সপ্তাহ দুয়েক আগে গাজীপুরের কাপাসিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানেই শীতলক্ষা নদীর তীরে বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় নদীর ঐপারে বাধা কয়েকটা নৌকা দেখে আমি ভেবেছিলাম হয়তোবা খেয়াঘাট।
আসলেই খেয়াঘাট কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাশে বসা কাপাসিয়া থানার সেকেন্ড অফিসারকে জিজ্ঞেস করার সে জানিয়েছিল যে , ঐখান থেকে কিছু নৌকায় মানুষ পারাপার হলেও ওগুলো মূলত বেদে নৌকা। জমাট বাধা কুয়াশার কারণে খুব একটা ভালো করে বোঝা না গেলেও ভালো করে তাকালে নদীতীরে বাধা নৌকার পাশে কয়েকটা ঝুপড়ি ঘরও দেখা যাচ্ছিলো। বেদে নামটা শুনলেই পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের এই লেখাটা মনে পরে ,
বাবু সেলাম বারে বার
আমার নাম গয়া বাইদ্যা,
বাবু বাড়ি পদ্মা পার।’
ওদের এভাবে নৌকায় বাস করতে দেখে খারাপ লাগে সেটা জানাতেই সেকেন্ড অফিসার জানালেন যে ,এখন বেদেদের জীবনে অনেকটাই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। প্রতিটা নৌকাতেই সোলার প্যানেল লাগানো রয়েছে এবং টিভিও আছে। এটা শুনে অবশ্য ভালো লাগলো আমার।
ঢাকাতে রাস্তায় হাঁটার সময় প্রায়ই বেদেদের মুখোমুখি হতে হয়। টাকার জন্য অনেকটা জোর -জবরদস্তি করে। নতুন পেলে সাপের ভয়ও দেখায়। ইদানিং অনেকটাই কমে গেছে ।
আগে আমি ওদের দেখলেই সাপের ভয়ে রাস্তা পাল্টাতাম। পরে আমার ভাবি বুদ্ধি দিয়েছিলো যে ,দেখলেই ধমক লাগিয়ে হাঁটা শুরু করবে ,তাহলে আর কিছু করবে না। ভাবীর এই বুদ্ধি কাজে লেগেছিলো আমার। কিন্তু যত যাই বলি না কেন ওদের প্রতি একটা দুর্বলতা কাজ করে সব সময়ই।
আমার মায়ের কাছে শুনেছি যে ,আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনের দিকে সন্ধ্যার আগে দিয়ে শব্দ পেয়ে গিয়ে দেখে যে এক বেদেনী প্রসব ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন। তখন গ্রামের লোকজনের সহায়তায় সেখানেই সন্তান প্রসব করেন।এরপর সাথে থাকা ঝাঁকাতে নবজাতক সন্তানকে রেখে মাথায় করে চলে যান তার গন্তব্যে। এই ঘটনা শোনার পর থেকে বেদে সম্প্রদায়ের প্রতি দুর্বলতা আরো বেড়ে গিয়েছিলো।
সাভারের বেদে পল্লী আমাদের এলাকা থেকে খুব একটা দূরে না। যার কারণে এদের সম্পর্কে আগে থেকেও কিছুটা জানতাম যে , তারা যদি তীরে নৌকায় বসবাস করে । এছাড়া নৌকায় করে আজ এ ঘাট তো কাল আরেক ঘাটে ভেসে বেড়ায় তারা। নদীতীরবর্তী লোকজনের মাঝে লোকজ নানা চিকিৎসা যেমন দাঁতের পোক বের করা, শিঙ্গার সাহায্যে বাতের ব্যথা দূর করা, জাদুবিদ্যা , সাপ খেলা দেখায় ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন।
এছাড়া ফসল তোলার মৌসুমে পাড়া-মহল্লায় মজমা বসিয়ে গান করে।প্রায় প্রতিটা বেদে পরিবারই নৌকা থাকে এবং কয়েকটি নৌকা ও পরিবার নিয়ে বেদেদের একটি দল গড়ে উঠে । নতুন নৌকা কেনার সামর্থ হলে ,বেদে সদস্য বিয়ে করতে সক্ষম হন।
তবে আজকে এই লেখা লিখতে গিয়ে আরেকটু ঘাটাঘাটি করে আরও একটু ভালো ভাবে জানার চেষ্টা করে যা জানতে পারলাম সেটা জানাতে চেষ্টা করবো আপনাদেরকে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ,
বাংলাদেশের প্রায় আট লক্ষ বেদে আছে। তারা দল বেঁধে ভ্রমণ করে এবং কখনো এক জায়গায় কয়েক মাসের বেশি থাকে না। বেদেরা একটি প্রান্তিক গোষ্ঠী। বেদেদের প্রায় ৯৮% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং প্রায় ৯৫% বেদে শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। ঐতিহাসিকভাবে বেদেরা ভোট দিতে পারতো না কারণ তাদের স্থায়ী আবাস ছিল না, একই কারণে তারা ব্যাংক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণের জন্য আবেদনও করতে পারতো না। ২০০৮ সালে বেদেরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়।
আমার মতো যারা বেদেদের আগের জীবনযাপনের চিত্র দেখে বা শুনে অভ্যস্ত তারা এখন বেদে পল্লীগুলোতে গেলে কিছুটা অবাক হবেন। কারণ ইদানিং অনেক বেদেই নৌকার পাশাপাশি আধুনিক ইমারত, পাকা, আধা পাকা ও টিনশেড বাসায় বসবাস করেন । অবশ্য কিছু সংখ্যক বেদে তাঁবুতেও বসবাস করেন।
সমাজের মূলধারার সাথে তারা অনেকটাই মিশে গেছেন। অনেকে দোকানপাট বসিয়ে আয়ের পথ খুলেছেন ,কেউবা আবার আশপাশের কারখানায় চাকরি নিয়েছেন। অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন সাপের খেলা, সাপ ধরা, তাবিজ-কবচ ও যন্তর-মন্তরের ব্যবসা। অবশ্য এখনো অনেকেই পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে সাপের খেলা দেখান। তবে তাঁদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে ।
এই তথ্যগুলো জেনে বুঝতে পারলাম যে ,ঢাকার রাস্তায় কেন আর আগের মতো বেদেদের দেখি না।
বেদের সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রার পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ সত্যিই চমৎকার ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে তা সমাজের অগ্রগতিরই প্রতিফলন।এক সময় তারা যাযাবর জীবন কাটালো এখন ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে বসবাস অনন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। তবে তাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির কতটুকু টিকে থাকবে সেটা ভাবনার বিষয়। আপনার লেখা সব সময় নতুন কিছু জানার সুযোগ দেয়।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit