পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া

in hive-120823 •  18 hours ago 

নমস্কার বন্ধুরা। শীতের মরসুমে আপনারা সকলে কেমন আছেন? আশা করছি সকলেই ভালো আছেন। আজ আবারও চলে এসেছি আপনাদের সঙ্গে নতুন কিছু শেয়ার করে নেওয়ার জন্য। আশা করছি আপনাদের সকলের ভালো লাগবে।

আপনারা কখনো হঠাৎ করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে আপনারা জানবেন হঠাৎ ঘুরতে যাওয়া কতটা adventurous হয়। আজ আমি আপনাদের সঙ্গে এমনি একটি ঘুরতে যাওয়ার গল্প শেয়ার করবো। আজ গ্যালারি ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ করে ছবিগুলো সামনে আসতেই ভেবে নিয়েছিলাম আজ আপনাদের সাথে সেই গল্পটি শেয়ার করব। চলুন তাহলে গল্পটা শেয়ার করা যাক।

1000128030.jpg

সালটা ছিল ২০২০‌। সম্ভবত জানুয়ারি মাস। তখনও আমাদের রাজ্যে করোনার প্রকোপ শুরু হয়নি। এমনকি করোনার নামটাও তখনো পর্যন্ত শুনিনি। কোথাও কোনো ঘুরতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। তবে হঠাৎ করে একদিন রাত আটটা নাগাদ দাদা বাড়িতে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করল ---- " একজায়গায় ঘুরতে যাবি?"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম ---"কোথায়?"
দাদা বলল---" পুরুলিয়া।"

এরপরে দাদা পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। যা বুঝলাম তা হল--আমাদের পাড়া থেকেই একটি বাস ছাড়া হচ্ছিল। গন্তব্যস্থল ছিল পুরুলিয়া। ১ দিনের ট্যুর।Per head খরচ বাবদ নেওয়া হচ্ছিল ১০০০ কিংবা ১২০০ মতো। এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে বাসের সব সিট বুকিং না হওয়ার জন্য বাকি সিট গুলো পূরণ করতে ট্যুর অর্গানাইজাররা শেষ মুহূর্তে হাফ টাকায় বাকি সিট গুলোর বুকিং নেয়। এমনিতেও ঐ সিটগুলো ফাঁকাই যেত তাই কিছুটা টাকা যাতে বাকি সেটগুলো থেকে পাওয়া যায় তাই তারা এই ব্যবস্থা করেছিল। আর যারা এই ট্যুরের অর্গানাইজ করেছিল তারা সকলেই আমাদের পরিচিত ছিল তাই দাদাকে এই অফারটি করতেই দাদা আমাদের না জানিয়েই টাকা দিয়ে বুকিং করে ফেলেছিল ।

বাস ছাড়ার টাইম ছিল রাত ন'টা। আমরা খবর পেলাম সন্ধ্যে আটটায়। হাতে মোটে ছিল এক ঘন্টা সময়। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নেই, কোনো কেনাকাটা নেই । তড়িঘড়ি আমি আর বৌদি রেডি হয়ে গেলাম। যেহেতু সেখানে গিয়ে থাকার কোন ব্যবস্থা ছিল না তাই জামাকাপড় বিশেষ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবুও কোনো এক জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি তার জন্য তো একটা পূর্ব পরিকল্পনা থাকা দরকার। তবে সেসব করার মতো সময় আমাদের হাতে ছিল না। তাই হাতের কাছে যা পেয়েছিলাম পরে নিয়েছিলাম। তারপর দেখতে দেখতে রাত ন'টা বেজে যায়। আমরা সকলে গিয়ে বাসে উঠে পড়ি।

1000128020.jpg

এরপর সারারাত বাসেই কেটে যায়। আমাদের বাস পুরুলিয়ায় গিয়ে পৌঁছনোর কথা ছিল সকাল ন'টা। তবে বাসচালক রাস্তা চিনতে ভুল করায় আমাদের বাস পুরুলিয়া পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। আমরা পুরুলিয়ায় গিয়ে পৌঁছই দুপুর বারোটার সময়। যার ফলে আমাদের ব্রেকফাস্ট এর যে পরিকল্পনা ছিল সেটা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ রান্না করে ব্রেকফাস্ট করতে গেলে আমাদের ঘোরার টাইম থাকত না। তবে সকলেই খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল। তাই ব্রেকফাস্টের বদলে লাঞ্চের আয়োজন করা হয় ‌। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভাত, ডাল, মাংস,চাটনি রান্না করে ফেলে। আমরা সকলে আমাদের লাঞ্চ সেরে ফেলি।যেহেতু সেই দিন রাতেই আবার বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হত তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে এক একটা গ্রুপ তৈরি করে গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যায়।

