News from Nadia
HOME
TOP STORIES
SIDE STORIES
USEFUL INFORMATION
ARTICLES
প্রবন্ধ
CONTACT US
SEARCH FOR:
SEARCH …
চিকিৎসা কেন্দ্র নাকি মৃত্যুপুরী? – কোভিড আক্রান্ত একজন মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা
POSTED BY: NFN NETWORK
– খগেন্দ্র কুমার দত্ত
আমি নগেন্দ্রনগর, কৃষ্ণনগর, নদিয়ার একজন বাসিন্দা। বয়স ৭১ বছর। ১২ মে ২০২১ মে নিশ্চিত ভাবে জানতে পারি যে আমি করোনা আক্রান্ত। একদিন বাড়িতে থাকি। অক্সিজেনের জোগান অনিশ্চিত জেনে ১৩ মে সন্ধ্যায় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি হতে যাই । সেখানে রিপোর্ট দেখানো সত্বেও, দায়িত্ব ভার প্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভর্তি করতে নারাজ হয় । আমার ছেলে আমাকে ঐ অবস্থায় আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য মন স্থির করে ফেলে । অথচ, সেটা অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ একটা ব্যাপার ছিল । আমি মরিয়া হয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুস্মিত হালদারকে ফোন করি। আমার আধার কার্ডের নকল এবং এপোলো থেকে পাওয়া রিপোর্টের নকল পাঠাই – ওরই পরামর্শ অনুসারে । কয়েক মিনিট পরে ও জানায় যে এ. ডি. এম. সাহেব হাসপাতালে নির্দেশ পাঠিয়েছেন যাতে আমাকে ভর্তি করে নেওয়া হয়।
এবার আমাকে ভর্তি করা হয়। আমার ছেলে গামছা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে বাড়ি চলে যায়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর পায়খানার বেগ অনুভব করি। শৌচালয়ে গিয়ে দেখি নরককুণ্ড। যত্রতত্র পায়খানা। বেসিন ইত্যাদি নোংরায় ভর্তি। আমি মোবাইলে ছবি তুলে পরিচিত সাংবাদিক ও বন্ধুদের জানাই আমার অসহায় অবস্থার কথা। অন্যত্র সরে যাবার ব্যবস্থা না থাকায় অবস্থাটা মেনে নেবার পরামর্শ দেন অনেকে। ফলে, সেই নরকেই থাকতে হয়। পরবর্তী কালে আমার এক ব্যাঙ্কের বন্ধুর সহযোগিতায় সাফাই কর্মীরা কিছুটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করলেও, কিছুক্ষণ পর পরই একই রূপ ধারণ করে ঐ শৌচালয়। অন্য উপায় না থাকায় ১৩ থেকে ১৮ মে ওখানেই থেকে যাই। এখানে অন্য অসুবিধা কিছু কিছু থাকলেও, অক্সিজেনের অভাব না থাকায় একটা সাহস পাচ্ছিলাম। কাশির প্রাবল্য বাড়ায় ডাক্তার ও নার্সদের বলছিলাম। মাঝে মাঝে অসুধ পাচ্ছিলাম। ডাক্তার বাবুর নির্দেশ অনুসারে ছেলের কিনে দেওয়া কয়েকটি ওষুধও খাচ্ছিলাম। রাতের দিকে কাশির কষ্ট বাড়ছিল। বেশ অসহায় বোধ করছিলাম। শৌচালয় ব্যবহার করাটা একটা বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিচ্ছিল। একটু পরিচ্ছন্ন জায়গা খুঁজছিলাম।
