৬ দফা প্রণয়ন
১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে চেধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান ৬ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ পেশ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধুর নামে আমাদের বাঁচার দাবি- ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ১৩ মার্চ, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ‘ছয় দফা’ অনুমোদিত হয়। ১৫ মার্চ, ১৯৬৬ সালের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফা প্রণয়নকারীদের পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৮ মার্চ, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আমাদের বাঁচার দাবি- “ছয়- দফা” গৃহীত হয়।
২৩ মার্চ, ১৯৬৬ সালে লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ মে, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার কারণে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের পূর্বে ২০ মার্চ তেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫০ দিনে তিনি ৩২টি জনসভায় ভাষণ দেন। এই সময় সীমার মধ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ৬ দফার পক্ষে অভাবনীয় জনমত সৃষ্টি করেন। ছয় দফা দিবস - ৭ জন৷ ৬ দফার অন্য নাম- ম্যাগনাকার্টা বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি। এটাই সত্য যে, পাকিস্তান কখনই ৬-দফা মেনে নেয়নি এবং শেখ মুজিব ৬-দফা থেকে সরে আসেননি। যার অনিবার্য ফলাফল ৭১ এর বাংলাদেশ।
লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রগুলো সম্পূর্ণ সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত হবে।' কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২ নং দফায়-> কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা। ৪ নং দফায়-> খাজনা, ট্যাক্স ধার্য, আদায়, জমার অধিকার থাকবে অঙ্গরাজ্যের হাতে। ৫ নং দফায়-> আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষমতা।
আগরতলা মামলা (১৯৬৮)
অভিযোগঃ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীরা ভারতের সহায়তায় সশস্ত্রভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার চক্রান্ত করছে। মামলাটি 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিত। এই মামলাটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য [State Vs Sheikh Mujibur Rahman & others] ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় এ মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলার তথ্য ফাঁস করে দেন পাকিস্তান ইন্টার ইন্টেলিজেনসের সদস্য আমির হোসেন। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব এস.এ. রহমানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে কড়া প্রহরায় মামলার বিচার শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণ করে ফাঁসি দেওয়াই ছিল এ মামলার লক্ষ্য। এই মামলার সাক্ষীর সংখ্যা ছিল সরকার পক্ষে ১১ জন। রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন। প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের নিয়ে একটি ডিফেন্স টিম গঠন করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিরা ব্রিটেনের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে প্রেরণ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রধান কৌশলী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টি. এইচ, খান। ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এস এ রহমান। অপর দুই বিচারপতি ছিলেন এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম। ২৯ জুলাই ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মামলার শুনানি পুনরায় শুরু হয়। স্যার টমাস উইলিয়াম ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন।
১৯ জুন বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে মামলার শুনানি শুরু হয় পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২-ক এবং ১৩১ ধারা অনুসারে। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মূল উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ২নং আসামি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জম হোসেনকে। আসামিদের মধ্যে সিএসপি (CSP) অফিসার ছিলেন ৩ জন। অন্যরা হলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য রাজনীতিবিদ। ও যারা এই মামলায় বন্দি হয়ে ছিলেন তাদের ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী আইনে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া আরও ১১ জন অভিযুক্ত ছিলেন, রাজসাক্ষী হতে সম্মত হওয়ায় তাদের ক্ষমা করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, মামলার ১৭নং আসামি সার্জেন্ট জহুরূল হককে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলাকে ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র' মামলা নামে অভিহিত করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষ আসামি ছিলেন লে. আব্দুর রউফ (নৌ বাহিনী)। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল ১৬টি।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন(মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), National Student Front (NFS), এর সভাপতি, সম্পাদক এবং ডাকসুর ভিপি(তোফায়েল), G.S এই ১০ জন নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ডাকসুর ভিপি হিসেবে তোফায়েল আহমেদ এর সমন্বয়ক ও মুখপাত্র নিযুক্ত হন। আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্ৰীয় ছাত্র সংসদে সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদকে সভাপতি করে একটি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ (Student Action Committee) গঠন করে। ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৯, ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে ১১-দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। [বইঃ সত্য মামলা আগরতলা- কর্নেল শওকত আলী মোল্লা] মূলত ৬-দফার বিস্তারিত রূপই ১১ দফা। ১১ দফার ৩ নং দফা ৬ দফা, বাকি ১০ দফা ছাত্রদের। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের ৮টি রাজনৈতিক দল মিলে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ' DAC (Democratic Action Committee) নামক মোর্চা গঠন করে এবং ৮-দফা দাবি উত্থাপন করে যাতে ৬ দফা ও ১১-দফার সমর্থন পাওয়া যায়। ১১ দফা আন্দোলনের সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। ১১ দফা আন্দোলনের সময় সরকারি ছাত্র- সংগঠন ছিল এন.এস.এফ।