1000128023.jpg

মোশন সিকনেস থাকার কারণে আমি পুরুলিয়া পৌঁছনোর আগেই খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম ঠিকই তবে প্রথমবার পাহাড় দেখার এক্সসাইটমেন্টও ছিল প্রচুর। জীবনে প্রথমবার পাহাড় আমার পুরুলিয়াতে গিয়েই দেখা। অসাধারণ ভিউ। আমাদের গাড়ি প্রথমে গিয়ে দাঁড়ায় বামনী ফলসের কাছে। ঝরনার শব্দ কানে আসতেই সে কি এক্সাইটমেন্ট। প্রথমবার ঝর্ণা দেখব সেই উত্তেজনায় সত্যিই বলে বোঝানোর নয়। একটা দীর্ঘ সিঁড়ি পথ দিয়ে নেমে তারপর ঝর্ণার দেখা মিলবে। এত এনার্জি কোথা থেকে যে হঠাৎ করে চলে এসেছিল জানিনা তবে সেই দীর্ঘ সিঁড়ি পথ দিয়ে খুব স্বল্প সময়েই নেমে পড়েছিলাম ঝরনা দেখার উদ্দেশ্যে। সে এক্সাইটমেন্টের ভিডিও আমি আমার মোবাইলে ক্যাপচার ও করেছিলাম। লেখা শেষে সেই ভিডিও দেওয়ার চেষ্টা করব।

1000128021.jpg

লিংক

ঝর্ণা দেখার এক্সাইটমেন্ট এর একটি ভিডিও

ঝর্ণার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্য বলে বোঝানোর নয়। ঝরনার কল্ কল্ শব্দ মন কেড়ে নিয়েছিল। অনেকে সেই ঝর্ণার জলে স্নানও করছিল। প্রচুর মানুষ এখানে ফটো তুলছিল। আমরাও প্রথমবার দেখা ঝরনার সাথে কিছু ফটো তুলে নিয়েছিলাম। তারপর কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটা মন প্রাণ ভরে উপভোগ করেছিলাম। যেহেতু হাতে সময় খুবই কম ছিল তাই এরপর বামনি ঝর্ণাকে গুডবাই জানিয়ে আমাদের আবার পরবর্তী গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়েছিল।

1000128024.jpg

1000128025.jpg

এরপর আমরা চলে গিয়েছিলাম মার্বেল লেকে। এত অসাধারণ লেগেছিল কি বলবো। একটা ভালো ক্যামেরা নিয়ে এখানে ফটোশুট করলে বা ভিডিও শুট করলে বোঝা দায় যে এটা পুরুলিয়ার মত একটি গ্রামের লেকের ধারের ভিউ। পরবর্তীকালে আমি এই জায়গাতে করা একটা প্রি ওয়েডিং ভিডিও দেখেছিলাম। কি অপূর্ব যে লেগেছিল ভিউ টা কি বলবো। আমরা অনেক অনেক টাকা খরচ করে দূর-দূরান্তে যাই সুন্দর সুন্দর ভিউ পাওয়ার জন্য। তবে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই ঘোরার এত সুন্দর সুন্দর জায়গা রয়েছে সেটা না গেলে হয়তো জানতেই পারতাম না।

1000128019.jpg

1000128018.jpg

এরপর আমাদের গাড়ি পাহাড়ি অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছিল আপার ড্যামের উদ্দেশ্যে। এই আপার ড্যামে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি বেশ সুস্থই ছিলাম। তবে সমস্যাটা হলো এবার। এই আপার ড্যামে ওঠার সময় গাড়িটা এত ঘুরে ঘুরে উপরে উঠছিল যে আমার গা টা গুলিয়ে উঠেছিল। শেষমেশ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে আপার ড্যামে গাড়ি পৌঁছনো মাত্রই আমি বমি করে ফেলেছিলাম। এত সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি জায়গায় বমি করার পর নিজেরও খুব লজ্জা লাগছিল। তবে আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। যদিও এক সাইডেই করেছিলাম তবুও সবার সামনে একটু লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। যাইহোক তারপর আপার ড্যাম থেকে পুরো জায়গাটিকে এত অসাধারণ লাগছিল যা নিজের চোখে না দেখলে বর্ণনা করা যায় না।

1000128016.jpg

এই পুরুলিয়াতে মুখোশ গ্রাম বলে একটি জায়গা রয়েছে যেখানে খুব সুন্দর সুন্দর মুখোশ কিনতে পাওয়া যায়। এই মুখোশগুলো সাধারণত খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি করে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর তার ওপরে রং দিয়ে কারুকার্য করা হয়। এখানে যেহেতু প্রায় সব পরিবারই এই ধরনের মুখোশ তৈরীর কাজের সাথে যুক্ত তাই এই গ্রামের নাম মুখোশ গ্রাম।

