নানা সঙ্কটে ধ্বংসের মুখে টাঙ্গাইলের পোল্ট্রি শিল্প

in dlive •  7 years ago 

tangailtimes-29-11-17-10_jpg.jpg

প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। টাঙ্গাইলে নানা সঙ্কটের কারণে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খামার। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেকেই। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। গত কয়েক বছরে টাঙ্গাইলে প্রায় তিন হাজার পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

টাঙ্গাইল জেলা পোল্ট্রি খামারিরা জানান, মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে পোল্ট্রি খামার করা হয়। তারপর পরিশ্রমতো আছেই। কিন্তু সে অনুপাতে লাভবান হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ডিম ও মুরগির উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারমূল্যের কোনো মিল নেই। বর্তমানে একটা ডিম উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ছয় টাকার কাছাকাছি। অথচ সে ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে চার টাকার কিছু উপরে।

এক কেজির মুরগি উৎপাদন করতে খরচ হচ্ছে ১২০ টাকা। সেখানে বিক্রি করতে হচ্ছে ৯০-৯২ টাকায়। এ অবস্থায় খামারিরা লোকসানের মধ্যে রয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা পোল্ট্রি খামার রক্ষা পরিষদের আওতায় প্রায় চার হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে আরো অন্তত তিন হাজার খামার রয়েছে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার ছাতীহাটী গ্রামের পোল্ট্রি খামারি আব্দুল কাইয়ুম বিপ্লব বলেন, এক হাজার মুরগির খামার করতে হলে জায়গা ছাড়াই প্রায় আট লাখ টাকা খরচ হয়। অথচ বছর শেষে লাভের পরিবর্তে লোকসান দিতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের পোল্ট্রি ব্যবসা এখন কফিনে বন্দি হওয়ার অবস্থায় আছে। বড় মাপের কিছু ব্যবসায়ী আমাদের মত ছোট খামারিদের ধ্বংস করে এ খাতকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টায় আছে। তারা ডিম ও মুরগি উৎপাদন শুরু করেছে। খামারিরা ধ্বংস হলে তারা উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে বাজার তৈরি করবে।

নাজমুল হাসান নামের আরেক খামারি বলেন, আমি জমি বন্ধক রেখে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে এই ফার্ম শুরু করেছিলাম। আমার এখন সব শেষ হয়ে গেছে। মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে ১৬ লাখ টাকার খাদ্য এনেছিলাম। তিনি টাকার জন্য মামলা করেছেন। কৃষি ব্যাংকে ঋণ আছে ছয় লাখ ২০ হাজর টাকা। আমার বন্ধকী জমিগুলোও তুলতে পারিনি।এই শিল্পে সরকারের নজরদারি না থাকা এবং বহুজাতিক কোম্পানির কালো থাবায় তার এই পরিণতি হয়েছে বলে তিনি জানান।

অন্যদিকে ভূঞাপুর উপজেলার নিকলা গ্রামের মিজান তালুকদার পাঁচ হাজার লেয়ার মুরগি নিয়ে ফার্ম করেছিলেন। লোকসানের মুখে পড়ে তিনিও এখন দিশেহারা। দফায় দফায় তিনি তার তিন বিঘা জমি বিক্রি করে এই ব্যবসায় খাটিয়েছেন।

তিনি বলেন, এখন আমার আট শতাংশের বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। ব্যাংকে আট লাখ টাকা ঋণ। আমি এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। একই উপজেলার ভারই গ্রামের মহিউদ্দিন আট হাজার মুরগি নিয়ে একটি ফার্ম করেছিলেন।

গাজিপুরের একটি কোম্পানি থেকে তিনি ১৫ লাখ টাকার চেক দিয়ে বাকিতে খাদ্য এনেছিলেন। ফার্মে ক্ষতি হওয়ায় তিনি সেই টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে ওই কোম্পানি তার বিরুদ্ধে চেক ডিসঅনারের মামলা করেন। এ মামলায় গত রমজান মাসে গ্রেফতার হয়ে তিনি এখনো কাশিমপুর জেলহাজতে আছেন। শুধু নাজমুল হাসান আর মহিউদ্দিন নন; তাদের মত অবস্থা আরো অনেকেরই।

জেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইলে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মিলিয়ে পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩৫টি। এরমধ্যে লেয়ার ফার্ম তিন হাজার ৭৯৪টি এবং ব্রয়লার ফার্ম দুই হাজার ১৪১টি। কিন্তু খামারিদের ভাষ্যমতে এই তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।

খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ টাঙ্গাইল জেলা শাখার হিসাব মতে, জেলায় পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা কমপক্ষে নয় হাজার। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে খামারের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোক তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বাকি সাড়ে চার হাজার খামারে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন আরো ৫০ হাজার লোক। সরকারি উদ্যোগে এ অবস্থার উত্তরণ না হলে এই লোকদেরও কর্ম হারানোর আশঙ্কা করছেন পরিষদের কর্মকর্তারা। সরকারিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবিতে এরআগে বেশ কয়েকবার ডিম ভেঙে মহাসড়ক অবরোধ করেন খামারিরা। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক একেএম আওয়াল বলেন, পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচাতে চাইলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে খামারিদের। বীমার আওতায় আনতে হবে স্পর্শকাতর এই শিল্পকে।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এসএম আউয়াল হক বলেন, মুরগির ডিম ও মাংসের মূল্য নির্ধারণ নেই। এটি উঠানামা করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সরকারের নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে মানে না। একটি বাচ্চার দাম যেখানে ৩০ টাকা সেখানে কখনো কখনো ১৪০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে প্রান্তিক খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। তাছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীরাও লাভের বড় অংশ নিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আর স্থানীয়ভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইলটাইমস

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!