ধৈর্য্যই সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি (আমার আজকের গল্প তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ)

in hive-120823 •  4 days ago  (edited)

নমস্কার বন্ধুরা। আপনারা সকলে কেমন আছেন? সকলের সুস্থতা কামনা করে আমি আমার আজকের ব্লগটি শুরু করছি। আশা করছি আপনাদের সকলের ভালো লাগবে।

যারা আমার পূর্বের পোস্টগুলি দেখেছেন তারা জানেন আমি বর্তমানে পেশাগতভাবে একজন গৃহশিক্ষিকা। ২০১৫ সাল থেকে আমি এই পেশার সাথে যুক্ত। আর এই পেশার হাত ধরে আমি জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। ২০১৫ সাল মানে আমি তখন ক্লাস টেন-এ পড়ি। সংসারে নানা অভাব অনটনের মাঝে নিজেকে কিছু একটা করতেই হতো। আর যেহেতু অন্য কোন কাজে তেমন পারদর্শিতা নেই তাই যেটা পারি সেটা করেই মাকে কিছুটা সাহায্য করতাম।

1000112292.jpg

আমি যে সময় পড়ানো শুরু করি সেই সময় আমার কোনো বন্ধুবান্ধব কোনো কাজের সাথেই যুক্ত ছিল না। প্রথমে খুব লজ্জা লাগতো কাউকে বলতে কারণ অনেকে ভাবতো এতটুকু মেয়ে যে নিজে এখনো পড়ছে সে কিই বা পড়াবে! যাইহোক ধীরে ধীরে ছাত্র বাড়ে। আর এখনো আমি সেই কাজটিই করে চলেছি। আর এই কাজের মধ্যে একটা অন্য ধরনের আনন্দ রয়েছে, যেটা হয়তো আমি অন্য কোনো পেশায় পাবো না।

1000112095.jpg

আর এই পড়ানোর পেশায় এসেই আমি অনেক রকমের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পরিচিত হয়েছি। সবাই ভিন্ন রকমের। কেউ শান্ত, কেউ চঞ্চল, কেউ অল্পতেই বুঝে যায় বা কারোর বুঝতে একটু সময় লাগে। প্রথম প্রথম ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে পড়তাম। যেহেতু বয়সটাও কম ছিল তাই বাচ্চাদের perspective থেকে কোনো বিষয় বোঝার চেষ্টা করতাম না। তাই রেগে গিয়ে কখনো কখনো খুব মেরেও দিতাম। এখন ভাবলে সত্যিই খুব কষ্ট হয় সেই সমস্ত বাচ্চাগুলোর জন্য যাদেরকে আমি আমার পড়ানো শুরুর প্রথমদিকে পড়িয়েছিলাম। পড়া না পারলে কি মারটাই না তারা খেত।

যাইহোক, দিন এগিয়েছে, সময় বদলেছে। এখন আমি অনেক বেশি ধৈর্য্যশীল হয়েছি। বাচ্চাদের দিক থেকে যেকোন বিষয় বোঝার ক্ষমতা খানিকটা এসেছে । তাই হুটহাট করে বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলি না। শান্ত মাথায় বিষয়টা বুঝে তবেই বকাঝকা করি। শুধু তাই নয় নিজেও বুঝতে পারি এই পড়ানোর হাত ধরেই আমি নিজেকে অনেকটা ইম্প্রুভ করেছি। বাচন ভঙ্গি বদলেছে, বদলেছে চিন্তা করার ক্ষমতা। আর সেই সাথে পড়াতে পড়াতেই না জানা অনেক বিষয় সম্পর্কে জেনেছি। এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে।

1000112117.jpg

এবার আসা যাক প্রধান গল্পে। এই বছর মার্চ মাসের ১৫ তারিখে আমি একটি নতুন ছাত্রকে পড়ানো শুরু করি। তারিখটা মনে আছে কারণ তার ঠিক আগেই আমি দার্জিলিং ঘুরে এসেছিলাম। এই স্টুডেন্টটি আমার এক টিচারের বন্ধুর ছেলে। আমার সেই টিচার নিজেও বাচ্চাটিকে সপ্তাহে তিনদিন পড়াতেন। আর আমি পড়াতাম বাকি তিন দিন। এইভাবে সপ্তাহে ছয় দিন আমরা পড়াতাম।

বাচ্চাটির বাবা-মা দুজনেই হাই স্কুলের টিচার। বাবা ম্যাথের এবং মা ইংলিশে টিচার। তবুও তারা বাচ্চাকে পড়াতে নাজেহাল। কারণ একটাই----বাচ্চাটি ভীষণ চঞ্চল। কোনো একটা বিষয়ে সে কোনো মতেই বেশিক্ষণ মন দিতে পারে না। যার ফলে তার এই বয়সে যা যা শেখার কথা সে কিন্তু তার অর্ধেকটাও শিখে উঠতে পারেনি। এখন সে পরে ক্লাস ওয়ানে, কৃষ্ণনগরেরই একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে অনেকগুলো করে সাবজেক্ট থাকে এবং পড়ার চাপও থাকে একটু বেশি। অথচ বাচ্চার অমনোযোগীতার ফলে তার বাবা-মা তাকে কোনো মতেই পড়ায় মনোযোগী করতে পারছিল না। সে মুখে সবকিছু বলতে এক্সপার্ট হলেও লেখার প্রশ্ন এলেই কোনোমতেই লিখতে রাজি নয়। এমত অবস্থায় তার মা না পেরে আমাকে এবং ঐ স্যার কে সপ্তাহে ছয় দিন বাচ্চাটিকে পড়ানোর দায়িত্ব দেন।

