বঙ্গভঙ্গ
লর্ড কার্জনের রাজত্বকালে প্রশাসনিক অসুবিধার কথা চিন্তা করে (১৯০৫ সালে তিনি সমগ্র বঙ্গ দেশকে আর্থাৎ বাংলা প্রেসিডেন্সিকে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। পূর্ব বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সি গঠিত ছিল। এ বিশাল প্রদেশের শাসন ন্যস্ত ছিল একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাটের ওপর। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে এত বড় প্রদেশের শাসনভার একজনের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। ব্রিটিশ সরকারের শাসন করার নীতি ছিল ‘বিভেদ ও শাসন নীতি' (Divide and Rule Policy)। এই নীতির ফলশ্রুতিতে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে ১৬ অক্টোবর বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে দুটি প্রদেশ গঠন করে ইতিহাসে যা বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। ১৯০৫ সালে ৫ জুলাই সরকারিভাবে বঙ্গবিভাগ ঘোষণা ও ঐ বছরের (১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জনের আদেশে এটি কার্যকর করা হয়।
লর্ড কার্জন গঠিত নতুন দুটি প্রদেশ ছিল-
(1) পশ্চিম বাংলা প্রদেশ: পশ্চিম বাংলা বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী ছিল কলকাতা। এ প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার।
(2) পূর্ববঙ্গ ও আসাম: ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিভাগ এবং আসাম নিয়ে গঠিত এ প্রদেশের রাজধানী ছিল ঢাকা। পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন ব্যামফিল্ড ফুলার
বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া
শুধু প্রশাসনিক অসুবিধার কারণে নয় বরং পূর্বাঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বঙ্গভঙ্গের একান্ত প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক হওয়ায় পশ্চিম বাংলার যথেষ্ট উন্নতি হলেও পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন উন্নতিই হয়নি। তাই পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার দরুন বঙ্গভঙ্গের ফলে তারা ভবিষ্যতের আশার আলো দেখতে পায়।
অপরদিকে, ১৯০৫ সালে ৫ জুলাই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার সাথে সাথেই হিন্দুদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুর নেতৃত্ব অনুধাবন করতে পারেন যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত কৃষক শ্রমিক জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। তাদের মধ্যে নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটবে এবং রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হবে। পরে তাদেরকে আর কখনই শোষণ করা যাবে না। কাজেই তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন।
ফলাফল
→ মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করায়(হিন্দুরা ক্ষেপে যেয়ে একে(সর্ব ভারতীয় সমস্যা বলে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে।
→ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এর মধ্যে জড়িয়ে পরলে এ আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।
→ নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
→ অচিরেই কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবর্গের প্রচেষ্টায় এটি জাতীয় আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
→ গুপ্ত হত্যা, দাঙ্গা, বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যাদি, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ইত্যাদি ছিল এ আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি। ইতিহাসে এটি স্বদেশী আন্দোলন নামে খ্যাত।
→ শীঘ্রই তাদের আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। ফলে লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনার সূত্রপাত করে।
→ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আমার দেশের মাটি' গান এবং 'বাংলার মাটি, বাংলার জল’ কবিতা লিখেন।
→ কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ধিন ধান্যে পুষ্পেভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি এই আন্দোলনের সময় রচনা করেন।
→ বেঙ্গলি, সঞ্জীবনী, যুগান্তর, অমৃতবাজার, সন্ধ্যা ও হিতবাদী পত্রিকাগুলো স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালায়।
→ এ আন্দোলনে প্রথম বারের মতো বাংলার নারীরা অংশগ্রহণ করে।
→ আন্দোলনের সমর্থনে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সমিতি গঠিত হয়। যেমন- অনুশীলন (ঢাকা, নেতা পুলিন বিহারী দাস), সাধনা (ময়মনসিংহ), ব্রতী (ফরিদপুর), স্বদেশী বান্ধব (বরিশাল), যুগান্তর (কলকাতা)।
বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১)
(১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের সময় ব্রিটেনের রাজা ছিলেন ৫ম জর্জ এবং ভাইসরয় ছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ তিনি ১৯১২ সালে রাজধানী দিল্লীতে হস্তান্তর করেন।
স্বদেশী আন্দোলন
→ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তাকে সাধারণভাবে স্বদেশী আন্দোলন বলে। এই আন্দোলনে সর্বপ্রথম বাংলার নারীরা প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করে
→ কবি মুকুন্দ দাস বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘পড়ে না রেশমী চড়ি বঙ্গনারী’-গান গেয়ে জনগণের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে তীব্র আবেগ সৃষ্টি করেন।
→ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে 'রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাঙালির ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল' গানটি রচনা করেন।
→ কৃষ্ণকুমার মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ এবং মতিলাল ঘোষ তাঁদের লেখনি দ্বারা বিলাতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশি পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
বাংলার সশস্ত্র বিদ্রোহী আন্দোলন:
→ স্বদেশী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বাংলার স্বাধীনতাকামী যুব সমাজ সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেয়। তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
→ স্বদেশী আন্দোলনের সদস্যবৃন্দ গেরিলা পদ্ধতি অনুসরণ করে। ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তাদের উপর হামলাই ছিল এ আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। ১৯০৬ সাল থেকে পরিচালিত এ বিপ্লবী আন্দোলনকে ব্রিটিশ সরকার সন্ত্রাসবাদী হিসেবে অভিহিত করে।
→ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে(ক্ষুদিরাম কর্তৃক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংস ফোর্ডকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে বাংলার স্বদেশি আন্দোলন সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। । ১৯২৪ সালে ইংরেজ সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বিপ্লবীদের গ্রেফতার করেন।
→ বাংলার সশস্ত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেয় তাদের মধ্যে(অরবিন্দু ঘোষ, রবীন্দ্র ঘোষ এবং ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন অন্যতম।
→ এ আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ছিল ঢাকার অনুশীলন সমিতি (এর নেতা ছিলেন পুলিন বিহারী দাস) ও কলকাতার যুগান্তর সমিতি (এর নেতা ছিলেন (বাঘা যতিন, প্রকৃত নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)।
→ ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। এতে কিংসফোর্ডের কন্যা ও স্ত্রী মারা যান। বিপ্লবী নেতা ক্ষুদিরাম বোমা মেরে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং ধরা পরে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করে। মাস্টারদা সূর্যসেন চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে “চিটাগাং রিপাবলিকান আর্মি" নামক আত্মঘাতি বিপ্লবী বাহিনী গঠন করেন যা একের পর এক সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের আয়ত্বে নেন। তিনি ১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল দলবল নিয়ে চট্টগ্রামের ২টি সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। ১৯৩৩ সালে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয় ও মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
→ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাস্টারদা সূর্যসেনের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে মাস্টারদার নির্দেশে ‘পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে’ দলবলসহ আক্রমন করেন। আক্রমনের সময় গুলিবিদ্ধ হলে ব্রিটিশ সরকারের হাতে বন্দী হবার পূর্বে তাৎক্ষনিকভাবে পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
→ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন লর্ড কার্জন। → পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার। → বঙ্গভঙ্গ রদ করেন (লর্ড হার্ডিঞ্জ। → ব্রিটিশ বাংলায় অবিভক্ত বাংলার (১৯৪৭) সর্বশেষ গভর্নর(ফ্রেডরিক বারোজ। → স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল(লর্ড মাউন্টব্যাটেন (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-২১ জুন, ১৯৪৮)। → স্বাধীন ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী (২১ জুন, ১৯৪৮-২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০)