টুয়েন্টি মিনিটস।

in hive-111825 •  2 years ago  (edited)

#নতুন_গল্প

'স্যার উঠেন, বাস আর যায়বো না। রাস্তা শ্যাষ এইহানে।' 

'উঁউঁ...' বাসের হেল্পারের ডাকে মুখের ভেতর অস্ফুটে শব্দ করে চোখ খুললো রিহান। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে বাসে। সাধারণত সে বাসে ঘুমায় না। আজ একটু বেশি টায়ার্ড ছিল। তার উপর রাস্তায় অনেকক্ষণ জ্যামে আটকে পড়েছিল। তাই বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসে তার উপর। ভালোই হয়েছে ঘুমটা, ক্লান্তি ভাবটা কেটে গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারে না। দুহাত মুছড়ে আরেকবার হাই তুলে সে হেল্পারকে জিজ্ঞেস করলো, 'পৌঁছে গেছি?'

'জে স্যার, রাস্তা এইহানে শ্যাষ।'

রিহান ভালো করে চেয়ে দেখে হেল্পারকে। ঘুমানোর আগে সে যে হেল্পারকে দেখেছিল, এ সেই হেল্পার নয়। গাড়ির যাত্রীগুলোও কেমন যেন বদলে গেছে। কাউকে ঘুমানোর আগে দেখেনি সে। হতে পারে পূর্বের যাত্রী নেমে গিয়ে নতুন যাত্রী ওঠেছে। কিন্তু ড্রাইভার? ইনিও তো আগের সেই ড্রাইভার নন। কেমন যেন সবকিছু গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে যাত্রীগুলো নেমে যাচ্ছিল। নামতে নামতে প্রত্যেকে একবার করে চোখ বুলাচ্ছে তার দিকে। যেন চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণি দেখছে। কী অদ্ভুত! এভাবে তাকাবে কেন ওরা? তাকালে সে তাকাবে ওদের দিকে। কী অদ্ভুত পোশাক পরে আছে সবাই। এই যুগে কেউ এইসব পোশাক পরে? কয়েক দশক আগের পোশাক! এখনও দেখি বেশকিছু লোক ব্যাকডেটেড থেকে গেছে। কয়টা বাজছে দেখার জন্য রিহান পকেট থেকে তার ফোনটা বের করলো। বিকেল চারটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। এ্যাহ! মাত্র বিশ মিনিট ঘুমিয়েছে সে? মনে হচ্ছে যেন হাজারো রাত কাটিয়ে ঘুম থেকে ওঠেছে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল তার ফোনের স্ক্রিনে তারিখ এবং সালের দিকে। ৩ই জানুয়ারি ১৯৪২। হোয়াট! ফোনের ডেইট চেঞ্জ হলো কেমনে? সিটিংয়ে গিয়ে তারিখটা ঠিক করতে চাইলে কোনো অপশনই খুঁজে পেল না সে। অদ্ভুত! ফোনটাও দেখি তাকে বিব্রত করে তুলছে। হেল্পারের দিকে তাকালো সে। এ কী! হেল্পার এভাবে চোখ কপালে তুলে তার ফোনের দিকে চেয়ে আছে কেন? মনে হচ্ছে যেন জীবনে কখনও মোবাইল ফোন দেখেনি। রিহানকে অবাক করে দিয়ে হেল্পার জিজ্ঞেস করলো, 'স্যার এইডা কী যন্ত্র? এইডার কাম কী?'

রিহান এবার বেশ বিরক্ত হলো। এই মুহূর্তে একজন বাসের হেল্পারের কাছ থেকে মশকরা আশা করছে না সে। ব্যাটা না-কি মোবাইল ফোন চিনতে পারছে না। কয়েকদিন পর কুকুরের গলায়ও এই ফোন ঝুলতে শুরু করবে, আর সে জিজ্ঞেস করছে এটা কী যন্ত্র। অদ্ভুত! কিছুটা বিরক্ত দেখিয়ে সে হেল্পারকে জিজ্ঞেস করলো, 'ভাড়া কত হয়ছে বলো?'

