রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদানে এগিয়ে আসুন

in eye •  7 years ago 

২ নভেম্বর জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। আগে দিনটি সরকারিভাবে পালিত হলেও ২০০৩ সালের পর থেকে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে।

১৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংকে প্রথমবারের মতো ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির’ আয়োজন করে সন্ধানী। সেদিন ২৭ জন স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। পরবর্তী সময়ে এই দিনটিকেই ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা আসে। এটি এখন জাতীয় দিবসে পরিণত হয়েছে। আশার কথা যে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমে রেড ক্রিসেন্ট, বাঁধন, কোয়ান্টাম, মেডিসিন ক্লাবের মতো অনেক সংগঠন যুক্ত হয়েছে।
হিমোগ্লোবিনের অভাব অথবা থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণে অনেক মানুষ রক্তশূন্যতায় ভোগে। তখন তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয় অন্যের রক্ত। এই রক্ত যেহেতু কেনা যায় না, সেহেতু আপনার, আমার রক্তদানের ওপরই নির্ভর করছে তাদের বেঁচে থাকা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শল্যচিকিৎসায় লাগছে প্রচুর রক্ত।

২০০৮ সালের ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা ৩০ শতাংশ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় এই হার খুবই নগণ্য। ভারতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার পরিমাণ ৬৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১০০ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ছয় লাখ ব্যাগের মতো রক্তের প্রয়োজন হয়। সন্ধানীর পক্ষে দুষ্প্রাপ্য গ্রুপের বা নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের তালিকা বা ডিরেক্টরি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আরেকটি বিষয়, স্বেচ্ছায় রক্ত সংগ্রহে যারা কাজ করছে তারা কিন্তু মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা শুধু সন্ধানী করুক—এটাও আমরা চাই না। এ জন্যই স্বেচ্ছায় রক্তদানকে আরো পরিকল্পিতভাবে নিয়ে আসা দরকার। তাতে চাহিদার অনেক বেশিই পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। দেশের ৫০ লাখ লোক যদি বছরে একবার রক্তদান করে, তবে রক্তের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। ১৯৯৫ সালে বিএসএমএমইউতে এক সেমিনারে আমি মূল প্রবন্ধে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে দাবি তুলে ধরেছিলাম। আমাদের সে আন্দোলনও সফল হয়েছে। এখন সরকার নিজেই সেভ ব্লাড ক্যাম্পেইন বা নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দুঃখজনক সত্য হলো, রক্তের চাহিদার একটা বড় অংশই আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতার কাছ থেকে, যাকে দূষিত রক্ত বলা হয়। এই পেশাদার বিক্রেতাদের বড় অংশই নেশাগ্রস্ত বা রোগে আক্রান্ত থাকে। কোনো কোনো ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে এসব নেশাখোর রক্ত বিক্রেতার রক্ত নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও আছে। নিরুপায় হয়ে অথবা না জেনে এই রক্ত যাদের শরীরে যাচ্ছে তাতে বরং হীতে বিপরীতই হচ্ছে। রক্ত গ্রহণের পর সেই মানুষটির দেহে ভয়ংকর কোনো রোগের বীজ হয়তো ঢুকে যাচ্ছে চিরজীবনের জন্য। আমাদের বুঝতে হবে, যেকোনো রক্ত মানেই তা কিন্তু নিরাপদ নয়। আর আমরা কেউই চাই না আমার প্রিয়জন আক্রান্ত হোক কোনো মরণব্যাধিতে।

রক্তদানের বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। ১৮ থেকে ৫৭ বছর বয়সী যেকোনো সুস্থ মানুষ, যাঁদের ওজন কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৪৭ কেজি, তাঁরা প্রতি চার মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন। এই সময় পর মানবদেহে নতুন রক্ত তৈরি হয় এবং রক্তকণিকাগুলো এমনিতেই মারা যায়। রক্ত দান করলে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য শক্তি পায়। রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়। বছরে তিন বা চারবার রক্তদানে শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। নিয়মিত রক্তদান রক্তে কোলেস্টেরলের উপস্থিতি কমাতেও সাহায্য করে। স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে বিনা খরচে মানুষ জানতে পারে নিজের শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইচআইভির (এইডস) মতো জটিল কোনো রোগ রয়েছে কি না। সবচেয়ে বড় কথা, রক্তদানের মাধ্যমে একজন মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোর মতো কাজে শরিক হতে পেরে নিজের মানসিক তৃপ্তি মেলে। আশার কথা যে প্রচার-প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এখন আমাদের চারপাশে রক্তদাতার সন্ধান বেশ মিলছে। মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার মতো কাজে এখন বেশ উৎসাহ বোধ করে। কারো রক্তের দরকার হলে এখন ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলেও মিলে যাচ্ছে। সেই জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি, নিমতলীর দুর্ঘটনা অথবা সাভার ট্র্যাজেডির সময়ও আমরা দেখেছি মানুষ লাইন ধরে রক্তদান করছে। এতে রক্ষা পেয়েছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। রক্তদানের জন্যই নানা রোগ অথবা দুর্ঘটনায় উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে।

