১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে এক সমাবেশের আয়োজন করে। ঐ সমাবেশে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আব্দুর রব সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শর্তরোপ করে বলেন।
নিম্নোক্ত শর্তগুলো পালিত হলেই কেবল তিনি চিন্তা করে দেখবেন জাতীয় পরিষদে যোগ দিবেন কি নাঃ
১। অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার (Immediate Withdrawal of Martial Law)।
২। অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া (Immediate Return of the Army to the Barracks)।
৩। সেনাবাহিনীর সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা (To Make an Inquiry into the Killings by the Army)।
৪। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা (To Hand Over Power to the Elected Representative of the people)।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই ৬ মার্চ লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ঢাকায় আসেন। ২৫ মার্চ কালরাতে তিনি ছিলেন ঢাকায়। তাঁর বয়স তখন সবে ২৬ বছর। পরে অবশ্য সাইমন ড্রিংকে ঢাকা ছেড়ে ব্যাংককে পাড়ি জমাতে হয়। ব্যাংককে থেকে তিনি তাঁর গণহত্যার বিবরণ ছাপার জন্য সংবাদপত্র অফিসে পাঠান। তাঁর পাঠানো এবং Daily Telegraph- এর ৩০ মার্চ সংবাদের শিরোনাম ছিল: ‘ট্যাংক দিয়ে পাকিস্তানে বিদ্রোহ দমন করা হচ্ছে: ৭০০০ নিহত, ঘরবাড়ি ভস্মীভূত’। এতে বলা হয়- আল্লাহ এবং পাকিস্তানের ঐক্যের নামে ঢাকা আজ বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত নগরী।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মেজর শফিউল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হন কর্নেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব, লে. কর্নেল সালেহ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধারা। সবাই তখন যে যার মত প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণরত। সেদিন তারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের নেতৃত্বে পরিচালনা করতে হবে। সকলে একমত হয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাংগঠনিক নাম বা পরিচয় নির্ধারণ করেন ‘মুক্তিবাহিনী’ বা ‘মুক্তি ফৌজ’ (M.F.)। সরকারিভাবে তাদের নাম রাখা হয় ‘নিয়মিত বাহিনী’ এবং প্রধান সেনাপতি হিসেবে তারা সকলেই কর্নেল (অব.) এম.এ.জি. ওসমানীকে সাব্যস্ত করেন।
মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে। এ সরকারের প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তারই নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর এবং অস্থায়ী সরকারও পরিচিত হয় মুজিবনগর সরকার নামে। প্রথম দিকে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালে এর সদর দপ্তর কলকাতায় ৮নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যেই বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি দূতাবাসের অনেক বাঙালি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ৬ এপ্রিল দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব কে. এম. শাহাবুদ্দিন এবং ১৮ এপ্রিল কলকাতার পাকিস্তান মিশনের সহকারী হাইকমিশনার হোসেন আলীসহ তার দশজন সহকর্মী পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস স্থাপিত হয় কলকাতায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। এছাড়াও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী/উপরাষ্ট্রপতি, এম মনসুর আলী- অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প ও যোগাযোগ মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘জল্লাদের দরবার’ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ‘কেল্লা ফতেহ খান’ নামক একজন অমানবিক, পাশবিক ও নিষ্ঠুর চরিত্রের মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আর একটি জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ছিল ‘চরমপত্র’। এ সিরিজটির পরিকল্পনা ছিল আব্দুল মান্নান খান এম.এন.এ এবং এর স্ক্রিপ্ট তৈরি ও তার পাঠ করতেন এম.আর আখতার মুকুল।
অপারেশন জ্যাকপট হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নৌ সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন। এ অপারেশন ১৯৭১- এর ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে একই সময়ে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২ জন মহিলা; ডা. সেতারা ও তারামন বিবিকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তারামন বিবি ও ডা. সেতারা বেগম ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যথাক্রমে ১১ ও ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ডা. সেতারা বেগম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন।
জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল ‘জেএফআর’ জ্যাকব ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ হতে অবসরগ্রহণকারী জেনারেল জ্যাকব ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জে.এফ.আর জ্যাকব এবং জেনারেল জ্যাকব নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত তার লেখা গ্রন্থ ‘Surrender at Dacca: Birth of a Nation’।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারত সরকার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী বা ‘যৌথকমান্ড’ গঠন করলে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে যায়। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। যৌথ কমান্ডের প্রধান হন ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং ইংরেজি ভাষায় ‘The Liberation of Bangladesh’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীই সর্বাধিক পরিচিত এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সব থেকে বৃহৎ, সবচেয়ে সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত এবং রণাঙ্গনে সর্বাপেক্ষা সফল বাহিনী। কাদের সিদ্দিকীর নামেই এ বাহিনী ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে দেশে এবং দেশের বাইরে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করে। টাঙ্গাইল এলাকায় কাদেরিয়া বাহিনীর পাশাপাশি জনৈক আব্দুল বাতেন নামক এক সাহসী ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনী ‘বাতেন বাহিনী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
কাদের সিদ্দিকী ছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের এক সাহসী, লড়াকু সৈনিক, এক অতন্দ্র মুক্তিসেনানী। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ও অসম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তাঁকে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জীবিতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মাননা ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ‘বঙ্গবীর’ এবং ‘বাঘা কাদের সিদ্দিকী’ নামেও জনগণের নিকট সমাদৃত হয়ে ওঠেন। তিনিই একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা যাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল মিত্রবাহিনীর সাথে সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করা এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় খেতাব বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে: ০৬ জুন, ২০২১।
যে ৪ জনের খেতাব বাতিল করা হয়: মেজর শরিফুল হক ডালিম (বীর উত্তম), মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী (বীর বিক্রম), লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী (বীর প্রতীক), লে. কর্নেল রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন (বীর প্রতীক)। পূর্বে বীর উত্তম সংখ্যা ছিলো ৬৮ জন, বর্তমানে ১ জনের খেতাব বাতিল করায় সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ জনে।
উক্য চিং বা ইউ. কে. চিং মারমা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একমাত্র আদিবাসী বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। ইপিআরের একজন সদস্য হিসাবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। উক্য চিং ১৯৫২ সালে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ (ইপিআর)-এ যোগ দেন এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নায়েক হিসেবে রংপুর জেলার হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি সেই বিওপিতে কর্মরত ১ বিহারি কর্মকর্তা ও ২ পাঞ্জাবি সৈন্যকে হত্যা করে ফাঁড়ির অবশিষ্ট ৯ বাঙালি ইপিআর সৈনিককে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতা অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘হুলিয়া’ ছবির পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচিত্র ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, ধ্রুবতারা।
২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটি সহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে।