বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চাইলে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেন চালু করতে পারে

in cryptocurrency •  6 years ago 

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল কারেন্সি বা ভার্চুয়াল কারেন্সি সাড়া বিশ্বে একটি ঝড় তুলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর এই ক্রিপ্টোকারেন্সি হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত আবিষ্কার। বিশেষ করে বিটকয়েন তৈরির পর ক্রিপ্টোকারেন্সির চাহিদা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি দুঃস্বপ্নের বিষয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের লেনদেন ক্রিপ্টোর মাধ্যমে করতে রাজি নয়। পৃথিবীর অনেক দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, যেমন- আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টো ব্যবহার করা পুরোপুরি বেআইনি। এর পেছনের কারণটি খুবই স্পষ্ট।

crypto-exchange.jpg

ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনে কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পরে না। অর্থাৎ যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেন করা হয়, ব্যাংক নামক প্রতিষ্ঠানের তাহলে এখানে কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এই লেনদেন সরাসরি গ্রাহক-প্রেরকের মধ্যেই হয়ে থাকে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে এই লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত ব্যাংকগুলো নিজেদের লাভ করে থাকে গ্রাহকদের লেনদেন এবং অন্যান্য সেবাদানের মাধ্যমে। অর্থাৎ, গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে আর্থিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য যে সেবা লাভ করবে সেই সেবা দানের একটি মূল্য নির্ধারণ করে ব্যাংক। সেখান থেকে যে অর্থ আসে তা থেকে ব্যাংকগুলো নিজেরা লাভ করে থাকে।

cryptocurrency-1 (1).jpg

এই সেবা আর্থিক লেনদেন হতে পারে, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি হতে পারে, সঞ্চয়পত্র হতে পারে, ট্যাক্স বা কর সংক্রান্ত বিষয়ও হতে পারে। মূলত আর্থিক লেনদেন থেকেই ব্যাংক সিংহভাগ আয় করে থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সি যদি চালু হয়ে যায়, তাহলে ব্যাংকের প্রয়োজন পড়বে না। তখন কিন্তু ব্যাংক নামক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়তে পারে। এছাড়া যেকোনো লেনদেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নজর থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নজরদারির ফলে কালো টাকা, বেআইনি লেনদেন ইত্যাদি অনেকাংশেই কম হয়ে থাকে। এসব কারণেই মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

cryptocurrency-1 (7).jpg

তবে একদমই যে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা যাবে না এমন কিন্তু নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সিতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেই প্রযুক্তি কিন্তু ব্যাংকগুলো নিজেদের লেনদেন নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। ব্লকচেইন নামক প্রযুক্তি খুব সহজেই ব্যাংকিং খাতের লেনদেনকে আরও দক্ষ করে তুলবে। এছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে অনলাইন হ্যাকিংয়ের ভয় কম। ক্রিপ্টোর মাধ্যমে লেনদেনে যে বিকেন্দ্রীকরণের (Decentralise) কথা বলা হয়, সেটা মেনে না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। উন্নত দেশ কিন্তু এভাবেই ক্রিপ্টো ব্যবহার করছে।

cryptocurrency-1 (1).png

আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং জনগণের মাঝে বিটকয়েনের অধিক জনপ্রিয়তা লাভের কারণে থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'ব্যাংক অব থাইল্যান্ড' ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ২০১৯ এর প্রথম চার মাসের মধ্যেই তাদের দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু করছে এবং সেটার পুরোপুরি দায়িত্বে থাকবে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের নতুন এই ভার্চুয়াল কারেন্সির অফিসিয়াল নাম হবে, সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সি.বি.ডি.সি)। প্রথমে তারা আরও আটটি কমার্শিয়াল ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে এই যাত্রা শুরু করবে।

cryptocurrency-1 (2).jpg

এখানে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা। এই যাচাই করা হবে থাইল্যান্ডের ভেতরেই অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে। অনেকটা প্রোটোটাইপ ধাঁচের কাজ হবে এটি। ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেন করলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা নিরীক্ষণ করা হবে এবং সাথে সাথে কোন কোন দিকে উপকার পাওয়া যাচ্ছে সেটাও দেখা হবে, যাতে করে পরবর্তীতে গ্রাহকদের জন্য ক্রিপ্টো মারফত বিভিন্ন সুবিধার বন্দোবস্ত করা যায়।

cryptocurrency-1 (5).jpg

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আরও যে ব্যাংকগুলো থাকছে সেগুলো হচ্ছে ব্যাংকক ব্যাংক, ক্রুংথাই ব্যাংক, ব্যাংক অব আয়ুদ্ধ, কাশি করঙ্ক ব্যাংক, সিয়াম কমার্শিয়াল ব্যাংক, থানাচার্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থাই এবং এইচএসবিসি। এই পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্লকচেইন তৈরি প্রতিষ্ঠান আর-৩ (R3) কে পুরো সিস্টেম তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের মূল কাজ হবে এমন একটি ব্লকচেইন নির্ভর প্রক্রিয়া তৈরি করা, যাতে পুরো লেনদেনের প্রক্রিয়াটি কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অর্থাৎ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি সিস্টেমের মতো বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা এখানে থাকবে না, যেমনটি ইথেরিয়াম করে থাকে।

