ্যে আবার কাজের গতি ফিরে
পেলো।
কিন্তু আগের মত পেলো কি?
দুপুর ১-৩০
বস তাকে জানিয়ে দিলো যে এই গতিতে কাজ
করতে থাকলে কোম্পানির হয়তো বিকল্প কারো
কথা চিন্তা করতে হবে।
আকাশের ঠিক মাঝখানে তখন একটা মস্ত সূর্য
চোখ বড়বড় করে দেখছিলো এসব। রাস্তার
মধ্যিখানে তখন পিচ গলে গলে পড়ছে।
আশেপাশে কোথাও একটা গাছও নেই যে একটু
জিরিয়ে নেবে। ঘাম ঝরতে থাকে অশ্রূর মত।
প্রচুর ঘাম, কান্না এবং রক্ত ঝরার পর আবার ঘুরে দাঁড়ায়
সে দুপুর দুটোয়। আবারও আগের মত অমানুষিক
পরিশ্রম করে, ছোটে, দৌড়োয়, বিক্রিবাট্টা করে,
নতুন নতুন আইডিয়া দেয়। আবারও প্রমোশন পায়,
ইনক্রিমেন্ট হয় বড় অংকের। তবে ছোটাছুটিটা আর
আগের মত উপভোগ করতে পারে না। দম ফুরিয়ে
আসে। কিন্তু ততদিনে পায়ে চাকা লাগিয়ে ঢাল ধরে
নামতে দেয়া হয়েছে তাকে।
দুপুর ২-৩০
মিরাজের সাথে একজন কমবয়সী মেয়ে। তারা
একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে স্যুপ এবং অন্থুন
খাচ্ছে।
দুপুর ২-৩৫
মিরাজের হাতে একটা কাগজ। তাকে সই করতে
হবে সেখানে। অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু
তার হাত কাঁপে না মোটেও। সাচ্ছন্দ্যে
ডিভোর্সের কাগজ সই করে দেয়।
দুপুর ৩-০০
মিরাজ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তার চোখ
বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রূ ঝরার কথা। কিন্তু সে
কাঁদতে পারছে না। বুকের ভেতর জমে আছে
আদিযুগের পাথর। মিরাজের ষোল বছর বয়সী
ছেলেটি রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা গেছে।
দুপুর ৩-১৫
মিরাজের জমে যাওয়া রক্ত আবারও ছলকানো শুরু
করে। সেই আগের ভঙ্গিমাতেই তাকে তার
দ্বিতীয় স্ত্রী জানায় যে সে বাবা হতে
চলেছে। নাতিশীতোষ্ণ দেশের এই এক সুবিধা।
মেয়েরা বেশ উর্বর হয়।
দুপুর ৩-৩০
সাড়ে তিনটার সময় সে দ্বিতীয়বার বাবা হবার সৌভাগ্য
অর্জন করে। ঠিক এক মিনিট পরেই তার চাকুরিটা চলে
যায়।
দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের তেজ কমছে।
আলো নিভে যাবে শিঘ্রই।
বেলা ৪টার পর দপ করে সূর্যটা নিভে গেলো।
বাতাস বইতে লাগল বেগে। ভেঙে পড়তে
লাগলো বৃক্ষরাজি। এত বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা
স্বত্ত্বেও একের পর এক কোম্পানি তাকে
প্রত্যাখ্যান করতে লাগলো। আর যারা তাকে
আগমনের আহবান জানালো, তাদের প্রস্তাব
রীতিমত অসম্মানজনক। এই প্রতিকূল পরিবেশে,
ভীষণ ঝড়-জলের মধ্যেও চারটা দশ পর্যন্ত টানা
হেঁটে, দৌড়িয়েও কোনভাবেই কূলকিনারা করতে
পারলো না সে। রাস্তার মধ্যেই তার ডায়াবেটিস ধরা
পড়লো। তাকে বারবার প্রস্রাব করার জন্যে থামতে
হলো। তার সন্তান তারস্বরে চেচাতে লাগলো,
আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ফোনে কে বা কারা যেন
ব্যালেন্স ভরে দিতে লাগলো।
তবে দুঃসময়ও একসময় ফিকে হয়। সাড়ে চারটার সময়
মিরাজ জমানো টাকা দিয়ে সাহস করে অবশেষে
একটা হোটেল খুলেই বসে। মিনিট পাঁচেকের
মধ্যেই হোটেলের ভেড়ার মাংসের সুনাম
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ আসতে
থাকে তার দোকানে। তারা প্রচুর মাংস চায়। ভেড়ার
মাংস। ভেড়াশুমারিতে দেখা গেছে দেশে ভেড়ার
সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ভেড়ার সংখ্যা বাড়লেও মিরাজের
দেখাদেখি আরো অনেকেই এই ব্যবসায়
নেমে পড়ার ফলে চাহিদা আর যোগানের অসম
সমীকরণ তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। মিরাজ
ভেবেছিলো এবার একটু স্থিত হতে পারবে।
কিন্তু তা আর হচ্ছে কই!
(৩)
বেলা পাঁচটার সময় তার দোকানে এসে উপস্থিত হয়
এক সৌম্যদর্শন বুড়ো।
কিছুক্ষণ আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভেড়ার মাংস যোগান
দিতে না পারার কারণে তার দোকানে গোলমাল
করে গেছে একদল কলেজ ছাত্র। তাদেরকে
প্রায় দুই সেকেন্ড ধরে অনুনয় করেছে মিরাজ,
একটু ধৈর্য্য ধরতে, এত তাড়াহুড়ো না করতে। কিন্তু
কে শোনে কার কথা! ভেড়ার মাংসের অভাবে তারা
প্রোটিনহীনতায় মারা গেলে মিরাজের বিরুদ্ধে
মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ মামলা করে খুব জিতে
নেবে এই আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার দ্রুত বের
হয়ে গেলো।
এই মুহূর্তে হোটেলে সেই সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ ছাড়া
আর কেউ নেই। তাকে এই ঝঞ্ঝাটগুলো খুলে
বলে মনকে ভারমুক্ত করতে তার খুব ইচ্ছে হয়।
কিন্তু সে কি শুনবে? কতই বা সময় লাগবে! দুই
সেকেন্ড? এতটুকু সময় দিবে না সে?
বৃদ্ধের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে মিরাজ।
ইনাকে আগে কোথায় যেন দেখেছিলো? এত
চেনা চেনা লাগছে কেন?
-আমার অনেক সময় আছে। আপনি বলতে পারেন
আপনার দৌড়, হাঁটা, হামাগুড়ি দেয়া অথবা ছেচড়ে চলার
কথা। আমার অত তাড়া নেই।
-সেটাই ভালো!
আশ্বস্ত হয় মিরাজ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে
সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরছে ধীরে। টিক টিক টিক।
মিরাজ মনে করতে চেষ্টা করে মুখটাকে
কোথায় দেখেছিলো। সময় নিয়ে মনে করা যাক।
কারোই যখন তেমন কোনো তাড়া নেই!
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!