'স্যার তিন পয়সা।'

 'তি..ত্বি..ইন পয়সা? মানে তিন টাকা?

 'না স্যার, শুধু তিন পয়সা।'

 'শুনো, ইতোমধ্যে অনেক মশকরা করে ফেলছো। তোমার সাথে মশকরা করার মুড নাই এখন। ধরো একশো টাকা। পুরোটাই রেখে দাও।' একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিলো রিহান হেল্পারের দিকে। তারপর আবারও জিজ্ঞেস করলো, 'এইখানে বাসস্ট্যান্ড বলছিল কোথায়? ঢাকার বাস পাওয়া যাবে কোথায়?'

রিহানের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না হেল্পার।  এক নজরে তাকিয়ে আছে সে একশো টাকার নোটটার দিকে। যেন এর আগে সে এরকম নোট দেখেনি। রিহানকে দ্বিতীয় দফা অবাক করে দিলো সে, 'স্যার এইডা কী দিলেন? এইডা কোন দ্যাশের নোট?'

ইচ্ছে হয়েছিল কষে একটা থাপ্পড় দেয় হেল্পারের গালে। নিজেকে সামলালো রিহান। নিজের ব্যাগটা নিয়ে নেমে যেতে চাইলে হেল্পার বলে উঠলো, 'স্যার আপনের কাছে পয়সা নাই বুঝবার পারছি। সমস্যা  নাই স্যার। ভাড়া লাগবো না। আপনের ঐ যন্ত্রডা আমার পছন্দ হয়ছে।'

রিহান নেমে যাচ্ছিল। ড্রাইভার এবার হেল্পারের উদ্দেশ্যে গলা বাড়ালো, 'ওই মজনু কী হয়ছে রে?'

'কিচ্ছু হয়নাই ভাই। ভাইজানের কাছে ভাড়া নাই। কইছি দেওন লাগবো না।'

 শুনে রিহানের গা জ্বলে ওঠলো। ওখান থেকে এখানে ভাড়া বিশ টাকাও হবে না, তার জায়গায় সে একশো টাকা দিয়েছে। তারপরও হেল্পার  বলছে ভাড়া দেয়নি। অপরিচিত জায়গা। তাই রিহান চুপচাপ মেনে নিলো, ঝামেলা পাকালো না। ড্রাইভারের শেষ কথাটাও সে হজম করে নিলো। ড্রাইভার বললো, 'ভাড়া থাকবো ক্যামনে? দ্যাখছো না কেমন উদ্ভট পোশাক পইরা আছে হে? হা হা হা!' ড্রাইভারের হাসিটা ভেতরের রাগটা আরও বাড়িয়ে দিলো তার। ওরা নিজেরাই সেকেলে পোশাক পরে আছে, আর তার পোশাককে বলছে উদ্ভট! এই মুহূর্তে কিছু বলতে গেলে দলবেঁধে হয়তো ঝগড়া করতে আসবে ওরা। এই অপরিচিত জায়গায় তার পক্ষ হয়ে হয়তো কেউ কথা বলবে না। তাই চুপচাপ হাঁটতে লাগলো রিহান। চারপাশের পরিবেশটা কেমন যেন সেকেলে। উন্নয়নের ছোঁয়া হয়তো লাগেনি এদিকটায়। একটা বিল্ডিংও চোখে পড়েনি। গ্রাম এলাকা বলা চলে। দৃষ্টি যতদূর যায় ধূ-ধূ মাঠ আর ধানক্ষেত। খোলামাঠে বাচ্চা শিশুরা ডাংগুলি খেলতেছে। এই যুগে এসে বাচ্চারা ডাংগুলি খেলতেছে ভাবা যায় না। নিজের বাচ্চাকালের কথা মনে পড়ে গেল তার। আজকাল প্রায় শিশু বড়ো হয় মোবাইলে ভিডিও গেইম খেলে, সেখানে এরা খোলামাঠে ডাংগুলি খেলতেছে। খানিকক্ষণ ওদের দিকে চেয়ে রইলো রিহান। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডটা গেল কই? এখানে তো একটা বাসস্ট্যান্ড থাকবে বলছিল। এরকম পরিবেশে বাসস্ট্যান্ড থাকবে আশাও করা যায় না। কয়েকজনকে দেখা গেল গরুর গাড়ি নিয়ে যাত্রা করতে। এখনও গরুর গাড়ি চলে? যাক, বাংলার ঐতিহ্য অন্তত এরা ধরে রাখছে।

 'ভাই, এখানে বাসস্ট্যান্ডটা কোথায়? এদিকে একটা বাসস্ট্যান্ড আছে বলছিল।' একজন সেকেলে পোশাক পরা লোককে জিজ্ঞেস করলো রিহান। লোকটাকে কিছুটা ভদ্র মনে হলো। হয়তো অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছেন। কাঁধে একটা ঝুলানো ব্যাগ।

'বাসস্ট্যান্ড!' লোকটা যেন অবাক হলো। 'এখানে বাসস্ট্যান্ড কোথা থেকে আসবে?'

'ঢাকার বাস কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?'

'ও ঢাকায় যেতে চান? আপনি তো সরাসরি ঢাকার বাস পাবেন না। জাহাজে করে যেতে হবে। এজন্য আপনাকে বন্দরে যেতে হবে।'

রিহান বুঝতে পারে না কী হচ্ছে তার সাথে। বাসের হেল্পার, ড্রাইভার এমনকি সবাই তার সাথে এরকম ব্যবহার করছে কেন? ঢাকা থেকে সে বাসে করেই তো চট্টগ্রাম এসেছে। এখন এই লোকটা বলছে সরাসরি বাস পাওয়া যায় না। কিছু তো একটা হচ্ছে তার সাথে। একসাথে সবাই তো আর উল্টাপাল্টা বকতে পারে না। 

 'শুনুন, ঐ যে, ওখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বন্দরে চলে যান। ট্যাক্সি সোজা আপনাকে বন্দরে নামিয়ে দেবে।' বলতে বলতে লোকটা চলে গেল। রিহান এগিয়ে গেল একটা ট্যাক্সির দিকে। এক ট্যাক্সির ড্রাইভার আগ বাড়িয়ে বললো, 'বন্দরে যাবেন? ওঠুন...'

রিহান উঠে বসলো ট্যাক্সিতে। তারপর ভাবতে শুরু করলো তার সাথে এ পর্যন্ত ঘটা সবকিছু। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে সাত দিনের জন্য সে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসেছিল। চারদিন না হতেই মা বারবার ফোন দিচ্ছিল চলে যাওয়ার জন্য। চলে যেতে বলছে কারণ, মা-বাবা তার এনগেজমেন্টের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। পাত্রী আগেই দেখা হয়ে গেছে। দেখতে মোটামুটি ভালোই বলা চলে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। রিহান কোনোমতে এনগেজমেন্টের দিনটা তিনদিন পিছিয়ে আরও দুইদিন কাটালো চট্টগ্রামে। তারপর আজ চলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে এসে ঢাকাগামী কোনো বাস পাচ্ছিল না সে। তখন এক লোকের সাহায্য নিলে, লোকটা বলে কিছুটা দূরে আরেকটা বাসস্ট্যান্ড আছে, ওখানে ঢাকার বাস পাওয়া যাবে। রিহান সেই বাসস্ট্যান্ডে যেতে চাইলেও অনেকক্ষণ ধরে যেতে পারছিল না, কারণ ওদিকের কোনো গাড়িতেই সিট খালি পায়নি সে। সিএনজিগুলোও অতিরিক্ত ভাড়া চেয়ে বসে। তাই বাধ্য হয়ে লোকাল বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। অনেকক্ষণ পর একটা অদ্ভুত ধরনের বাস দেখতে পায়। কেমন যেন পুরনো মডেলের। পেছনের অংশটা বাসের মতো হলেও, সামনের অংশটা জীপগাড়ির মতো। বাসটা ঐ বাসস্ট্যান্ডের দিকেই যাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে রিহান ঐ বাসেই উঠে পড়ে। তারপর বাস জ্যামে আটকালে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে তার সাথে। 

 বন্দরে এসে থামলো ট্যাক্সি। রিহান ট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভারকে কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, 'ভাড়া কতো হয়েছে?' 