আমার খুব কাছের মানুষ এক সমর পরামানিক তার পরিচিত হাসপাতালের এক ডাক্তার বাবুর সাথে যোগাযোগ রেখে আমার খোঁজ খবর নিত। পরে সেই যোগসূত্রটা কেন যেন নষ্ট হয়ে গেল। আমি অত্যন্ত অবহেলিত হচ্ছি বলে মনে হল। আমি সমরের কাছে জেনেছিলাম যে ওর সাথে হীরামনি মেমোরিয়াল হাসপাতালের (নার্সিং হোম) কর্মকর্তা ও ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা আছে জানতে পারি। ১৮ মে ২০২১ সমর আশ্বাস দেয় যে ওখানকার পরিষেবা ভাল। আমি আমার ছেলেকে বলি আমাকে শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হীরামনিতে ভর্তি করার ব্যবস্থা করতে।
১৮ তারিখ রাতে আমি নারসিং হোমে ভর্তি হই। সেখানে অবশ্য সমরকে দেখতে পাইনা। আমার একটা বুকের এক্স রে করা হয় । একটা বেড দেওয়া হয় সম্ভবত পাঁচ তলায়। সেখানে আরো দুটি বেডে দুজন কোভিড রোগী আগেই ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের বেডের সাথে অক্সিজেনের সরাসরি সংযোগ থাকলেও আমার জন্য ছিল আলাদা সিলিন্ডার থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা । প্রথম রাতে আমি অক্সিজেন পাই। ঐ রাতেই অন্য একজন অল্প বয়সী (৩৫-৪০) এক যুবক খুব অস্থির অবস্থায় ছিল। ডাক্তার বা নার্সদের তার প্রতি তেমন কোনো উদ্বেগ ছিল না। রাত ১২ টা নাগাদ যুবকটি সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় উপুর হয়ে বিছানায় দাপাদাপি করতে থাকে। নার্স বা ডাক্তার কেউ আসেন না। ঐ অবস্থাতেই সে মারা যায়। একথা শোনার কান এই নারসিং হোমে কর্মরত কারুর নেই। পরদিন সকাল ৮ টার পরে নার্স আসলে তাকে আমরা দুজন রোগী বলি ঐ শব সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু নানান অছিলায় শবটি কোনো মতে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ১৯ তারিখ সন্ধ্যার সময় মৃতদেহটি অপসারণ করে অন্য এক রোগীকে সেখানে ভর্তি করা হয়। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে মৃত মানুষকে পাশে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য যে কী বিপুল মানসিক চাপ ভোগ করতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে আমার দুটি ফোন জবরদস্তি আমার কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে নারসিং হোমের পক্ষ থেকে।
আমার সঙ্গে আমার পরিবার বা সমর বিচ্ছিন্ন ছিল। ওদের অনুগ্রহে কদাচিৎ যোগাযোগ হচ্ছিল সমরের সাথে। কিন্তু, আমি আমার অসুবিধার কথা জানালেই ওদের ফোন কেটে দিয়ে আমাকে ভর্তসনা করা হচ্ছিল। আমার প্রতি বিদ্বেষমূলক ব্যবহার শুরু হল। ডেকে ডেকে গলা ভেঙ্গে যায় কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ আসতে নারাজ। ১৯ তারিখ প্রথম রাতে আমার জন্য নির্ধারিত সিলিন্ডারে অক্সিজেন থাকলেও, মাঝ রাত থেকে সরবরাহ বন্ধ ছিল পরদিন বেলা প্রায় ৮ টা পর্যন্ত। আমার কাছে ফোন না থাকায় আমি কিছুই জানাতে পারিনি এবং অক্সিজেনের অভাবে আমি মারাও যেতে পারতাম।অথচ, একটা বে-আইনি রাস্তা মারফৎ রোগীদের কথা বলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। বিশেষ উপরির বিনিময়ে নার্স, আয়া , সাফাই কর্মীরা কথা বলানোর ব্যবস্থা রাখেন – ওপেন সিক্রেট । এই অবীধ ব্যবসা কবে শেষ হবে?
হীরামনির পরিষেবা কেমন ?
পরিস্কার পরিচ্ছনতা – বাথরুম, পায়খানায় কোথাও বেসিন আছে, কোথাও নেই। সাবানের জায়গায় কাপড়কাচা সাবানের গুড়ো ।সামান্য খাবার
জল চাইলে ১/২ থেকে ১ ঘন্টা লাগবে, খাবার দিতে অনেক দেরী । খাবারের মান এবং পরিমান খুব নীচু। সকালে ব্লাড সুগার টেস্ট চলছে। অথচ, খুব মিষ্টি বিস্কুট আর সাথে কড়া মিস্টি দেওয়া ছোট কাপে লিকার চা খেতে হবে। সকালের খাবার – ২ টি হাতে গড়া রুটি (চামরার মত), ঘুগনি জাতীয় কিছু, ডিম থাকতে পারে একটা। খাবার চেয়ে চেয়ে হয়রান হয়ে যেতে হয়। দুপুরের খাবার আসতে আসতে বেলা ৩টা । তখন থাকবে ডাল, আলুর সাথে ভেন্ডির তরকারি, ডিম একটা। ডিমের পরিবর্তে ৫০গ্রাম মাছের ঝোল। রাতে ভাত বা রুটি, সঙ্গে ডাল, তরকারি এবং একটা ডিম । {উল্লেখ রাখা যেতে পারে যে সরকারি হাসপাতালে খাবারের পরিমান এদের তুলনায় অনেক বেশী}
জলের ভাপ দেওয়ার ব্যবস্থা খুব বাজে । প্লাস্টিকের পাত্রের মধ্যে হিটার দিয়ে গরম কড়া হচ্ছে জল – যা যেমন দ্রুত গরম হয় তেমনই দ্রুত ঠাণ্ডা হয়।অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন লেভেল মাপার ব্যাপারটা নার্স বা আয়াদের করুণার ব্যাপার।পরিষেবা দেবার জন্য যারা আছেন তারা সর্বদাই ব্যস্তবাগিস। সর্বদাই ব্যস্ত। আর নাটুকে। এরা সাবধান করবে যাতে কেউ বিছানা থেকে না নামেন। ওদিকে বিছানার পাশে মুখ ধোওয়া , খাবারের উচ্ছিস্ট ফেলার জায়গা ঠিকমতো দেওয়ার ব্যাপারে অনীহা। দিনের মধ্যে একবার গা মুছিয়ে দেবার ব্যাপারটাও অনুগ্রহের ব্যাপার। ইচ্ছে হলে দিতে পারে আবার নইলে নয়। প্রস্রাব করার জন্য যে ইউরিন পট দেওয়া হয় তা ব্যবহার করলে নিশ্চিত ভাবে যৌন রোগ বহন করতে হবে – এতো নোংরা ! ঐ পট ব্যবহার করতে না চাইলে বলছে – জবরদস্তি ক্যাথিটার লাগিয়ে দেবে। এ কেমন অরাজকতা?! বাড়ি থেকে খাবার এলে সেই পাত্র ধুতে এদের অনীহা। উচ্ছিস্ট খাবারের ডাই করিডরে আস্তাকুরের আকার নিয়েছে।
আমার নামে কী কী অসুধ আছে জানতে ৮টা থেকে ১০টা বাজবে। যারা ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন তাদের আই ভি চ্যানেল করার অভিজ্ঞতা নেই। চ্যানেল বন্ধ – তারই মধ্যে জোর করে অসুধ ভরে দেওয়া হচ্ছে যা বাইরে ছিটকে পড়ছে। যন্ত্রণায় কাতরাতে হচ্ছে। বিভিন্ন ব্লাড টেস্ট করার জন্য যারা রক্ত সংগ্রহ করছে মনে হয় তারা পশু চিকিৎসা করার যোগ্যতাও অর্জন করেনি। আদিম যুগের চিকিৎসা চলছে প্রশিক্ষণ হীন কিছু মানুষকে দিয়ে। সব যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে নীরবে। কাউকে খবর দেওয়া যাবে না। এমনই নিষ্ঠুর এমনই বর্বর এরা। রোগীর ব্যাগ ঘেঁটে দেখা হয় টার কাছে কী অসুধ আছে ! নারসিং হোমের অসুধ না দিয়ে বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুসারে অসুধ না দিয়ে এভাবে অসুধ খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেবার রেওয়াজও এখানে বিদ্যমান !
সবথেকে খারাপ বিষয় হল এই যে এরা কীভাবে কত টাকার বিল করবে তা ওদের ব্যাপার। সে টাকা দেওয়া থেকে নিষ্কৃতি নেই – পরিষেবা যেমনই হোক । আমি একজন ভুক্তভোগী হিসাবে সকলকে সাবধান করার পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য দপ্তর ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি – নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে, জনস্বার্থে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করার জন্য ।