1000128027.jpg

পুরুলিয়ার অন্যতম ঐতিহ্য হলো ছৌ নাচ। এই ছৌ নাচের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক পরা হয় আর তার সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ এর ব্যবহার। এই মুখোশগুলোর ওজন কিন্তু বেশ ভালোই হয়। এত ভারী ভারী মুখোশ এবং কস্টিউম পরে এত লম্ফ ঝম্ফ করে কীভাবে যে তারা নাচ করে জানি না। এই ছৌ নাচে অনেক এনার্জির প্রয়োজন হয়। আগেকার দিনে কেবলমাত্র পুরুষেরাই এই ধরনের নাচের সাথে যুক্ত থাকত। তবে বর্তমানে অনেক মহিলা দলও গড়ে উঠেছে। ছৌ নাচ দেখতে কিন্তু অসাধারণ লাগে। রাতের বেলায় আমাদের বাস যেখানে হল্ট করেছিল সেখানেই একদল ছৌ নাচের আর্টিস্টরা ছৌ নাচ পারফর্ম করছিল। এই ছৌ নাচ দেখার পর সকল টুরিস্টরা তাদের ইচ্ছেমতো কিছু পারিশ্রমিক তাদের দিচ্ছিল।

1000128026.jpg

ইতিমধ্যে রাত হয়ে এসেছিল। আমরা হাতে সময় খুবই কম পেয়েছি। এইটুকু সময়ের মধ্যে সবটা ঘুরে শেষ করা যায় না। তবুও আমরা যতটা পেরেছি সময়টাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। এরপর আমাদের কিছু টিফিন দেওয়া হয়েছিল। এই টিফিন খেয়ে আমরা আবার সকলে বাসে উঠে পড়েছিলাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে।

মাঝ রাস্তায় এক জায়গায় বাস থামানো হয়। তারপর সেখানে রান্নাবান্না করে খাওয়ানো হয়। তারপর আবার সকলে বাসে উঠে এবং সকালবেলায় আমরা আমাদের শহরে ফিরে আসি। খুব অল্প সময়ের জন্য ঘুরতে যাওয়া হলেও অনেক অনেক ভালো স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে আসি।

আজ তাহলে এখানেই শেষ করছি। আপনারা কি কখনো এইরকম হঠাৎ করে ঘুরতে গিয়েছেন কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। আপনাদের কমেন্টের মাধ্যমে অবশ্যই জানাবেন। আগামীকাল আবার অন্য কোন গল্প নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হব। সকলে ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
  ·  6 hours ago (edited)
  • গ্যালারি ঘাটতে ঘাটতে এরকম অনেক ছবি আমাদের সামনে চলে আসে, ভাগ্যিস গ্যালারি ঘাটতে গিয়ে তোমার এই ছবিগুলো সামনে এসেছিল তাই জন্যই তো আজকে তুমি পোস্ট করতে পারছো আর আমরাও দেখতে পাচ্ছি। কি অবাক কান্ড তাইনা না জানতেই তোমাদের কি সুন্দর ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এমনকি যে দাদা অফারটি করেছে সে নিজেই টাকা দিয়ে বুকিং করে রেখেছিল। এরকম যে আমার সাথে কেন হয় না! তাহলে আমারও কত কত জায়গায় ঘোরা হয়ে যায়।

  • যেহেতু স্কুল থেকে এক্সকারশনে পুরুলিয়ার বড়ন্তি তে গিয়েছিলাম। তাই আমার সত্যিই খুব পুরুলিয়া ভালো লেগেছে। পুরুলিয়া জায়গাটা যে অপূর্ব ,সেটুকু ধারনা হয়েছে। জীবনে প্রথমবার পাহাড় পুরুলিয়াতে গিয়ে দেখা- এটা শুনে আমার সবথেকে বেশি চমক লাগছে। পুরুলিয়ার পাহাড়গুলি এক ধরনের হয় আবার পাহাড়ি অঞ্চলের পাহাড় অন্যরকম হয়। কিন্তু ছবি দেখে যেটুকুনি বুঝতে পারছি তোমার ঘোরাঘুরি এবং পাহাড় দেখা খুবই সুন্দর ভাবে হয়েছে। তুমি যে এত সুন্দর সুন্দর জায়গায় গিয়েছো সে জায়গাগুলোতে আমি কিন্তু যেতে পারিনি। পুরুলিয়াতে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে আমি নিজেও জানতাম না। তোমার পোস্ট দেখে আরো জানতে পারলাম। এরপর একদিন পুরুলিয়া ঘুরতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরবো বাড়িতে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর করে সমস্তটা আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য।

Loading...