রক্তদানের মতো চক্ষুদানে কিন্তু মানুষকে আমরা খুব বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। দেশে অন্ধের সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এসব অন্ধত্বের শিকার অধিকাংশই কর্নিয়ার অস্বচ্ছতা থেকে সৃষ্ট, যাদের বেশির ভাগই শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে অন্ধত্বের সংখ্যাটা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দশ গুণ বেশি। হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ দেশে প্রতিবছর ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্বের শিকার হচ্ছে।

রক্তদানের মতো মরণোত্তর চক্ষুদানে আমরা তেমন অগ্রগতি লাভ না করলেও চেষ্টার কমতি নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয় মরণোত্তর প্রক্রিয়ায়। চক্ষুদানে অর্থাৎ কর্নিয়া সংগ্রহের ব্যাপারে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা এখনো এগিয়ে। সে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মরণোত্তর চক্ষু দান করে। ফলে কর্নিয়া সরবরাহে অন্যান্য দেশকেও তারা সহায়তা করতে পারছে। বাংলাদেশেও মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ১৯৮৪ সাল থেকে কাজ করছে। এখন দেশেই স্থাপন করা হয়েছে সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে চলছে কার্যক্রম। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে চক্ষুসেবার পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানকারীদের কাছ থেকে অথবা বেওয়ারিশ মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে চোখ সংগ্রহ করে দুস্থ অন্ধদের বিনা মূল্যে কর্নিয়া সংযোজন করে আসছে। ২০১৩-১৪ সালেও ৪১৯টি কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়েছে। কেউ চক্ষুদান বিষয়ে আগ্রহী হলে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির দেওয়া অঙ্গীকারপত্র পূরণ করে সন্ধানী চক্ষু ব্যাংকে জমা দিতে হয়। তবে ছয় বা ১২ ঘণ্টার মধ্যে চোখ সংগ্রহ না করলে কর্নিয়া সেলের সংখ্যা কমে যায়। তাই এই সময়ের মধ্যে তা সংগ্রহ করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অন্ধ মানুষের চোখে প্রতিস্থাপন করলে সেই মানুষটি পেতে পারে সুন্দর এই পৃথিবী দেখার সুযোগ। কর্নিয়া দান করা যায় জীবনে মাত্র একবারই এবং তা করা যায় দাতার মৃত্যুর পর।

মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে ইসলাম ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মে কোনো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে আমার জানা নেই। বরং মক্কাভিত্তিক ইসলামী ফিকাহ একাডেমি বলেছে, মরণোত্তর অঙ্গব্যবচ্ছেদ বা সংস্থাপন শরিয়তবিরোধী নয়। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরাও চক্ষুদানকে মানবসেবা বলেছেন। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) মরণোত্তর চক্ষুদানের অনুমোদন দিয়েছে। এর পরও অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। এর মূল কারণ সচেতনতার অভাব অথবা ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা। এ জন্য অনেকে চক্ষুদান করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেও নিকটাত্মীয়রা মৃত ব্যক্তির অঙ্গ নেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দরকার ব্যাপক মোটিভেশন। আর এই মোটিভেশনের কাজটি করার দায়িত্ব আপনার, আমার, সবার। কেননা আপনার, আমার একটু সদিচ্ছায় একজন পেতে পারে তার দৃষ্টিশক্তি। তবে নতুন প্রজন্মকে এখন আর আগের মতো স্বেচ্ছা কার্যক্রমে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বায়নের এই যুগে অন্যান্য বিষয়ে ব্যস্ত থাকায় তাদের মানবিক মূল্যবোধ বোধ হয় কিছুটা কমে গেছে। তাই আসুন, রক্তদানের মতো মরণোত্তর চক্ষুদানেও আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই। এ বিষয়ে সরকার, গণমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবীসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

nice

খুব ভালো কাজ

Good.

nice work bro