এটি ছিল আমার বর্তমানের সবচেয়ে ছোটো স্টুডেন্ট। প্রথমে আমার পড়ানোর কোন ইচ্ছে ছিল না তবে ওনাদের জোড়াজুড়িতে আমাকে রাজি হতে হয়। প্রথম এক মাস তো খুবই হতাশ হতাম কারণ বাচ্চাটি কিছু করতে চাইত না আর তার সাথে কথাও শুনত না। আমাকে বারবার তার মাকে ডাকতে হতো। এতে অবশ্যই তার মা এবং আমার দুজনেই বিরক্ত লাগত। আমাকে টিচার হিসেবে একেবারেই মানত না, চিৎকার করত, উঠে চলে যেত, আলমারির ওপর উঠে পড়ত.....এবং প্রত্যেকদিন পড়িয়ে বেরোনোর পর মনে হতো 'বাঁচলাম'।

1000112284.jpg

এইভাবেই এক মাস পেড়িয়ে দুই মাস চলল। তবে কোনো ইমপ্রুভমেন্ট হলো না। তাকে বেশি লেখানো যেত না। বাচ্চাটি গল্প শুনতেও ভালোবাসত না। এটা আমার কাছে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। সে কিছুক্ষণ পর পর উঠে যেত। প্রত্যেকদিন তার পটি পেত। পটিতে গিয়ে অনেকক্ষণ কাটিয়ে তারপর ফিরত। এই ভাবেই চলল দুই মাস।

1000112290.jpg

এরপর তাকে একটা করে সাবজেক্ট করানোর পর কিছুক্ষণ ব্রেক দেওয়া শুরু হলো এবং এক ঘন্টা পর তাকে খেলতে যাওয়ারও সময় দেওয়া হল। এতে দেখলাম খানিকটা কাজ হল। খেলার নেশাতেই সে কিন্তু পড়ছিল। তবে এই ট্রিকটাও খুব বেশিদিন টিকলো না। আবার যা ছিল তাই হয়ে গেল।

1000112112.jpg

আর ইতিমধ্যে আরো একজন যিনি স্যার ছিলেন উনি বিরক্ত হয়ে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে পুরো চাপটাই আমার উপর এসে পড়ল। যিনি ছিলেন উনি একজন সরকারি স্কুলের টিচার তাই বছরের মাঝে টিউশন ছেড়ে দিলেও ওনার ইনকামের পথ তখনও খোলা ছিল। আর এইদিকে বছরের মাঝে টিউশন ছাড়ার কোনো প্রশ্নই আমার মাথায় আসেনি। কারণ এইটাই আমার একমাত্র উপার্জনের পথ। সুতরাং দাঁতে দাঁত চেপে টিকে গেলাম আমিই।

এইভাবেই কেটে গেল মার্চ মাস থেকে এতগুলো দিন। এর মাঝে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে আমাকে না জানি কি কি করতে হয়েছে ----কখনো খেলতে হয়েছে, কখনো তার অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, আবার কখনো কখনো তার ম্যাজিক দেখতে হয়েছে। আর এত সাফারিং এর পর যখন কোন ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায় তখন নিজের কাছেও বেশ ভালো লাগে।

1000112286.jpg

এই কিছু মাসে বাচ্চাদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এখন কে পড়তে পড়তে আর উঠে যায় না। কোন কারনে তাকে উঠতে হলেও সে আমাকে বলে যায়, "ম্যাম তুমি একটু বসো, আমি আসছি।" এখন দিব্যি পড়াশোনাও করে। পড়ার মাঝে খেলতে যেতেও চায়না।

হ্যাঁ, শুধু পড়তে পড়তে একটু বোর হয়ে গেলে এটা ওটা নিয়ে একটু প্রশ্ন করে আর এক মিনিটের জন্য শুয়ে নেয়।

1000112106.jpg

ছেলের ইমপ্রুভমেন্ট দেখে বাবা-মা ও ভীষণ খুশি। তাই নিজের সাথে ঘটা বিভিন্ন ঘটনা থেকেই আমি শিখেছি জীবনে ধৈর্য্য রাখা অনেক বেশি জরুরী। ধৈর্য্যই জীবনে অনেক কিছুই এনে দেয়। তাই আপনাদেরও সাজেস্ট করব আপনারাও জীবনের চলার পথে ধৈর্য্য রাখবেন। হয়তো এই ধৈর্য্যই আপনাকে আপনার সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দেবে।

আজ তাহলে আমার ব্লগ যেখানেই শেষ করছি। আপনারা সকলে জানাবেন আমার পোস্টটি আপনাদের কেমন লাগলো। আগামীকাল আবার আপনাদের মাঝে হাজির হব অন্য কোনো গল্প নিয়ে।

ধন্যবাদ।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
Loading...

1000173922.png

Thank you so much for supporting me.

Loading...