স্বরচিত গল্প (নবীনতার সাথে পরিচয়)

in hive-120823 •  10 days ago  (edited)

নমস্কার বন্ধুরা। আশা করছি আপনারা সকলে সুস্থ আছেন, ভালো আছেন।কালকে হঠাৎ একটি ডায়েরি ঘাটতে ঘাটতে স্কুল জীবনে আমার নিজের লেখা একটি ছোট গল্প চোখে পড়ে। আজ আমি সেই ছোট গল্পটিই আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আশা করি আপনাদের সকলের ভালো লাগবে । আপনারা জানাবেন আপনাদের কেমন লাগলো।।

নবীন কিশলয়

ছোট থেকেই বাবার হাত ধরে দেশ-বিদেশ না হোক শহরাঞ্চলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেরিয়েছি। বাবার সেই হাত আজ অস্তাগত। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ঘুরে বেড়ানোটা পেশায় না হোক এক প্রকার নেশায় পরিণত হয়েছিল ।তাই অফিসের কাজ সামলে অবসর সময়ে বেরিয়ে পড়ি শহরের কোনায় কোনায় না পাওয়াকে খুঁজে পেতে ।

বছর কয়েক আগে এমনই একদিন শহরের ভিড় ঠেলে ফুটপাতে হাঁটছি ।হঠাৎই পিছন থেকে একটা ছোট্ট হাত যেন তার মায়াবী জাদুকাঠি ছুইয়ে আমাকে বশ করে নিলো। পিছন ফিরে চাইতেই তার সেই মায়াবী মুখখানি আমাকে এতটাই মোহিত করল যে তার ছেড়া- খোড়া পোশাক কিংবা ধুলোমলিন দেহ কোনটাই আমাকে তার প্রতি ঘৃণিত করতে পারল না ।আজও স্পষ্টত মনে করতে পারি তার সেই আধো আধো স্বরে বলা কথাগুলো ।তার সেই কথা মনে করলে আজও গায়ে শিহরণ দেয় । কি সুন্দর ভাবে তার সেই কোমল হাত দুটো দিয়ে আমার আঙুল দুটো টেনে বলেছিল-

-------"বাবু দু-দু-দুটো...."।

1000090640.jpg

Link

--------"কী দুটো?"---হঠাৎই জাদুরাদ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এসে চিৎকার করে বলেছিলাম--

---------"তোরা তো সবাই একই কথা বলিস-- বাবু দুটো পয়সা দেবেন দুদিন কিছু খাইনি। সর সর..। দুদিন খাইনি! বলি খাসনি তো দিব্যি চলে ফিরে বেরচ্ছিস কি করে শুনি!

আমার এই কথাগুলি বোধ করি তার কোমল হৃদয়ে দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল তার কোমল দুটো চোখ বেয়ে যেন বাঁধভাঙ্গা নদীর মতো জলধারা বয়ে এলো। দেখে মায়া লাগলো বটে কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎই পিছন থেকে শুনতে পেলাম ---

---"বাবু দুটো পয়সা নয় টাকা দেবেন বই কিনতাম।"

কথাটা কানে আসতেই পা দুটো কেমন যেন থমকে গেল এই শহরের পথে বহুবছর হাঁটার সুবাদে ভিখারিদের টাকা চাওয়ার কায়দার সাথে আমি বেশ পরিচিত। কিন্তু কই এমন কথা তো কখনোই শুনিনি ।মন, প্রাণ বোধ করি কানও কখনো কখনো চিরাচরিত প্রথা ভেঙে নতুন কিছু শুনতে চাই। তাই যদি ভুল না হয় আমার অন্তরের পাশাপাশি কান দুটোও সেদিন থমকে গিয়েছিল। তবুও আমি বাস্তববাদী, ভদ্র সমাজে বাস করি। তাই আবেগ সামলে বাস্তবতাকে সামনে রেখে এক প্রকার ধমক দিয়েই বলেছিলাম---

--------" লজ্জা করে না বই কেনার টাকা চেয়ে ভিক্ষা করছিস। ও আচ্ছা ,দুদিন কিছু খাস নি বললে বুঝি কেউ আর দয়া করছে না তাই ভিক্ষা চাওয়ার নতুন পন্থা বাবা-মা এই শিক্ষা দেয়।"

আমার মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে একপ্রকার কান্নায় ভেঙে পড়ে আমায় বললো ---

--------"না বাবু আমার বাবা-মা আমায় এই শিক্ষা দেয় নি।"

তার কথাগুলো সত্যিই এবার বুকে এসে বিঁধলো ।নিজের বাস্তবতাকে এবার দূরে সরিয়ে তাকে কাছে টেনে কান্না থামিয়ে বললাম---

-------"কেন ভিক্ষা করিস ?"

সে যা বলল তা থেকে বুঝলাম কয়েকদিন যাবৎ তার বাবার অসুখ মা লোকের বাড়ি কাজ করে ।যা পাই তাতে তার বাবার ওষুধও হয় না। এদিকে তার পড়াশোনা করার ভীষণ ইচ্ছে। সরকারি স্কুলে পড়ে সে। কিন্তু খাতা পেনটুকু কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তার মায়ের নেয়।তাই খেলার সময়টুকু মায়ের চোখ এড়িয়ে সে বেড়িয়ে পড়ে ফুটপাতে ভিক্ষা করতে।

সবটা জেনে আমি একপ্রকার আবেগের ভেসে গেলাম ।বললাম -----

---------"তোর মা জানে এসব ?"

সে কেবল মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়লো।

সত্যি দিনটা আজও আমাকে উদ্বেলিত করে। সেদিন সত্যিটা অনুসন্ধান করতে আমি তার সঙ্গেই তার বাড়ি গিয়ে সত্যের সাথে মুখোমুখি হয়ে এলাম। সেদিনই আমি ঠিক করেছিলাম যতদিন বাঁচবো এই ছোট্ট টুকাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব আমি নেব। হ্যাঁ আমি জানি এই ছোট্ট টুকায়ের মতো সহস্র কিংবা লক্ষাধিক ছেলে একইভাবে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি হয়তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'কে বাঁচায় কে বাঁচে' গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় হয়ে তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারিনি ।কিন্তু স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে একটা ছোট্ট শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর মত সামর্থ্য বোধ হয় আমার ছিল ।

সেই ছোট্ট টুকাই সেদিন তার জীবন যুদ্ধে নবীন রূপে পদার্পণ করেছিল। ভিক্ষা চাওয়া থেকে সে পেয়েছিল চিরতরে ছুটি। সেই ছোট্ট শিশুর এক মুখ হাসি আর চোখের জলের মধ্যে দিয়ে আমি শুনতে পেয়েছিলাম তার সেই বুক চেরা আর্তনাদ।

------আজ থেকে আমি নবীন.......আমি নবীন...... আমি নবীন......।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...