একটা সময় ছিল যখন "আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে" বেরোতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শৈলেন ঘোষ, বিমল কর, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, অতীন বন্দোপাধ্যায়, রূপক সাহা, মতি নন্দী প্রমুখ সব বিশিষ্ট সাহিত্যিকের লেখা । বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা বা প্রোফেসর শঙ্কু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্তু-কাকাবাবু, সমরেশ বসুর গোগোল, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, মতি নন্দীর কলাবতী, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা এবং অবশ্যই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত অদ্ভুতুড়ে উপন্যাস ।
আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী ছাড়া পুজোর ছুটি ভাবাই যেতো না । আমি সেই ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেক বছর "আনন্দমেলা পূজা বার্ষিকী" কিনি । আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী শুধুমাত্র একটি নিছকই পূজা বার্ষিকী নয় , এটা হলো একটা আবেগ, একটা নস্টালজিয়া । পুজোর সময়ে আনন্দমেলা বিহীন পুজো কাটানো আমি কোনোদিনও ভাবতে পারিনি । তাই প্রত্যেক বছর আনন্দমেলা কিনি আমি বাতাসে যখন পুজো পুজো গন্ধ ছড়ায় ।
এবছরই হয়তো ব্যতিক্রম হতে যাচ্ছে । এবার হয়তো আনন্দমেলা কেনা হবে না । কারণটা অবশ্যই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ন্যাক্কারজনক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি । একের পর এক যখন আমাদের প্রিয় লেখকদের জীবনাবসান হলো তখন আমরা একে একে হারিয়ে ফেললাম আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীর পাতা থেকে গোগোল, ফেলুদা, প্রোফেসর শঙ্কু, কিকিরা, অর্জুন, কাকাবাবু-সন্তুকে । কিন্তু, সব প্রদীপ নিভে গেলেও একটি প্রদীপ এখনো দীপ্তি ছড়াচ্ছে । শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "অদ্ভুতুড়ে সিরিজ" ।
এই এক অমোঘ আকর্ষনে আমি আজও আনন্দমেলার পাতায় নিজের ছেলে বেলা খুঁজতে যাই । প্রত্যেক বছর এখন যে আনন্দমেলা পূজা বার্ষিকী কিনি তা শুধুমাত্র শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "অদ্ভুতুড়ে"-র টানে । সুদীর্ঘ সেই ইতিহাসে আজ হঠাৎ রাশ ছিঁড়ে গেলো । হঠাৎ, ছন্দপতন । আনন্দবাজার গোষ্ঠী এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শীর্ষেন্দুর "অদ্ভুতুড়ে" আর ঠাঁই পাবে না আনন্দমেলার পাতায় ।
এ বছরের "আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী ২০২৩" তাই শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে উপন্যাস ছাড়া একদমই ঔজ্বল্যহীন, ফ্যাকাশে একটি ম্যাড়মেড়ে পূজাবার্ষিকী পত্রিকা । দামও রাখা হয়েছে দেখলাম প্রায় ৩০০ র কাছাকাছি । এত টাকা খরচ করে কোনো রাবিশ কেনা বোকামো ছাড়া আর কিছুই নয় ।
এরপরে আজ হঠাৎ জানতে পেলুম যে আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাদের আরেকটা পূজাবার্ষিকী "দেশ" এর জন্য শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজের একটা উপন্যাস প্রকাশ করতে চলেছে । অর্থাৎ, ছোটদের পত্রিকা বাদে বড়োদের পত্রিকা "দেশ"-এ ঠাঁই পেতে চলেছে অদ্ভুতুড়ে । কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত ? আসলে আনন্দবাজার গোষ্ঠী প্রতি বছর মোট সাতটি পূজাবার্ষিকী প্রকাশ করে । এগুলো হলো - পত্রিকা, এবেলা, দেশ, সানন্দা, আনন্দলোক, ১৯-২০, আনন্দমেলা এবং আনন্দবাজার । এই সাতটি পুজোবার্ষিকীগুলোর মধ্যে ছোটদের জন্য একমাত্র পূজাবার্ষিকী হলো আনন্দমেলা । বাকিগুলো সব বড়োদের জন্য ।
আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাদের "দেশ পূজাবার্ষিকীর" কাটতি বাড়াতে এই ন্যাক্কারজনক মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে । এবছর পুজোয় অদ্ভুতুড়ে পড়তে হলে "দেশ" কিনতেই হবে । আর "আনন্দমেলা" তো কিনতেই হবে । কারণ ওটাই একমাত্র ছোটদের পূজাবার্ষিকী । অর্থাৎ, আপনাকে বাধ্য হয়ে দু'টি পত্রিকা কিনতে হবে । লক্ষ করুন আমি বলেছি "বাধ্য হয়ে কিনতে হবে", হুম, এটাই হলো এদের মার্কেটিং স্ট্রাটেজি ।
শীর্ষেন্দুর "অদ্ভুতুড়ে" সিরিজের ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদেরকে এক প্রকার বাধ্য করা হচ্ছে দুটি পত্রিকা কিনতে । আর "দেশ" হলো আপদমস্তক পুরো একটা বড়দের পত্রিকা । সেখানে অ্যাডাল্ট উপন্যাস সবক'টিই, আছে যৌনতা, নিষিদ্ধ সম্পর্ক, ভায়োলেন্স, নগ্নতা, রাজনীতি; সেখানে ঠাঁই পেতে চলেছে শিশু কিশোরদের উপন্যাস । ভাবুন একবার কি একটা অবস্থা !!
নামতে নামতে আমরা আসলে অনেকটাই নীচে নেমে গিয়েছি । উপরের উন্মুক্ত নীল আকাশ আর আমাদের নজরে আসে না । খোলা হাওয়ায় আর আমরা নিঃশ্বাস নিতে পাই না । শুধু একটু একটু করে নরকাগ্নির নিকটে আরও নিকটে আজ আমাদের অবস্থান ।
------- ধন্যবাদ -------