বাংলা ব্যাকরণ পর্বঃ২

in hive-107931 •  2 years ago 

কোনো কোনো ধ্বনি উচ্চারণের সময় স্বরতন্ত্রী অনুরণিত হয় না। তখন ধ্বনিটির উচ্চারণ গাম্ভীর্যহীন ও মৃদু হয়। এরূপ ধ্বনিকে বলা হয় অঘোষ ধ্বনি। যেমন: ক, চ, ট, ত, প, খ, ছ, ঠ, থ, ফ ইত্যাদি।

মুখের মধ্যে ফুসফুস থেকে আসা বাতাস মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ রুদ্ধ বা বন্ধ হওয়ার পর অকস্মাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে যে সমস্ত ধ্বনি উচ্চারিত হয় সে ধ্বনিগুলোকে স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি বলে। যেমন: বক শব্দের ক, পাট শব্দের ট। স্পর্শ ধ্বনি ২০টি: ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, প, ফ, ব, ভ। ক থেকে ম পর্যন্ত ২৫টি ধ্বনি পাঁচটি বর্গে বিভক্ত। পাঁচটি বর্গের প্রথম চারটি করে ধ্বনি বাংলা ভাষায় স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি।


bengali-grammar.jpg

সাধারণ অর্থে অক্ষর বলতে বর্ণ বা হরফ (Letter) কে বোঝালেও প্রকৃত অর্থে অক্ষর ও বর্ণ পরস্পরের প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ নয়। অক্ষর হচ্ছে বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ। আর বর্ণ বা হরফ হচ্ছে ধ্বনির চক্ষুগ্রাহ্য লিখিতরূপ বা ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন বা প্রতীক। ইংরেজিতে আমরা যাকে Syllable বলে অভিহিত করি, তা-ই অক্ষর। বাংলা ‘বন্ধন’ শব্দেরও বন্ + ধন্ এ দুটো অক্ষর। কিন্তু ব + ন্ + ধ + ন্– এগুলো অক্ষর নয়; এগুলো বর্ণ বা হরফ।

পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি এক প্রয়াসে ও দ্রুত উচ্চারিত হয়ে যদি একটি যুগ্মধ্বনিতে রূপ নেয় তবে তাকে যৌগিক স্বরধ্বনি বা সন্ধিস্বর বা দ্বিস্বর বলা হয়। বাংলা ভাষায় যৌগিক স্বরধ্বনির সংখ্যা পঁচিশ। তবে যৌগিক স্বরজ্ঞাপক বর্ণ মাত্র ২টি- ঐ এবং ঔ। বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭টি।

ভাষার আঞ্চলিকতা উপভাষা নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে।

উপভাষাঅঞ্চল
বাঙ্গালিবাংলাদেশের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চল।
পূর্বিবাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চল, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক অঞ্চল।
বরেন্দ্রিবাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল।
কামরূপিবিহারের পূর্ব অঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অঞ্চল এবং বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল।

মুহম্মদ আবদুল হাই একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, ধ্বনিতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক। সৈয়দ আলী আহসানের সাথে যুগ্মভাবে তিনি ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ভাষা ও সাহিত্য’, ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ উল্লেখযোগ্য। ‘বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন’ তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী। তিনি ১৯৬১ সালে প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে শিক্ষায় একুশে পদক লাভ করেন।

যে স্বর ছাড়া কোনো শব্দই উচ্চারিত হতে পারে না সে স্বরগুলো হলো মৌলিক স্বরধ্বনির উদাহরণ। মৌলিক স্বরধ্বনি ৭টি। যেমন: অ, আ, ই, উ, এ, ও, এ্যা/অ্যা।

যে বর্ণ উচ্চারণের সময় কণ্ঠতন্ত্রীতে ঘোষ কিংবা গম্ভীর অনুরণন সৃষ্টি হয় তাকে ঘোষ ধ্বনি বলে। বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ হলো ঘোষ ধ্বনি। কোনো কোনো ধ্বনি উচ্চারণের সময় নিঃশ্বাস জোরে সংযোজিত হয় না, তাকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি বলে। বর্গের প্রথম ও তৃতীয় ধ্বনি হলো অল্পপ্রাণ। যেমন: ক, গ, ত, দ, ট, ড ইত্যাদি। তাই ড, দ হলো ঘোষ অল্পপ্রাণ।

বাংলা বর্ণমালায় পূর্ণমাত্রার বর্ণ মোট ৩২টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণের পূর্ণমাত্রার বর্ণ ৬টি ও ব্যঞ্জনবর্ণের পূর্ণমাত্রার বর্ণ ২৬টি।

শরীরের উপরিভাগে অবস্থিত মধ্যচ্ছদা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত শ্বাসবাহী যেসব বিশেষ প্রত্যঙ্গগুলি ধ্বনির উচ্চারণের সঙ্গে যুক্ত সেগুলিকে বাক্প্রত্যঙ্গ বা একত্রে বাগ্‌যন্ত্র বলে। বাগযন্ত্রের এলাকা বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে ফুসফুস, শ্বাসনালি, স্বরযন্ত্র, স্বরতন্ত্র, জিভ, ঠোঁট, নিচের চোয়াল, দাঁত, তালু ও গলনালি। এছাড়াও রয়েছে মধ্যচ্ছদা ও চিবুক।

শব্দের অন্তর্গত একটি ধ্বনি বা একাধিক ধ্বনি বাদ দিয়ে আমরা কোনো কোনো শব্দকে একটু ছোট করে আনি, এতে উচ্চারণের সুবিধাও হয় অর্থাৎ দ্রুত উচ্চারণের জন্য শব্দের আদি, অন্ত বা মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনির লোপকে বলা হয় সম্প্রকর্ষ বা ধ্বনিলোপ বা স্বরলোপ। যেমন: উদুম্বর > ডুমুর, বসতি > বস্‌তি, জানালা > জানলা ইত্যাদি।

যে ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের সামনের অংশ দন্তমূলের একটু উপরে অর্থাৎ মূর্ধায় টোকা দেওয়ার মতো করে একবার ছুঁয়ে যায়, তাকে তাড়িত ব্যঞ্জন বলে। বাড়ি, মূঢ় প্রভৃতি শব্দের ড়, ঢ় তাড়িত ব্যঞ্জনধ্বনির উদাহরণ।

অন্তর্হতি: পদের মধ্যে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে বা অন্তর্হিত হলে তাকে অন্তর্হতি বলে। যেমন: ফাল্গুন > ফাগুন, ফলাহার > ফলার, আলাহিদা > আলাদা ইত্যাদি।

মানুষের দেহের যে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বনি তৈরীতে সহায়তা করে তাকে বাক প্রত্যঙ্গ বলা হয়। কারণ ধ্বনির সৃষ্টি হয় বাগযন্ত্রের দ্বারা। গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, দাঁত, নাক ইত্যাদি বাক প্রত্যঙ্গকে এক কথায় বলে বাগযন্ত্র।

মানুষের বাক প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ কণ্ঠনালি, মুখবিবর, জিহ্বা, আল-জিহ্বা, কোমল তালু, শক্ত তালু, দাঁত, মাড়ি, চোয়াল, ঠোঁট ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকে ‘ধ্বনি’ বলা হয়। বাক প্রত্যঙ্গজাত ধ্বনির সূক্ষ্মতম মৌলিক অংশ বা একককে (Unit) ধ্বনিমূল (Phoneme) বলা হয়।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!