cryptocurrency-1 (6).jpg

ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি খুব দক্ষ একটি সিস্টেম তৈরি করেছে যেটা দিয়ে খুব সহজেই ডিজিটাল খতিয়ান বই বা লেজার যেকোনো অবস্থায় বণ্টন করে দেয়া যায়। এর ফলে সবসময়ের জন্য ক্রিপ্টো দিয়ে লেনদেনের উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। আর-৩ এর বানানো এই লেজারের নাম হচ্ছে কর্ডা। থাই ব্যাংকগুলোতে এই কর্ডাই ব্যবহার করা হবে।

cryptocurrency-1 (8).jpg

এখন কথা হচ্ছে- কেন থাইল্যান্ড ক্রিপ্টো ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল? উত্তর হচ্ছে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে। একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার প্রযুক্তির যে পরিমাণ উন্নতি সাধন হয়েছে তাতে পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের জন্য মানুষ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছে। কারণ প্রযুক্তির ফলে এই ধরনের লেনদেনে সময়ের অপচয় হয় খুব কম। যেহেতু মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির প্রভাব অনেক বেশি এবং পশ্চিমা বিশ্ব ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো নতুন এই প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করছে, তাই থাইল্যান্ড কেন পিছিয়ে থাকবে? আর যেহেতু এটা প্রমাণিত যে, ক্রিপ্টো ব্যবহার করলে অনেক দিক থেকেই সুবিধা পাওয়া যায় এবং মানুষ এটা ব্যবহার করার জন্য সম্মতিপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করছে, তাই একে নিয়ে কাজ না করলে ভবিষ্যতে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

cryptocurrency-1 (3).PNG

এছাড়া হয়তো এমন একদিন আসবে যখন বাইরের দেশের সাথে বাণিজ্য করতে হলে এই ক্রিপ্টো দিয়েই করতে হবে। যদি এখন থেকেই একটি দেশ তার নিজ দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করলে কী কী অসুবিধা হতে পারে এবং সেগুলো নিরসনের উপায় কী হবে সেগুলো বের করতে না পারে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে তারা পিছিয়ে পড়বে। তাই থাইল্যান্ড ধরেই নিয়েছে যে, ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে পুরোপুরি ডিজিটাল এবং ক্যাশলেস ইকোনমির। অর্থাৎ কাগজের টাকার কোনো মূল্য সেখানে থাকবে না। সম্পূর্ণটাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে হবে।

06-mm-cryptocurrency.jpg

শুধু থাইল্যান্ডই নয়, এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ, যেমন- সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের অর্থনীতিক উপদেষ্টা পরিষদ এবং তাদের কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ইতোমধ্যে কিছু পরিমাণ কাজ এগিয়ে রেখেছে। তারা তাদের দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করার এবং প্রচলিত করার জন্য নীতিগত কিছু কাজ করেছে। তারা একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে, যেখানে ক্রিপ্টো ব্যবহারের নিয়ম-কানুন নিয়ে কাজ করা হয়েছে। থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুরের তৈরি করা মডেলের উপর কাজ করবে। অনেক দেশই চীনের তৈরি একই ধরনের মডেল নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু সেটা থেকে সিঙ্গাপুরের তৈরি ক্রিপ্টো ব্যবহার করার পদ্ধতি অনেকটা আধুনিক এবং দক্ষ।

cryptocurrency-1 (3).jpg

থাইল্যান্ড এখন ক্রিপ্টো ব্যবহারের নিয়ম-কানুন নিয়ে কাজ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো ব্যবহার করা হবে, কোন কোন জায়গায় সরাসরি ক্রিপ্টোর মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে, সাধারণ মানুষের লেনদেন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইত্যাদি দিকগুলো নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। থাইল্যান্ড ক্রিপ্টোকারেন্সি কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহার করবে এটা ঘোষণা দেয়ার পর সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্রিপ্টো-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। এদের মধ্যে বিটকয়েন কোম্পানি লিমিটেড, বিটকাব অনলাইন কোম্পানি লিমিটেড, ক্যাশ টু কয়েন কোম্পানি, কয়েন এসেট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান অন্যতম। তারা থাইল্যান্ডে তাদের ব্যবসায়িক বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।

cryptocurrency-1 (2).png

বাংলাদেশও কিন্তু ইচ্ছা করলে ক্রিপ্টো দিয়ে লেনদেনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই পারে। লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেই থাকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় লেনদেন ক্রিপ্টোর মাধ্যমে করার অনুমতিপত্র দিতে পারে বাংলাদেশ। এতে আমাদের দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে যাবে। এছাড়া এরকম প্রযুক্তি তৈরি হলে সেটা নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য মানুষ দরকার পড়বে। এমন প্রযুক্তি তৈরি করলে যে একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

create-your-own-cryptocurrency-exchange.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Hi! I am a robot. I just upvoted you! I found similar content that readers might be interested in:
https://www.packagetrackr.com/