 রিহান এবার পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল অদ্ভুত কিছু শোনার। ড্রাইভার জবাব দিলো, 'পাঁচ পয়সা স্যার।'

 'দেখুন ভাই, আমার কাছে তো পাঁচ পয়সা নেই। আমি আপনাকে পাঁচশো টাকা দিই। এই নিন...' নরম কণ্ঠে বললো রিহান। 

'পাঁচশো ট্যাহা?' চমকে ওঠলো ড্রাইভার। মুখটা হা হয়ে গেল তার। যেন জীবনে কখনও পাঁচশো টাকা একসাথে চোখে দেখেনি সে। রিহান একটা পাঁচশো টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিলে  ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বাভাবিক হলো। কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললো, 'এই তাইলে আপনের পাঁচশো ট্যাহা? আমি ভাবছিলাম সত্যি সত্যি আপনে আমারে পাঁচশো ট্যাহা দ্যাবেন। আমারে বোকা পাইছেন মিয়া? কোন দ্যাশের নোট একটা আমারে ধরাইয়া দিবার চাচ্ছেন?'

'এটা তো আমাদের বাংলাদেশেরই নোট ভাই।'

 'বাংলাদেশ? বাংলাদেশ নামে আবার দ্যাশ একডা কইত্থেকে আইলো? এইডা তো ব্রিটিশ ভারত।'

রিহানের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠলো এবার। ব্রিটিশ ভারতের আমল শেষ হয়েছে আরও কয়েক যুগ আগে। কিন্তু চোখের সামনে এই লোকটার কথা অবিশ্বাসও করতে পারছে না। আচ্ছা, স্বপ্ন দেখছে না তো সে? জোরে একটা চিমটি কাটলো সে নিজের হাতে। না, স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই ঘটে চলেছে সবকিছু।

'কী ভাই, এইভাবে নিজেরে নিজে চিমটি কাটেন ক্যা? জাইগা জাইগা স্বপ্ন দ্যাখবার লাগছেন না-কি? দ্যান, ভাড়াটা দ্যান। এই লন আপনের বাংলাদেশি পাঁচশো ট্যাহা।' বলেই পাঁচশো টাকার নোটটা দিয়ে দিলো ট্যাক্সি ড্রাইভার। রিহান অসহায় কণ্ঠে বললো, 'ভাই, আমার তো এসব নোট ছাড়া আর নাই।'

'ঠিক আছে। এইডা কইলেই তো হইলো। শুধু শুধু পাঁচশো ট্যাহার স্বপ্ন দ্যাহান ক্যান?' চলে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ঘুরিয়ে নিলো ড্রাইভার। রিহানও ঘুরে এসে জিজ্ঞেস করলো, 'ভাই, আজকে কত তারিখ?'

'জানুয়ারির ৩ তারিখ আইজ।' ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল ট্যাক্সি। রিহান এবার ট্যাক্সিটা ধরে একই গতিতে পা চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করে, 'কোন সাল এটা?'

'ধুর কোন পাগলের পাল্লায় পইড়া গেলাম! সালও জানে না। ১৯৪২ সাল চলে এইডা।'

ট্যাক্সিটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল রিহানকে। কিন্তু চালকের শেষ কথাটা তার কানে বাজতে থাকে বারংবার, '১৯৪২ সাল চলে এইডা।' 

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০১
লেখা: ShoheL rana
1663511296468.jpg

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!